আকাশযুদ্ধে কতটা শক্তিশালী রাশিয়া

আগামীদিনে আকাশে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই করছে রাশিয়া - ইন্টারনেট

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৭ নভেম্বর ২০২০, ১৬:৫৭

যুদ্ধ এখন অনেকটাই আকাশনির্ভর। ফাইটার জেট, বোম্বার, ড্রোন, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম- এসবই এখন হয়ে দাড়িয়েছে যুদ্ধের প্রধান উপকরণ। বিশ্বের চলমান অস্ত্র প্রতিযোগীতার সেরা খেলোয়াড়দের একটি রাশিয়া আকাশযুদ্ধের সবগুলো সেক্টরেই ক্রমশ শক্তি বৃদ্ধি করছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাল্লা দিতেই দেশটি একের পর এক অস্ত্র উৎপাদন ও উন্নয়ন করে চলেছে।

রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ছয়টি প্রধান শাখা। গ্রাউন্ড ফোর্সেস, অ্যারোস্পেস ফোর্সেস, নেভি, এয়ারবর্ন ফোর্সেস, স্ট্রাটেজিক মিসাইল ফোর্সেস ও স্পেশাল অপারেশন ফোর্সেস। এর মধ্যে বিমান বাহিনী বলতে যেটি বোঝায় সেটিই হচ্ছে অ্যারোস্পেস ফোর্সেস। ২০১৫ সালে রাশিয়ান এয়ার ফোর্সেস ও রাশিয়ান অ্যারোস্পেস ডিফেন্স ফোর্সেস- এই দুটি বাহিনীকে একীভূত করে গড়ে তোলা হয় রাশিয়ান অ্যারোস্পেস ফোর্সেস।

এই বাহিনীর আবার প্রধান তিনটি শাখা রয়েছে। সেগুলো হলো এয়ার ফোর্সেস বা বিমান বাহিনী, এয়ার এন্ড মিসাইল ডিফেন্স ফোর্সেস বা আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী ও অন্যটি স্পেশ ফোর্সেস বা মহাশূন্য বাহিনী।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে সোভিয়েত এয়ার ফোর্সের বিমানগুলো ভাগ হয়ে যায় সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর মধ্যে। বিমান ঘাঁটিগুলো যেসব দেশের ভূখন্ডের মধ্যে পড়েছে তারা সেগুলো দিয়েই গড়ে তুলেছে তাদের বিমান বাহিনী। যে কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর হঠাৎ করেই রুশ বিমান বাহিনীর বিমান ও সৈন্য সংখ্যা ৩০ শতাংশেরও বেশি কমে যায়।

তবে রাশিয়া সেই ধকল কাটিয়ে ঠিকই আবার ঘুড়ে দাড়িয়েছে। বড় ধরণের ভাঙনের পরও আবার দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন করেছে রাশিয়ার বিমান বাহিনী। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাল্লা দিয়ে তৈরি করছে একের পর এক নতুন ফাইটার জেট ও ড্রোন। পরীক্ষা চালাচ্ছে একের পর এক এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু সারফেস মিসাইল।

বর্তমানে রাশিয়ান অ্যারোস্পেস ফোর্সের মোট সদস্য সংখ্যা ৪ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে এয়ার ফোর্সে ১ লাখ ৪৫ হাজার, স্পেস ফোর্সে দেড় লাখ এবং এয়ার এন্ড মিসাইল ফোর্সের সদস্য সংখ্যা এক লাখ ৩৫ হাজার। আকাশ পথে যুদ্ধ করার প্রধান উপকরণ যুদ্ধবিমান। সব ধরনের যুদ্ধবিমানেরই বড় বহর আছে রাশিয়ার। ফাইটার জেট ৮৭৩টি,বোম্বার আছে ১৮১টি, প্রশিক্ষণ বিমান ৪৯৭, স্পেশাল মিশন ফাইটার ১২৭টি, হেলিকপ্টার ১৫৫২টি এবং অ্যাটাক হেলিকপ্টার আছে ৫৩১টি।

রুশ বিমান বাহিনীর সর্বাধূনিক ফাইটার জেট সুখোই সু-ফিফটি সেভেন। ন্যাটো যার কোড নেম দিয়েছে ফেলন। এটি একটি বহুমাত্রিক ফাইটার জেট। পঞ্চম প্রজন্মের এই ফাইটারটি বানানো হয়েছে এয়ার সুপেরিয়রিটি অর্থাৎ আকাশে শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার এফ-থার্টি ফাইভের সাথে টক্কর দিতেই সিঙ্গেল সিট আর দুই ইঞ্জিনের ফাইটারটি উদ্ভাবন করেছে মস্কোর মিলিটারি ইঞ্জিনিয়াররা।

এটি একটি স্টেলথ ফাইটার। স্টেলথ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে সামরিক যানে রাডার, ইনফ্রারেড, রেডিও ফ্রিকেয়েন্সির খুব কম রিফ্লেকশন হয়। যে কারণে সহজেই শত্রæর নজর এড়াতে পারে এটি। গতি দিক থেকে এটি সুপারক্রুজ অর্থাৎ পরিপূর্ণ লোড অবস্থায়ও চলতে পারবে শব্দের চেয়ে বেশি গতিতে। দূর পাল্লার হাইপারসনিক মিসাইলসহ বিভিন্ন পাল্লার এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু সারফেস মিসাইল বহন করতে পারবে সু-ফিফটি সেভেন।

রাশিয়ার বিমান বাহিনীর সর্বাধূনিক এই ফাইটারটি এখনো ডেভলপমেন্টে পর্যায়ে রয়েছে। ২০১০ সালে এর পরীক্ষা মূলকউড্ডয়ন হয়েছে। চলতি বছর বিমানটি রুশ বিমান বহরে যোগ দেয়ার কথা রয়েছে। প্রতিটি সু-ফিফটি সেভেন ফাইটার জেটের নির্মাণ ব্যয় চার কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার।

আপাতত সু-ফিফটি সেভেনের পূর্ববর্তী সংস্করণ সু-থার্টিফাইভ রাশিয়ার সবচেয়ে আধুনিক যুদ্ধবিমান। যুদ্ধবিমানটির নির্মাতা রাশিয়ার কমসোমোলস্ক এয়ারক্রাফট প্রোডাকশন অ্যসোসিয়েশন। ১৯৮৮ সালে তৈরি সু-টুয়েন্টি সেভেন এম যুদ্ধবিমানকে আরো আধুনিক ও উন্নত করে তৈরি করা হয়েছে সু-থার্টিফাইভ। যেটি রুশ বিমানবাহিনীর বহরে যুক্ত হয়েছে ২০১৪ সালে। যার প্রতিটির নির্মাণ ব্যয় আনুমানিক ৪০ থেকে ৬৫ মিলিয়ন
মার্কিন ডলার।

এক সিট ও দুই ইঞ্জিনের বিমানটির সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। একবার জ্বালানি নিয়ে উড়তে পারে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার। আর হামলার সীমা ১৬ কিলোমিটার। বিমানটি আকাশ থেকে আকাশে, আকাশ থেকে মাটিতে এবং জাহাজ বিধ্বংসী মিসাইল বহন করতে পারে। আছে এন্টি রেডিয়েশন মিসাইল বহনের ক্ষমতা। চারশো কিলোমিটার দূর থেকেও এটি টার্গেট চিহ্নিত করতে পারে। এর রাডারের রয়েছে এক সাথে ৩০টি টার্গেট চিহ্নিতকরার ক্ষমতা।

সু-থার্টি ফাইভ সত্যিকার অর্থেই এক বিপজ্জনক ওয়ার মেশিন। সর্বোচ্চ উচ্চতায়ও সুপারসনিক গতিতে ছুটতে পারাই সু-থার্টিফাইভের সবচেয়ে বড় সুবিধা। আর এটি অপেক্ষাকৃত কম গতিতে ছুটলেও অন্যদের ধরার ছোয়ার বাইরে থাকার ক্ষমতা রাখে। এর রয়েছে থ্রি ডাইমেনশনাল থ্রাস্ট ভেক্টরিং পাওয়ার, তাই কম গতিতে ছোটার সময়ও অবিশ^াস্য রণকৌশল দেখাতে পারে।রয়েছে হেলমেট মাউন্টেট সিস্টেম যা পাইলটের হেলমেট তার চোখের সামনের ছোট্ট মনিটরে সব তথ্য হাজির করে। সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের সরকারের পক্ষে বিদ্রোহীদের ওপর হামলায় এই ফাইটারটি ব্যবহার করেছে রাশিয়া।

বর্তমানে ১২১টি সু-থার্টিফাইভ আছে রুশ বিমান বাহিনীতে।এছাড়া এর আছে এআইএম-নাইনএক্স এবং আর-সেভেনটি থ্রি বোরসাইট মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা। যেটি পারে না যুক্তরাষ্ট্রের এফ-থার্টিফাইভ। আবার দৃষ্টিসীমার মধ্য থেকেই লড়াইয়েও এই ফাইটার শত্রæবিমানকে ধ্বংস করতে পারে এফ-থার্টিফাইভ। এই বিমানের আরো দুটি পূর্ববর্তী সংস্করণ সু-থার্টি এবং সু-টুয়েন্টি সেভেন আছে রাশিয়ার। আর অ্যাটাক ফাইটার আছে সু-টুয়েন্টি ফাইভএসএম, সু-টুয়েন্টি ফোর এম ও সু-থার্টিফোর।

রুশ বহরে থাকা শতাধিক মিগ-টুয়েন্টি সেভেন ফাইটার এখন অনেকটাই সেকলে হয়ে গেছে। বেশ কয়েক দফা ক্রাশের পর এই এবিমানটির ওপর ভরসা হােিয় ফেলেছে রুশ বিমান বাহিনী। যে কারণে মিগ-টুয়েন্টি নাইনকে আরো আধুনিক করে বানানো হয়েছে মিগ-থার্টিফাইভ ফাইটার জেট।অবশ্য মিগ থার্টিফাইফেরও পূর্ণাঙ্গ বহর তৈরি করতে পারেনি এখনো। আপাতত ৪টি মিগ-থার্টিফাইভ আছে রাশিয়ার হাতে।

তবে আগামী দিনে আকাশে শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষে ৯ ধরনের ফাইটার জেট নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে রাশিয়ার। এর কোনটির প্রোটোটাইপ বা মডেল নির্মিত হয়েছে, কোনটির মূল বিমানের নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে। এছাড়া সর্বাধূনিক দুই প্রজাতির ফাইটার জেট নিয়েও গবেষণা শুরু করেছে মস্কোর মিলিটারি ইঞ্জিনিয়াররা।

রাশিয়ার আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বোম্বার টিইউ-ওয়ান সিক্সটি। সুপারসনিক গতি সম্পন্ন ও সুইপ উইংয়ের অধিকারী এই বোম্বারটি ছাড়াও রাশিয়ার আছে আরো তিন প্রজাতির শক্তিশালী বোম্বার। অ্যাটাক হেলিকপ্টারের মধ্যে রয়েছে কেএ-ফিফটি টু এলিগেটর। এটি এই মূহুর্তে বিশ্বের সেরা অ্যাটাক হেলিকপ্টার বলেই মনে করেন সামরিক বিশ্লেষকরা।

হেলিকপ্টার হলেও এতে যুক্ত করা হয়েছে ফাইটার জেটের অনেক বৈশিষ্ট।এটি ছুড়তে পারে অত্যাধুনিক ভিখার ও আটাকা ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী গাইডেড মিসাইল। এছাড়া আকাশ থেকে ভুমিতে নিক্ষেপযোগ্য কেএইচ টুয়েন্টি ফাইভ মিসাইল ও ৮০ মিলিমিটার আনগাইডেড এস-এইট রকেটও ছুড়তে পারে। এখানেই শেষ নয়- এলিগেটর ছুড়তে পারে কেএইচ-থার্টিফাইভ এন্টিশিপ মিসাইল। যা আঘাত হানতে পারবে ৮০ মাইল দূরে সাগরে ভাসমান যে কোন যুদ্ধজাহাজে। তবে মিগ থার্টি ফাইভের মতো এই এলিগেটরও খুব বেশি নেই রাশিয়ার কাছে।

আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়ও অনেক উন্নত হয়েছে রাশিয়া। আকাশ পথে শত্রæর হামলা রুখে দেয়া কিংবা শত্রুর আকাশ যানকে ধ্বংস করতে রাশিয়া তৈরি করেছে এস-ফোর হান্ড্রেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। যেটি টক্কর দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়টের সাথে।

এস-ফোর হান্ড্রেডকেই বিশ্বের সর্বাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। এটি একই সময়ে ৩৬টি লক্ষ্যবস্ততে আঘাত হানতে পারে, এমনকি একই সাথে ৭২টি রকেট ছুড়তে সক্ষম। এতে আছে একটি যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ পোস্ট, তিনটি জ্যাম-প্রতিরোধী অ্যারে রাডার, বিমানের লক্ষ্যমাত্রা শনাক্ত করার সেন্সর, আটটি বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র কমপ্লেক্স। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই অস্ত্রটি স্থাপন, প্রস্তত করা ও ফায়ার করা যায়। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেয়া যায়ও খুব সহজে।

এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের পরবর্তী সংস্করণ এস-ফাইভ হান্ড্রেড নিয়েও কাজ করছে রাশিয়া। আর এর পূর্ববর্তী আরো তিনটি সংস্করণ আছে তাদের ভাÐারে। এছাড়াও রাশিয়ার আছে এ-ওয়ান থার্টিফাইভ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, ফিফটি থ্রি টি সিক্সসহ আরো কয়েকটি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম।

ড্রোন প্রযুক্তিতে রাশিয়া পিছিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, চীনের মতো দেশগুলোর চেয়ে। তবে গত কয়েক বছরে তারা ড্রোন খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। রাশিয়ার ড্রোনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এস-সেভেনটি ওখোটনিক। এই ড্রোনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে এটি আকাশে উড্ডয়নরত সু-ফিফটি সেভেন ফাইটারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। ড্রোনটির রাডার ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে ফাইটারটি। যার ফলে শত্রæর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নজর এড়াতে সু-ফিফটি সেভেন ওই এলাকায় না ঢুকে ওখোটনিক ড্রোনকে পাঠাবে। আর ড্রোনের নজরদারির তথ্যের ভিত্তিতে দূর থেকেই হামলা করতে পারবে ফাইটারটি। ফাইটার থেকেই ড্রোনটি নিয়ন্ত্রণও করা যায়।

অপটিক্যাল ইলেকট্রনিক, রেডিও টেকনিক্যালসহ নজরদারির সর্বাধূনিক সব ব্যবস্থা আছে ওখোটনিক ড্রোনে। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে এই ড্রোনটিকে বলা যায় ষষ্ঠ প্রজন্মের ফাইটার জেটের প্রোটোটাইপ। সুপারসনিক মিসাইল ছুড়তে সক্ষম ড্রোনটি দুই হাজার কেজি পর্যন্ত গাইডেড ও আনগাইডেড গোলাবারুদ বহন করতে পারে। এছাড়া ওরিয়ান, থান্ডার, ওরলান থার্টি রাশিয়ার উল্লেখযোগ্য ড্রোন।

এর বাইরে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে রুশ কোম্পানিগুলো এমন কিছু ড্রোনের নকশা প্রদর্শন করেছে যা দেখে সামরিক বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, আগামী ১০ বছরের মধ্যে রাশিয়া ড্রোন সেক্টরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টেক্কা দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে