চীন-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তিতে শঙ্কিত ভারত

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া এবং চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গে - টুইটার

  • মোতালেব জামালী
  • ০৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:১১

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি মাথায় রেখে পাকিস্তান এবং চীনও তাদের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করেছে। সম্প্রতি চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেঙ্গে নেপাল ও পাকিস্তান সফর করেছেন। পাকিস্তান সফরকারে তিনি দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছেন। যদিও এই চুক্তির বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে, দক্ষিণ এশিয়ায় দ্রুত পরিবর্তনশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতির বিষয়টি মাথায় রেখেই চীন ও পাকিস্তান এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এতে যে ভারতের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তির বিষয়টিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরিতার পেক্ষাপটে উপমহাদেশ দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মহড়ার নতুন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এতে একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এবং অন্যদিকে চীন ও পাকিস্তান দুই পক্ষই নিজেদের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা চলছে, তার ফলে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায়ও এর প্রভাব পড়বে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ মীমাংসা ও আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি জোরদার করার লক্ষ্য নিয়ে গঠন করা হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা সার্ক। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিরোধের ফলে সার্ক এখন মৃতপ্রায়। এর কোনো কার্যক্রম নেই বললেই চলে। এ অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান মেরুকরণও সার্কের এই পরিণতির অন্যতম কারণ। কোনো একটি পক্ষে যাওয়ার জন্য এই অঞ্চলের ছোট ছোট দেশগুলোও বর্তমানে চাপের মধ্যে রয়েছে।

চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওয়েই গত ডিসেম্বরের শুরুর দিকে পাকিস্তানে আসার আগে নেপাল সফর করেছেন। তার নেপাল সফরকে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির ও দেশটিকে কোণঠাসা করার চীনা কৌশলের অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। চীন এই অঞ্চলে তার মিত্র দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক আরও জোরদারের মাধ্যমে ভারতকে চাপের মধ্যে রাখতে চায়। এছাড়া ৬০ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) চুক্তি করে বেইজিং পাকিস্তানকে আরও বেশি কাছে টানতে চাইছে।

ভারতের হুমকি মোকাবেলায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে নানাভাবে সহযোগিতা করছে। অন্যদিকে ভারতও পাল্টা কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক সহযোগিতা জোরদার করার মাধ্যমে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সীমান্তে উত্তেজনা লেগেই আছে। পাকিস্তান ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাশ্মিরে তার বিমান বাহিনীর শক্তিমত্তা ভারতকে দেখিয়েছে তাদের জঙ্গিবিমান ভূপাতিত ও এর পাইলটকে আটক করার মাধ্যমে।

বেইজিং পাকিস্তান নৌবাহিনীর আধুনিকায়নেও সহযোগিতা করে যাচ্ছে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্য বহুমুখী ব্যবহারের উপযোগি টাইপ ০৫৪এ- এপি ষ্টেলথ ফ্রিগেট তৈরি করছে চীন। এটি ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর মোকাবেলায় পাকিস্তানী নৌবাহিনীর সক্ষমতাকে অনেক গুন বাড়িয়ে দেবে। দুই বাহিনীর শক্তিমত্তায় ভারসাম্য আনবে।

চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ইসলামাবাদ সফরকালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওয়েই ফেঙ্গে দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন। যে কোনো ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, দুই দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষা করা এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যেই তিনি এই আহবান জানান বলে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।

পাকিস্তানের কিছু গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, চীনের সাথে নতুন এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ফলে পাক-ভারত সীমান্তে ভারতের সৈন্যদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য দুই দেশের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় আরো জোরালো হবে। খবরে আরো বলা হয়েছে, লাদাখ এলাকায় ভারতের সৈন্যদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও তাদের কৌশলগতভাবে স্পর্শকাতর স্থাপনা নির্মান প্রকল্প সম্পর্কে তথ্য লাভে বর্তমানে চীন যে প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম ব্যবহার করছে তা তারা পাকিস্তানকে দেবে। যদি তাই হয়, তাহলে গোপন এই সমঝোতা স্মারক হচ্ছে ইটের বদলে পাটকেল মারার একটি মোক্ষম উদ্যোগ।

কারণ ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা গড়ে উঠেছে তাতে চীনের সামরিক তৎপরতার তথ্য লাভের জন্য পেন্টাগন নয়াদিল্লীকে রাডার থেকে তথ্য লুকানোর প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করবে।

গত বছর অক্টোবরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ২+২ বা বেসিক এক্সচেঞ্জ এন্ড কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট অন জিও স্পেশাল কোঅপারেশন নামে পরিচিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী কাশ্মিরের বিরোধপূর্ণ লাদাখ সীমান্তে চীনা সৈন্যদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য ভারতকে স্যাটেলাইটের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি সাধারণত তার ঘনিষ্ঠ কৌশলগত মিত্রদের সাথেই এ ধরণের চুক্তি করে থাকে।

২০২০ সালের জুলাই মাসে কাশ্মিরের লাদাখ সীমান্তে চীনা ও ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। সেখানে দুই দেশের বাহিনী মুখোমুখি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ভারত স্যাটেলাইটে মাধ্যমে গোয়েন্দা তথ্য পেলে তা ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে যে কোনো যুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে।

ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের এই চুক্তি লাদাখ সীমান্তে চীনের সাথে ভারতের চলমান উত্তেজনার কারণেই শুধু যে গুরুত্বপূর্ণ তা নয়। বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সমমনা বা ’লাইক মাইন্ডেড’ দেশগুলোকে একটি জোট গড়ারও আহবান জানিয়েছেন। চীনের সাথে সীমান্ত উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ভারতও তার দীর্ঘদিনের জোটনিরপেক্ষ নীতি থেকে সরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে।

অন্যদিকে চীন ও পাকিস্তান লাইক মাইন্ডেড বা সমমনা কিনা তা অবশ্য বিতর্কের বিষয়। কিন্তু বর্তমানে ভারতের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিস্থিতিতে দুদেশ মিত্রে পরিণত হয়েছে। চীনা কমিউনিষ্ট পার্টি পরিচালিত মিডিয়ায় সম্প্রতি প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, যদি পাকিস্তানের সাথে চীনের সহযোগিতা ভারতের বিরুদ্ধে একটি কার্যকর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাহলে তা আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য আনতে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে।

চীন সম্প্রতি নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একই ধরণের কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহন করেছে। তবে অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে পাকিস্তানকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পাকিস্তানে চীন অস্ত্র বিক্রি করেছে মাত্র ৫০ কোটি ডলারের। অন্যদিকে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে দেশটিতে চীন অস্ত্র বিক্রি করেছে ২৭০ কোটি ডলারের।

সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে পাকিস্তানে ২০০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে। যা যে কোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। কিন্তু ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে তা কয়েকশো মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এসব তথ্য থেকে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, পাকিস্তান অস্ত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে দ্রুতই চীনের দিকে ঝুকে পড়েছে।

ভারতে একসময় যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল একেবারেই নগণ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি ভারতে অস্ত্র বিক্রিতে শীর্ষস্থান দখল করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের আমলে গত ৫ বছরে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ আগের তুলনায় ৫ গুণ বেড়েছে। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে তার বৃহৎ প্রতিরক্ষা অংশিদার বা ’মেজর ডিফেন্স পার্টনার’ (এমডিপি) হিসেবে ঘোষণা করে। এধরণের শরিক দেশকে যুক্তরাষ্ট অত্যাধুনিক সমঅস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি সরবরাহ করে থাকে। অন্যদিকে একই সময়ে ভারতে রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ ৭২ শতাংশ থেকে ৫৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক সহযোগিতা চীন ও পাকিস্তানকে কিছুটা হলেও শঙ্কিত করে তুলেছে। কারণ ভারতের সাথে এ দুটি দেশেরই বিরোধপূর্ণ সীমান্ত রয়েছে। এ কারণেই এ দেশ দুটিও তাদের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা জোরদার করার মাধ্যমে এ অঞ্চলে সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছে। এর সাথে চীনের বৃহত্তর অর্থনৈতিক সহযোগিতা কর্মসূচী ’বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’কে যুক্ত করে পাকিস্তানের সাথে ৬০ বিলিয়ন ডলারের ’চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর’ চুক্তি করেছে বেইজিং।

এটিকে বিশ্লেষকরা শুধু অর্থনৈতিক নয়, একটি কৌশলগত সামরিক চুক্তি হিসেবেও দেখছেন। কারণ ইতিমধ্যে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বিল পাশের মাধ্যমে সিপিইসি’র দেখভাল বা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে দেয়া হয়েছে।

চীন পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতাকে বাড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কারণ চীন মনে করে ভারত এ মুহূর্তে চীনের চেয়ে পাকিস্তানের দিকেই নজর দিচ্ছে বেশি। তবে ভারতের নীতি নির্ধারকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন যে, ভারতকে হয়তো বিরোধপূর্ণ সীমান্তে চীন ও ভারতের সাথে দুই ফ্রন্টেই যুদ্ধ করতে হতে পারে।

পাকিস্তান ও ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্প বর্তমানে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করছে। পারমানবিক শক্তিধর দুই দেশ পাকিস্তান ও ভারত ক্রমশই বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এটা তাদের নিজেদের জাতীয় স্বার্থ কতটুকু সংরক্ষণ করবে তা সময়ই বলে দেবে।