পেন্টাগনে অস্থিরতা

কার্টুনটি করেছেন লিসা - কার্টুনিস্ট গ্রুপ

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ৩০ নভেম্বর ২০২০, ১০:৪৩

পৃথিবীর বহু দেশকেই যুদ্ধের পথে ঠেলে দিয়ে প্রধানত অর্থনৈতিক, অংশত ভৌগোলিকভাবে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে আমেরিকা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামের দেশটি। এককালের সমৃদ্ধ ইরাক ও লিবিয়াই এর জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু চিরদিন কারো সমান যায় না। যুক্তরাষ্ট্র এখন নানা মুখী সংকটের মধ্যে পড়েছে। এর বাইরে নয় দেশটির প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থায় পড়েছে তাতে দেশটির আভ্যন্তরিন রাজনৈতিক শৃঙ্খলা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশটির বিশ্বজুড়ে দেশটির প্রভাব অনেকাংশে খর্ব করবে। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যে আমেরিকার শেষের দিন এসে যাচ্ছে তা বলার বলার সময় হয়তো এখনও আসেনি।

আবার এর চাইতে কম কড়া কথা যে বলা যাবে, পরিস্থিতি ঠিক সে-রকমও নয়। কারণ, নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিতে ট্রাম্পের একগুঁয়ে অস্বীকৃতি এবং তাঁর জঙ্গি সমর্থকদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজপথে নেমে আসাই দেশটিতে আসন্ন ভয়াল ভবিষ্যতের অশনি সঙ্কেত দিচ্ছে।

সবাই জানেন, আমেরিকা একটি যুদ্ধবাজ দেশ। বলা হয়ে থাকে, আমেরিকার কাজই হচ্ছে যুদ্ধ বাধানো এবং যুদ্ধ করা। এর পেছনে যাবতীয় কলকাঠি নেড়ে থাকে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর, যা 'পেন্টাগন' নামে বহুল পরিচিত। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের পর সেই পেন্টাগনের অবস্থাই হতে যাচ্ছে চালকবিহীন নৌযানের মতো। তাঁদের আরো আশঙ্কা, মার্কিন সেনাবাহিনীর চেইন অব কম্যান্ডও শিগগিরই একটা গোলমেলে অবস্থার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনী গোলযোগে জড়িয়ে না-পড়লে এতদিনে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার তাঁর চাকরি হারাতেন - এমন একটা কথা মার্কিন দেশের হাওয়ায় বেশ ভাসছিল। আবার এমনও বলাবলি হচ্ছিল যে, প্রতিরক্ষা বিভাগে কর্মরত ট্রাম্প আমলের টিমটি সম্ভাব্য নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সাথে কাজ করতে অস্বীকৃতিও জানাতে পারে।

পেন্টাগনের এই টিম যদি বাইডেনের সাথে কাজ করতে অস্বীকার করে তাহলে তা দীর্ঘমেয়াদী অস্থিরতার জন্ম দেবে। দেশের বাইরে বিভিন্ন অভিযানে মার্কিন বাহিনীর অবস্থা যখন সঙ্কটজনক, তখন পেন্টাগনে অস্থিরতা তাতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

ঠিক এ মুহূর্তে বহির্বিশ্বে বেশ গোলমেলে পরিস্থিতির মধ্যেই আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যেমন, আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্যদের উপস্থিতির মাঝেই সহিংসতা ক্রমেই বাড়ছে। বেড়ে চলেছে ইরান-মার্কিন উত্তেজনাও। আর বাড়ছে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের 'আগ্রাসন'। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা বলছেন, অভ্যন্তরীণ অনিশ্চিত পরিস্থিতির সুযোগে এসব অঞ্চলের যে-কোনোটিতে উত্তেজনা চরমে উপনীত হতে পারে।

মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিরক্ষা বিষয়ক এক সাবেক উপদেষ্টা খোলাখুলিই বলেন, ''মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দিলে শত্রুরা অবশ্যই তার সুযোগ নিতে চাইবে। অথচ এদিকটায় কেউ নজরই দিচ্ছে না। এটা খুবই উদ্বেগজনক।''

মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপারকে নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে বলাবলি হচ্ছিল যে, নির্বাচনে ট্রাম্প বা বাইডেন যিনিই জয়ী হোন, এসপারকে যেতেই হবে। হালে ওই গুঞ্জন আর জোরদার হচ্ছে। ধারনা করা হচ্ছে খুব শীঘ্রই বিদায় নিতে যাচ্ছেন এসপার। মনে করা হচ্ছে, বাইডেনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যবর্তী সময়ের কোনো একদিন পদত্যাগ করবেন এসপার। কিন্তু হাওয়া বলছে, এসপারকে পদত্যাগের সুযোগও দেবেন না ট্রাম্প। নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল এসে যাওয়ার সাথে-সাথেই তাঁকে বরখাস্ত করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

এসপার চলে গেলে সাময়িকভাবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী ডেভিড নরকুইস্ট। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসপারের শূন্যতা মার্কিন প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সামর্থ্য পরীক্ষার একটা সুযোগ এনে দেবে এর শত্রুদের সামনে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ হচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম সংস্থা। ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ এর কাছ থেকে সরাসরি বেতন পেয়ে থাকে। তাই এ সংস্থার দরকার শক্ত নেতৃত্ব। যখন গোটা দুনিয়া আমেরিকার পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে আছে, এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পেন্টাগনে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সবচাইতে জরুরি।

আমেরিকায় যে-কোনো গোলযোগের সুযোগ তার শত্রুরা নিতে চাইবে - এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। এই বসন্তে আমেরিকা এবং সারা বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাস অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত, তখন রাশিয়া, চীন, ইরান ও উত্তর কোরিয়া সবাই এগিয়ে এসেছে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা পরীক্ষায়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা এখন পড়ে গেছে বিরাট এক ঝামেলায়। এর মাঝেও তাকে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক বেশ কিছু ইস্যুর মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যেমন, আগামী বসন্তের আগেই আফগানিস্তান থেকে বেশিরভাগ মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার সংক্রান্ত প্রতিশ্রæতি রক্ষা, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সামরিক উপস্থিতি সামাল দেয়া এবং ইরাকে মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে ইরানী হুমকি মোকাবিলর মতো বিষয় রয়েছে।

একজন মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ বলেন, আমি দেখতে পাচ্ছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্থির সময়ের সুযোগ নিতে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে আছে রাশিয়া ও চীন। এমন একটা স্পর্শকাতর সময়ে পেন্টাগনের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা ঠিক হবে বলে মনে করি না। মনে রাখতে হবে, শুধু প্রশাসন নয়, গোটা মার্কিন সমাজই একটা গোলযোগপূর্ণ অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে।

তাঁর মতে, দক্ষিণ চীন সাগর, কৃষ্ণ সাগর কিংবা পারস্য উপসাগর যেখানেই যা কিছু চোখে পড়বে পেন্টাগনের, সে-ব্যাপারে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া উচিত, যেমন নেয়া হতো মাত্র ছয় মাস আগেও।

কয়েক দিন আগে টিভি চ্যানেল এবিসি নিউজ খবর দেয় যে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এসপার পদত্যাগপত্র লিখে ফেলেছেন। এর জবাবে পেন্টাগনের একজন মুখপাত্র জানান, ''পদত্যাগের কোনো পরিকল্পনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নেই। আর কেউ তাঁকে পদত্যাগ করতে বলেনওনি। এসব গুজব শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।'' অন্যদিকে হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র বলেন, প্রেসিডেন্ট যদি কারো ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেন, সে-কথা তিনিই আপনাদের জানাবেন।

এসপার বরখাস্ত হোন বা পদত্যাগই করুন, নতুন প্রশাসন ক্ষমতা পেলেই পেন্টাগনে একটা পরিবর্তন তো আসবেই। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ এমন রদবদলে খুবই অভ্যস্ত এবং নতুন টিম যাতে সফল হয় সে-জন্য তার যথাসাধ্য চেষ্টা করে।

বাইডেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার পর পেন্টাগনে যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন মার্ক এসপারের থাকা না থাকা এখন আর গুরুত্বপূর্ন বিষয় নয়। বরং বাইডেন কিভাবে প্রতিরক্ষা দফতর সাজান তা দেখার বিষয়।

বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের নামে পুরো এলাকা অস্থির করে তোলা হয়েছে। রেজিম চেঞ্জ হলেও এ অঞ্চলের মানুষ পায়নি গনতন্ত্রের স্বাদ। সে সময় পেন্টাগন হয়ে উঠেছিলো বর্হিবিশ্বের যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের কেন্দ্র বিন্দু। আগামি দিনেও পেন্টাগনের ভুমিকা আরো বাড়বে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি নানা মাত্রায় বাড়তে পারে। আবার ইরানের সাথে শান্তিচুক্তি এগিয়ে নিতে পারলে তার কিছুটা প্রভাব পড়বে।

দক্ষিন চীন সাগর নিয়ে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ কোন মাত্রায় যায় তা দেখার বিষয়। ইতোমধ্যে এশিয়ায় চীন বিরোধী বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শেষ পর্যায়ের এই উদ্যেগ বাইডেন যদি এগিয়ে নিতে চান তাতে এশিয়ায় সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আর যুদ্ধ ও সংঘাত মানে হলো পেন্টাগনের প্রভাব বাড়া। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুদ্ধ থেকে বেড়িয়ে আসার ট্রাম্পের পরিকল্পনার সাথে পুরোপুরি একমত নাও হতে পারেন বাইডেন।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে