আজারবাইজানে যখন উৎসব, আর্মেনিয়া তখন বিক্ষোভে উত্তাল

নাগরনো-কারাবাখ চুক্তির পর পতাকা হাতে সেলিব্রেশন করতে সড়কে নেমে আসে আজারি জনতা - রয়টার্স

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১৪ নভেম্বর ২০২০, ১৪:০৬

নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজনের যুদ্ধের অবসান ঘটেছে। উভয় দেশ এক যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে আর্মেনিয়ার সুস্পষ্ট পরাজয় ঘটলো। অপরদিকে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে স্বীকার করেছেন যে, 'বেদনাদায়ক' এক যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের মাঝ দিয়ে আর্মেনিয়া এ যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করে নিলো।

আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ফেসবুকে দেয়া তার বিবৃতিতে লিখেছেন, কারাবাখে যুদ্ধ অবসান সংক্রান্ত এক চুক্তিতে রাশিয়া ও আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টদ্বয়ের সাথে আমিও সই করেছি, যা ব্যক্তিগতভাবে আমার এবং আমার দেশবাসীর জন্য ''বর্ণনাতীত রকমের বেদনাদায়ক''। আমার এবং সকলের জন্যই এ সিদ্ধান্তটি ছিল কঠিন।

আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ বলেছেন, এ চুক্তির মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে হয়ে গেলো যে আর্মেনিয়া হেরে গেছে। ২৪ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আমাদের সৈন্যরা প্রায় ৩০০টি এলাকা আর্মেনিয়ার দখল থেকে মুক্ত করে। আমাদের এ বিজয় আর্মেনীয় বাহিনীর শিরদাঁড়া ভেঙ্গে দেয়।

ওই এলাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার আগে একটু পেছন ফেরা যাক। দেখা যাক দুই প্রতিবেশীর এ যুদ্ধের উৎস কোথায়।

১৯২১ সালে নাগোর্নো-কারাবাখ এলাকাটি আজারবাইজানের হাতে তুলে দেন তৎকালীন সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিন। সমস্যার শুরু সেখান থেকেই। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয় আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান এবং তখন থেকেই নাগোর্নো-কারাবাখ দখলের প্রতিযোগিতায় নামে উভয় দেশ।

নাগোর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান প্রথম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে গত শতাব্দীর '৯০এর দশকে। সেই যুদ্ধে আজারবাইজানের বেশ-কিছু এলাকা দখল করে নেয় আর্মেনিয়া। ১৯৯৪ সালে দু' দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়। কিন্তু আর্মেনিয়ার কাছে ভূখণ্ড হারানোর বেদনা ভুলতে পারে না আজারবাইজান। সর্বশেষ যুদ্ধ তারই বহিঃপ্রকাশ। নইলে এমন ঘাতক মহামারী চলাকালে কোনো দেশ যুদ্ধে জড়ায়?

আবার ফেরা যাক বর্তমানে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি প্রসঙ্গে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ বলেছেন, আর্মেনিয়া এ চুক্তিতে নিজের ইচ্ছায় সই করেনি, করেছে আমাদের বজ্রমুঠোয় আটকা পড়ে। এখন চুক্তি অনুসারে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে কালবাজার, ২০ নভেম্বরের মধ্যে আগদাম এবং ১ ডিসেম্বরের মধ্যে লাচিন জেলা আজাররবাইজানের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে আর্মেনিয়ার।

তিনি জানান, নাগোর্নো-কারাবাখ কনট্যাক্ট লাইন এবং লাচিন করিডর বরাবর এক হাজার ৯৬০ জন সৈন্য এবং ৯০টি সাঁজোয়া যান মোতায়েন করবে রাশিয়া। এ ছাড়া এ অঞ্চলের জন্য রাশিয়া ও তুরস্কের সমন্বয়ে একটি যৌথ শান্তিরক্ষা মিশনও গঠন করা হবে বলেও ঘোষণা দেন আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ।

এর পরপরই রাশিয়ার উলিয়ানভস্ক-ভস্তস্নি বিমানবন্দর থেকে একদল সেনা এবং বেশ-কিছু সামরিক যানবাহন নিয়ে ওই এলাকার দিকে যাত্রা করে ১০টি রুশ পরিবহণ বিমান। রুশ শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করবে রাশিয়ার সেন্ট্রাল মিলিটারি ডিভিশনের ১৫টি মোটর অ্যান্ড রাইফেল পিসকিপিং ডিভিশন।
এদিকে আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধজয়ে উৎসবের আবহ নেমে আসে আজারবাইজানের রাজধানী বাকু-তে। হাজার হাজার মানুষ আজারবাইজান ও তুরস্কের পতাকা নিয়ে রাজপথে নেচে গেয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে। এ সময় অনেককে খুশিতে কেঁদে ফেলতেও দেখা যায়। কাউকে দেখা যায় গান করতে, আবার কেউ-কেউ জাতীয় সঙ্গীতও গাইতে থাকে।

একই দৃশ্য দেখা যায় আজারবাইজানের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর গাঞ্জায়। ওই নগরীর প্রধান চত্বরে আজারবাইজান ও তুরস্কের পতাকা হাতে সমবেত হয় হাজার হাজার উৎফুল্ল মানুষ।

কেন এ উল্লাস - সাংবাদিকরা জানতে চাইলে উৎসবে অংশগ্রহণকারী এক ব্যক্তি বলেন, করবোই তো! দীর্ঘ ২৮ বছর পর আমরা আমাদের দেশের হারানো কিছু ভূখণ্ড ফিরে পেতে যাচ্ছি।

উৎসবে এসেছেন তো তুরস্কের পতাকা এনেছেন কেন - জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি বলেন, আজারবাইজান ও তুরস্ক দুই দেশ, কিন্তু এক জাতি। দুই দেশ ভাই ভাই। এ লড়াইয়ে আমরা দুই দেশই জয়ী হয়েছি।
এদিকে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ে আজারবাইজানকে অভিনন্দন জানিয়েছে তুরস্কও। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসগ্লো বলেন, আমাদের প্রিয় ভাই আজারবাইজান যুদ্ধের ময়দান এবং আলোচনার টেবিল দু' জায়গাতেই তাৎপর্যপূর্ণ বিজয় অর্জন করেছে। তাঁদের এ বিজয়কে আমি অন্তর থেকে স্বাগত জানাই। আজারবাইজানী ভাইদের সাথে আমরা এক জাতি, এক আত্মা হয়েই থাকবো।
তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় টুইটারে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেছে, ৩০ বছরের যন্ত্রণার আজ অবসান ঘটতে চলেছে। আমাদের বীর ভাইয়েরা রণাঙ্গনে তাঁদের শক্তিমত্তা দেখিয়েছে এবং বীরের মতো লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। দুঃসময় শেষ হয়েছে, আজ বিজয়ের দিন।

আজারবাইজান যখন উৎসবে মাতোয়ারা, আর্মেনিয়া তখন বিক্ষোভে উত্তাল। পরাজয় স্বীকার করে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের বিবৃতির পরই দেশটির রাজধানী ইয়েরেভ্যানের রাজপথে নেমে আসতে থাকে ক্ষুব্ধ জনতা। তারা একটি সরকারি ভবনের সামনে সমবেত হয়, ঢিল ছুঁড়ে ভবনের জানালা ভেঙে ফেলে এবং প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। তাদের কয়েকজন এমনকি প্রধানমন্ত্রীর দফতরেও ঢুকে পড়ে এবং তাঁকে পদত্যাগের আহবান জানায়।

স্থানীয় পত্রপত্রিকার খবরে বলা হয়, রাত বাড়ার সাথে সাথে বিক্ষোভকারীর সংখ্যা কমে আসে। তবে কিছু বিক্ষোভকারী পার্লামেন্ট ভবনে অবস্থান নেয়। তারা পার্লামেন্টের স্পীকার আরারাত মিরযোইয়ানের ওপর হামলা চালায় এবং তাকে মারধর করে।

এবার দেখা যাক কী আছে সেই চুক্তিতে, যা কারো জন্য বয়ে এনেছে খুশির বন্যা আর কারো জন্য হয়েছে বিষাদ সিন্ধু।

রাশিয়ার নেতা পুতিন জানান, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া উভয় দেশই এখন যে যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। বাস্তুহারা ও শরণার্থীরা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার অধীনে নাগোর্নো-কারাবাখ ও সংলগ্ন এলাকায় ফিরে যাবেন। এ কাজে পরিবহণ ও যোগাযোগ কার্যক্রমে সহায়তা করবে রাশিয়ার সীমান্তরক্ষী বাহিনী।

তিনি আরো জানান, যুদ্ধবিরতি চুক্তি এমন পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যাতে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতি রেখে নাগোর্নো-কারাবাখ সমস্যার একটা একটি ন্যায্য, স্থায়ী ও সুস্পষ্ট মীমাংসায় উপনীত হওয়া যায়।

নাগোর্নো-কারাবাখ আর্মেনিয়া তার ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে আজারবাইনকে তাদের ছিটমহল নাখচিভানে যেতে দেবে।

বিক্ষোভে উত্তাল আর্মেনিয়া। চুক্তির প্রতিবাদ জানাতে হাজার হাজার জনতা নেমে আসে সড়কে। ছবি : এপি
বিক্ষোভে উত্তাল আর্মেনিয়া। চুক্তির প্রতিবাদ জানাতে হাজার হাজার জনতা নেমে আসে সড়কে। ছবি : এপি

 

এবার দেখা যাক, ২৬ বছর আগে আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধে হেরে যাওয়া আজারবাইজান এবার কিভাবে সহজে জয়ী হলো। ২৬ বছরের দীর্ঘ সময়ে অর্থনৈতিক ও সামরিক - উভয় ক্ষেত্রেই আর্মেনিয়াকে অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে আজারবাইজান। তাদের আছে তেল-গ্যাসের মতো মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। তেল রফতানির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে দেশটি। আর এর প্রভাব পড়েছে সামরিক খাতেও। তাঁদের সামরিক ব্যয় আর্মেনিয়ার কয়েক গুণ বেশি। জঙ্গি বিমান, ট্যাংক, আর্টিলারি - সব দিক থেকেই আর্মেনিয়ার চাইতে এগিয়ে আছে আজারবাইজান। সামরিক দিক থেকে আজারবাইজানকে ডিঙ্গিয়ে যাওয়া অন্তত এ মুহূর্তে আর্মেনিয়ার পক্ষে অসম্ভব।

এ যুদ্ধ আর্মেনিয়ার সাথে আজারবাইজানের হলেও এতে জড়িয়ে পড়েছে আরো কয়েকটি দেশ। যুদ্ধে সরাসরি আজারবাইজানের পক্ষ নিয়েছে তুরস্ক। আবার আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান - দুই দেশের মধ্যে কোনটির পক্ষে যাবে তা নিয়ে উভয়সঙ্কটে ছিল রাশিয়া। কারণ, উভয় দেশের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করে থাকে রাশিয়া। আবার কারাবাখ অঞ্চলটি ইরানের সীমান্ত সংলগ্ন। কিন্তু আজারবাইজান একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হলেও তাদের 'ধর্মনিরপেক্ষ' নীতির কারণে ইরানের সাথে সম্পর্ক শীতল। মিডিয়া বলেছে, ইরান এ যুদ্ধে গোপনে সমর্থন দিয়েছে খ্রিস্টান অধ্যুষিত আর্মেনিয়াকে।
সত্যি, রাজনীতির চলার পথ কতোই না বিচিত্র!

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে