আমিরাত ও কাতারের সামরিক প্রতিযোগিতা

চাপের মুখেও টিকে গেছে কাতার - ইন্টারনেট

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৬ নভেম্বর ২০২০, ১৬:১৭

এক সময়ের শান্তির মধ্যপ্রাচ্যে এখন অস্থিরতা। অঞ্চলজুড়ে কূটনৈতিক টানাপোড়েন, সামরিক উত্তেজনা আর অস্ত্রের ঝনঝনানি। দেশগুলোও এখন সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় মেতেছে। কে কার আগে ফাইটার জেট, ক্ষেপণাস্ত্র কিনবে এই চিন্তা সবার।

মধ্যপ্রাচ্যের ছোট দুই প্রতিবেশ দেশ কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে সম্পর্ক এখন অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে খারাপ। আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার জেট কেনার চুক্তি করার পর কাতারও পেতে চাইছে কাতারও। বিডিভিউজ ইনফোটেইনমেন্টে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি সুরভি দিবা। আজ আমরা আলোচনা করবো কাতার ও আরব আমিরাত দুই প্রতিবেশী দেশের সামরিক শক্তির নানা দিক নিয়ে।

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অস্ত্র প্রতিযোগিতার প্রথম কারণ ছিলো অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল রাষ্ট্রের সাথে অন্য দেশগুলোর বৈরীতা। এরপর সেখানে যুক্ত হয়েছে ইরানের সাথে আরবদের টানাপোড়েন। তৃতীয় কারণ হিসেবে এসেছে আরব রাষ্ট্রগুলোর মাঝেই বিভক্তি।

কাতারের সাথে কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের বিরোধীতা এখন চরমে। এসব কারণে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে চলছে অস্ত্র প্রতিযোগিতা। আর তাতে কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। যে কোন পরিস্থিতিতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সবাই এখন পাল্লা দিয়ে কিনছে অস্ত্র।

আয়তনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাত ভাগের একভাগ কাতার। প্রভাব প্রতিপত্তির দিক থেকে আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যে দাপুটে দেশ। সৌদি আরবের সব চেয়ে ঘনিষ্ঠমিত্র দেশটি। অন্য দিকে সৌদি বলয়ের বাইরের দেশ কাতার অনেক দিন ধরেই এই বলয়ের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে। তবে ছোট্ট দেশ হলেও কাতার নিজের পায়ে দাড়ানোর মতো ক্ষমতা অর্জন করেছে। সেটি প্রমাণিত হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে কাতারের ওপর প্রতিবেশী দেশগুলোর অবরোধের পর থেকে। সামরিক শক্তিতেও বৃহৎ প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিতে চাইছে কাতার। বড় বড় কিছু চুক্তি করেছে বিশে^র সেরা অস্ত্র রফতানিকারক দেশগুলোর সাথে।

আয়তন ও প্রভাব প্রতিপত্তির মতো সামরিক শক্তির দিক থেকেও বড় পার্থক্য রয়েছে আমিরাত ও কাতারের মধ্যে। সামরিক শক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট গেøাবাল ফায়ার পাওয়ারের র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৩৮টি দেশের মধ্যে ২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবস্থান ৪৫ নম্বরে। দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৬৪ হাজার। এর মধ্যে সবাই সক্রিয় সদস্য, কোন রিজার্ভ সদস্য নেই। অন্য দিকে কাতার আছে ৯০ নম্বরে। সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা মাত্র ১২ হাজার। অবশ্য কাতারের মোট জনসংখ্যাও আমিরাতের চারভাগের একভাগ।

আমিরাতের স্থল বাহিনীর ট্যাঙ্ক আছে ৪৩৪টি, কাতারের আছে ৯২টি। সাঁজোয়া যান আমিরাতের ৮ হাজার ৬৯১টির বিপরীতে কাতারের ২৫০টি। সেল্ফ প্রোপেল্ড আর্টিলারি বা ভ্রাম্যমান কামান আমিরাতের ১৮৩টি, কাতারের ৪৬টি। টাউড আর্টিলারি বা অন্য যানবাহনের ওপর স্থাপনযোগ্য কামান সংখ্যা আমিরাতের ৭৬টি, কাতারের ১২টি। আর আমিরাতের ৭২টি রকেট প্রজেক্টরের বিপরীতে কাতারের আছে ১৫টি।

আমিরাতের বিমান বাহিনীতে ফাইটার জেট আছে ৯৮। এর মধ্যে বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-সিক্সটিন ও ফ্রান্সের তৈরি মিরেজ মাল্টিরোল ফাইটার। প্রশিক্ষণ বিমান ১৪৫টি, স্পেশাল মিশন পরিচালনার বিমান ১৭টি, অ্যাটাক হেলিকপ্টার ৩০টি। কাতারের ফাইটার জেট আছে ২৪টি। তাদেরও আছে মিরেজ এবং ফ্রান্সের তৈরি আলফা জেট ফাইটার। প্রশিক্ষণ বিমান ৩৫টি আর অ্যাটাক হেলিকপ্টার ৩টি। নৌ শক্তিতে দুটি দেশই বেশ দুর্বল। সাবমেরিন, ফ্রিগেট, ডেস্ট্রয়ার নেই কারো। আমিরাতের আছে ৯টি করভেটস আর ২টি মাইন বিধ্বংসী নৌযান। কাতারের আছে শুধু ৬৮টি পেট্রোল নৌ যান।

সংযুক্ত আরব আমিরাত ১৯৮৯ সালে তার অস্ত্র ভান্ডারে যুক্ত করেছে উত্তর কোরিয়া থেকে কেনা স্কুড-বি ব্যালেস্টিকক্ষেপণাস্ত্র। তিন বছর পর দেশটি আনে ফ্রান্সের লেকলার্ক ট্যাঙ্ক ও রাশিয়ার বিএমপি-থ্রি সাঁজোয়া যান। অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে এক দেশের ওপর নির্ভরতা ইরানকে যে বিপদে ফেলেছিল তার থেকে শিক্ষা নিয়ে ৯০এর দশকে আমিরাত একাধিক দেশের থেকে অস্ত্র কেনা শুরু করে। রুশ নির্ভরতা থেকে বেড়িয়ে আসতে তারা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউক্রেন, ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানি থেকে অস্ত্র কেনা শুরু করে। আবার কেনা অস্ত্রগুলোকে আধুনিকায়ন করতেও প্রচুর বিনিয়োগ করে দেশটি।

এ সময় আমিরাত আরেকটি প্রোগ্রাম হাতে নেয় যেটিকে বলা হত এমিরাটাইজেশন। অর্থাৎ এক সময় দেশটির বিমান বাহিনীতে বিদেশী দক্ষ পাইলটদের নিয়োগ দেয়া হলেও এই কর্মসূচির আওতায় দেশী পাইলট ও মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা হয়। এখন আমিরাতের নাগরিক ছাড়া কেউ নেই এসব পদে। ২০০৮ সালে তাদের হাতে আসে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্রের এমআইএম-ওয়ান জিরো ফোর ভার্সন। একই সাথে এর রাডার সিস্টেমসহ প্যাট্রিয়টের সাপোর্টিভ সব সিস্টেমই আসে আবুধাবিতে। এছাড়া প্যাট্রিয়টের পূর্বসূরী হিসেবে পরিচিত হক মিসাইল সিস্টেমও আছে তাদের ভান্ডারে।

২০১১ সালে হরমুজ প্রণালীতে ইরানের সাথে উত্তেজনার পর আমিরাত ক্ষেপণাস্ত্র খাতে সাড়ে তিনশ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পদক্ষেপ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের বহুল আলোচিত থাড ক্ষেপণাস্ত্র সবার আগে হাতে পেতে যাচ্ছে আমিরাত। এই থাড এতটাই শক্তিশালী যে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় এটি মোতায়েন করতে চাইলে বাধা দিয়েছিল চীন। টার্মিনাল হাই অলটিচ্যুড এরিয়া ডিফেন্স সিস্টেম বা থাড পেতে আমিরাতকে খরচ করতে হচ্ছে প্রায় দুইশো কোটি মার্কিন ডলার। এছাড়া আছে নিজস্ব তৈরি জোবাইর মাল্টিপল রকেট লঞ্চার।

সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দেশে তৈরিতেও কিছু উদ্যোগ নিয়েছে আমিরাত। দেশের মাটিতেই তারা নৌ বাহিনীর জন্য ৫-৬টি করভেটস বানানো শুরু করেছে। এছাড়া ড্রোন, অ্যামিউনিশন ও সমারিক যান শিল্প গড়ে তুলছে তারা। তবে আমিরাতের সাথে শক্তিমত্তার এই ব্যবধান কাতার যে দ্রæত ঘোচাতে চাইছে তার প্রমাণ দুই দেশের সামরিক বাজেটের দিকে চোখ দিলেই বোঝা যাবে।

আমিরাতের বার্ষিক সামরিক বাজেট ২ হাজার ২৭৫ কোটি মার্কিন ডলার। আর কাতারের সেটি ৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ইতোমধ্যেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ ১২টি মাঝারি পাল্লার থাড ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার চুক্তি করেছে। এজন্য কাতার খরচ করছে সাড়ে ছয়শো কোটি মার্কিন ডলার।

ফ্রান্সের বহুল আলোচিত মাল্টিরোল ফাইটার রাফালে ১৫টি আছে কাতারের। এর আরো ২৬টি বিমান কেনার চুক্তি করেছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের এফ-ফিফটিন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৈরি ইউরোফাইটার টাইফুনও হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছে দোহা। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধূনিক প্যাট্রিয়ট মিসাইলও কাতারের হাতে আসার অপেক্ষায়। এছাড়া জার্মানির কাছ থেকে ৬২টি লিওপার্ড ২ ট্যাঙ্ক ও ২৪টি কামান কেনার চুক্তি করেছে দেশটি। এছাড়া দেশটির কাছে আছে ফ্রান্সের তৈরি এএমএক্স-৩০ ট্যাঙ্ক। আরো আছে সারফেস টু এয়ার মিসাইল ব্যবস্থা।

আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অবশ্য আমিরাতের চেয়ে অনেকটা এগিয়েই আছে কাতার। তাদের আছে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্রিঞ্জার, ফ্রান্সের মিস্ট্রাল, ব্রিটেনের ব্লোপাইপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাম স্যাম। এর সবগুলোই সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম। কাতারের বিমান বাহিনীতে আছে ফ্রান্সের চতুর্থ প্রজন্মের ফাইটার জেট মিরেজ টু থাউজেন্ড। আছে ফ্রান্সের আলফা জেট । এছাড়া ফ্রান্সের টাইগার রাডার ও ব্রিটেনের বানাশি ড্রোনও আছে কাতারের।

কাতারে আছে যুক্তরাষ্ট্রের বড় একটি সামরিক ঘাঁটি। আল উদেইদ নামের ওই বিমান ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি আছে ব্রিটেন বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান ও সেনা সদস্যরা। ঘাঁটিতে শুধু মার্কিন সেনাই আছে ১০ হাজারের বেশি। এছাড়া তুরস্কের একটি সামরিক ঘাঁটিও আছে কাতারে। সেখানে মোতায়েন আছে ৩ হাজার তুর্কি সেনা। বিদেশী সেনাদের এই উপস্থিতি কাতারের জন্য একটি বড় রক্ষাকবচ।

কাতার ও আরব আমিরাত দুই রাষ্ট্রের মধ্যে আছে সমরাস্ত্র কেনার নানামুখি প্রতিযোগিতা। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত পঞ্চম প্রজন্মের এফ-থার্টি ফাইভ মাল্টিরোল স্টেলথ ফাইটার কেনার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে আরব আমিরাতের জন্য। ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার পুরস্কার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র রাজি হয়েছে আমিরাতকে এই ফাইটার দিতে। যদিও ইসরাইলই আবার এই যুদ্ধ বিমান কেনার ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছে।

সমীকরণ বলছে, ইসরাইল রাজি না থাকলে মধ্যপ্রচ্যের কোন দেশকে সমরাস্ত্র দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। তাই আমিরাত এটি পাবে কিনা তা বুঝতে হলে অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছুদিন। তবে সেই অপেক্ষার তর সইছে না কাতারের। তারাও এফ-থার্টিফাইভ কেনার প্রস্তাব দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনকে।

সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মেরুকরণে আমিরাত ইসরাইলের দিকে ঝুঁকেছে আর কাতার ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে তুরস্কের। ইরানের সাথেও সুসর্ম্পক বজায় রেখে চলছে। ইসরাইল অবশ্য আমিরাতকে অস্ত্র দেবে কিনা সেটি জটিল প্রশ্ন, কারণ আরব রাষ্ট্রগুলো শক্তিশালী হোক সেটি তেল আবিব কখনো চায় না।
অন্যদিকে কাতারকে যে তুরস্ক সহযোগিতা করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারন উপসাগরীয় এলাকায় তুরস্কের সামরিক ঘাটি স্থাপনের সুযোগ দিয়েছে কাতার। ২০১২ সালেই নিজস্ব উদ্ভাবিত ড্রোন কাতারের কাছে বিক্রি করেছে আঙ্কারা। কাতারের নৌ বাহিনী আধুনিকায়নের চেষ্টা করছে তুরস্ক। দেশটির সেনাবাহিনীর নিবিড় প্রশিক্ষনের সাথে জড়িত আছে তুরস্ক। দেড় হাজার সাঁজোয়া যান কেনার বিষয়ে একটি তুর্কি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করেছে দোহা।

তুরস্ক তার মিত্রকে কতটা সহযোগিতা করে তার প্রমাণ এবার পাওয়া গেছে আজারবাইজান-আর্মেনীয়া যুদ্ধের সময়। আজারবাইজানের অভিযানে ব্যবহৃত হয়েছে তুরস্কের সর্বাধুনিক বেরাকতার ড্রোন। রাডারকে ফাঁকি দিতে সক্ষম এই ড্রোন টার্গেটে হামলা করতে পারে নিখুতভাবে। ইতোমধ্যে ড্রোনসহ তুরস্কের নানা ধরনের প্রযুক্তি পেয়েছে কাতারের সেনাবাহিনী। আবার গোপনে ইরানের কাছ থেকেও সামরিক সহযোগিতা নেবে না কাতার সে কথা কেউ বলতে পারে না।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে