কী পরিমাণ ভূমি উদ্ধার করেছে আজারবাইজান

নাগরনো-কারাবাখে আগুন নিয়ে খেলছে আর্মেনিয়া - ডেইলি সাবাহ

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৩ অক্টোবর ২০২০, ১৪:১৭

আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধ দুই সপ্তাহ পার হয়েছে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বিরতি হলেও তা কার্যকর হয়নি। এই যুদ্ধে আর্মেনীয়া হারিয়েছে অনেক সেনা ও সামরিক যান। সেই সাথে উপর্যুপুরি হামলায় তারা বাধ্য হয়েছে অনেকটা অঞ্চলের দখল ছাড়তে। তিনটি শহরে উড়েছে আজারবাইজানের পতাকা।

আর্মেনীয় সেনাদের উস্কানিমূলক হামলার মধ্যদিয়ে গত ২৭ সেপ্টেম্বর যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার জন্য বড় মাশুলই দিতে হয়েছে তাদের। আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ওইদিন স্থানীয় সময় ভোর ছয়টার দিকে আর্মেনীয়রা লাইন অব কন্ট্রোলের ওপার থেকে গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে।এরপর দ্রুত সময়ে আজারবাইজানের সৈন্যরাও পাল্টা হামলা শুরু করে।

আর্মেনীয় বিনা উস্কানিতে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কোনো কোনো খবরে অবশ্য বলা হয়েছে, আর্মেনীয়ার গোলায় আজারবাইজানের দুটি সামরিক হেলিকপ্টার ভূপাতিত হওয়ার কারণেই যুদ্ধের সূত্রপাত। এদিন উভয় পক্ষই সীমান্ত এলাকায় মার্শাল ল’ জারি করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভে তার সৈন্যদের যুদ্ধে নামার নির্দেশ দেন। সামরিক ভাষায় যেটিকে বলা হয় মিলিটারি মবিলাইজেশন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সীমান্তে ট্যাঙ্ক, কামান, ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে।

প্রথমদিন বিকেলেই আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়- তারা ৭টি গ্রাম আর্মেনীয় সেনাদের দখল থেকে মুক্ত করেছে। গ্রামগুলো হলো গারাখানবাইলি, গারভান্দ, হোরাদিজ, ইউজারি, আসাগি, বয়উক মারজানলি ও নুজগার। একই দিন আর্মেনীয়ার একটি সেনা পোস্ট সারেন্ডার করেছে বলেও জানা যায়। আর্মেনীয়া অবশ্য এই দাবি প্রত্যাখান করেছে। এছাড়া নাগোরনো-কারাবাখের সাথে আর্মেনীয়ার মূলভ‚খন্ডের সংযোগ স্থাপনকারী ভারদেনিস-মারতাকের্ত মহাসড়ক দখলের কথাও জানায় আজারবাইজান।

যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন সকালে আর্মেনীয়ার তিনটি সামরিক যান ধ্বংস করার ভিডিও প্রকাশ করে আজারবাইজান। অন্য দিকে আর্মেনীয়া দাবি করে কিছু এলাকা পুণর্দখলের। দুপুরের আগে যুদ্ধের আরেকটি ভিডিও প্রকাশ করে আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায় তারতার জেলার তালিস এলাকা ও এর পাশ^বর্তী গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্বতের চূড়া মুক্ত করার কথা।

আর্মেনীয়রা দাবি করে আজারবাইজানের ড্রোন ভূপাতিত করার। আজারবাইজান আবারো জোড়ালো আক্রমণের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে। যাতে ধ্বংস হতে দেখা যায় আর্মেনীয়ার কিছু সামরিক সরঞ্জাম। এরপর থেকে ড্রোন হামলা শুরু করে আজারবাইজান। তুরস্কের বেরাকতার ও ইসরাইলের হারোপ ড্রোনের একের পর এক হামলা সুযোগ করে দেয় স্থলসেনাদের অগ্রসর হওয়ার। আকাশ থেকে ড্রোন হামলা আর নিচে কামান ও রকেটের গোলায় দিশেহারা হয়ে পড়ে আর্মেনীয় সেনা ও নাগোরনো-কারাবাখের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা।

এবারের যুদ্ধে আজারবাইজানের ড্রোন হামলার ক্ষমতা দেখে চমকে গেছেন অনেক পর্যবেক্ষকই। ইসরাইলের হারোপ আর তুরস্কের বেরাকতার টিবি-টু ড্রোন দেখা গেছে আজেরি বহরে। বিশেষ করে বেরাকতার ড্রোনের ব্যবহার নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই ড্রোন চিহ্নিত করা বা ভূপাতিত করা খুবই কঠিন। এটি টার্গেটে হামলাও করতে পারে নিখুঁতভাবে।

বিবিসির রুশ সাংবাদিক পালেভ আক্সেনভ এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, ড্রোনের বাজারে টিবি-টু একটি তারকা। এ বছরের ফেব্রæয়ারিতে সিরিয়ায় অপারেশন স্প্রিং শিল্ড অভিযানে এই ড্রোন ব্যবহার করেছিল তুরস্ক। এর আগে লিবিয়ায় খলিফা হাফতারের বিদ্রোহী বাহিনী লক্ষ্য করে চালানো অভিযানেও তুরস্ক এই ড্রোন ব্যবহার করেছে।

যদিও আজারবাইজান সরাসরি বেরাকতার ড্রোন ব্যবহারের কথা স্বীকার করেনি। তুরস্কের কাছ থেকে তাদের এই ড্রেনা কেনারও কোন রেকর্ড নেই। তবে আজারবাইজান তাদের হামলার যেসব ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে সেগুলো বেরাকতার টিবি-টু ড্রোন দিয়ে ধারণ করা হয়েছে বলে সামরিক এক্সপার্টদের ধারণা। তাছাড়া হামলায় আর্মেনীয় সেনাদের দুর্দশা দেখেও তুরস্কের এই অত্যাধুনিক ড্রোনের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার আজারবাইজানের সাথে তুরস্কের ঘনিষ্ঠতাও এই ধারণাটিকে জোরদার করেছে।

প্রতিরক্ষা বিষয়ক রুশ ম্যাগাজিন আর্মস এক্সপোর্টের প্রধান সম্পাদক আন্দ্রেই ফ্রলভ মনে করেন, আজারবাইজান হয় গোপনে এই চালকবিহীন বিমান মজুত করছিল, না হয় সা¤প্রতিক এই লড়াই শুরু হবার ঠিক আগেই এগুলো তাদের হাতে এসেছে।

ড্রোন হামলার সহায়তা নিয়ে ২ অক্টোবর থেকে আজারি সেনারা দ্রুত প্রবেশ করতে থাকে আর্মেনীয় নিয়ন্ত্রিত ভূখন্ড। মাদাগিজ শহরের কাছে পৌছে যায় তারা। পরদিন আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ ঘোষণা করেন তাদের সৈন্যরা মাদাগিজ শহর পুনরোদ্ধার করেছে। টুইটার পোস্টে তিনি জানান, মাদাগিজ শহরে আজারবাইজানের পতাকা উত্তোলন করেছে সৈন্যরা। এর কিছুক্ষণ পর আলিয়েভ জানান, মাদাগিজ শহরটিকে তার পুরনো শুগোভুশান নামে নামকরণ করা হয়েছে।

এরপর আজারি বাহিনীর বিজয়ে ধারা চলতেই থাকে। পরদিন তারতার জেলার ৫টি ও ফিজুলি জেলার ১টি গ্রাম পুনরুদ্ধার করার খবর জানান আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট। এরপর আর্মেনিয়ার দখল থেকে জাবরাইল শহর ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রাম মুক্ত করে আজরবাইজান। একই দিন আরেকটি ফ্রন্টে জেলার কয়েকটি পাহাড়ি বসতি আসে আজরবাইজানের নিয়ন্ত্রণে।

যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলের ২২টি বসতির নিয়ন্ত্রণ নেয় আজারবাইজান।এছাড়া পশ্চিমাঞ্চলীয় আগদেরে প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকা মুক্ত করে। একই সময়ে কিছু পর্বতের চূড়ারও নিয়ন্ত্রণ নেয় আজারবাইজানের সৈন্যরা। এছাড়া ৫টি সাজোয়া যান ধ্বংস করা হয়।

আজারবাইজনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৯ অক্টোবর এক বিবৃতিতে জানায়া, সেরাইল শহরের উত্তরাঞ্চলে একটি পাহাড়ি বসতি ও বেশ কয়েকটি গ্রাম আর্মেনীয় দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করেছে তাদের সেনারা।একই দিন আজেরি সৈন্যদের আরেকটি ইউনিট ফালুজি জেলার হাদরুত এলাকাটি মুক্ত করে।
যুদ্ধের দুই সপ্তাহে আর্মেনীয়া শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই নিজেদের সৈন্য আর অঞ্চল রক্ষায় ব্যস্ত ছিলো। আজেরি সৈন্যদের আকাশ ও স্থল হামলার মুখে অনেক জায়গা থেকেই তাদের পিছু হটতে হয়েছে। এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা পর্যন্ত আজেরি সৈন্যরা ঠিক পরিমাণ এলাকা পুণর্দখল করেছে সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোন হিসাব দেয়নি। তবে আর্ন্তজাতিক গনমাধ্যমের সংবাদ বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, মাদাগিজ, তালিস, জাবরাইল শহর এবং গ্রাম ও পাহাড়ি বসতি মিলে ৩৪টি এলাকা আজারবাইজানের নিয়ন্ত্রণে এসছে। এছাড়া মুরোবদাগসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পবর্ত চূড়ায়ও এখন উড়ছে আজরবাইজানের পতাকা।

নাগোরনো-কারাবাখের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্বঘোষিত সরকার পরোক্ষভাবে এলাকা হারানোর কথা স্বীকার করেছে। তবে তারা বলেছে, কিছু এলাকা থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়েছে কৌশলগত কারণে।
যুদ্ধের প্রথম দুই সপ্তাহে আর্মেনিয়া হারিয়েছে অন্তত ২৫০টি ট্যাঙ্ক ও সাজোঁয়া যান, ১৫০টি অন্যান্য সামরিক যান, ১১টি সেনা কমান্ড ও অবজারভেশন পোস্ট, ২৭০টি কামান, ৬০ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা যার মধ্যে আছে এস-থ্রি হান্ড্রেড ও নাইন-কে ওসাস। ধ্বংস হয়েছে অন্তত ৮টি গোলাবারুদের গুদাম।

অন্যদিকে আর্মেনিয়া ভূপাতিত করেছে দুটি আজেরি সামরিক হেলিকপ্টার, তবে তার পাইলটরা নিরাপদে অবতরণ করতে পেরেছেন নিজেদের মাটিতেই। এছাড়া তাদের ১০টি ট্যাঙ্ক ও ১৫টি ড্রোন ধ্বংস করার দাবি করেছে আর্মেনিয়া। এছাড়া চারটি আজেরি বোম্বার জেট ভূপাতিত করারও দাবি করেছে আর্মেনীয়া, যদিও এই দাবির স্বপক্ষে কোন প্রমাণ দিতে পারেনি তারা।

আজারবাইজানের হামলায় বাঙ্কারে লুকিয়ে থেকেও রক্ষা পাননি আর্মেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শীর্ষ নেতা আরায়িক হারুতানিয়ান। মারাত্মক আহত হয়েছেন তিনি। আর সেনা হতাহতের সঠিক সংখ্যা নিয়ে আছে বিভ্রান্তি। এখন পর্যন্ত তারা ৪০৪ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করলেও আজারবাইজান বলছে, তাদের হামলায় ৩ হাজারের বেশি বিচ্ছিন্নতাবাদী ও আর্মেনীয় সৈন্য নিহত হয়েছে।

আজেরি সৈন্যদের হামলায় টিকতে না পেরেই আর্মেনীয়া কৌশল পাল্টায়। হামলা শুরু করে আজারবাইজানের বেসামরিক এলাকা লক্ষ্য করে। গানজা, তারতার, বারদাসহ বেশ কয়েকটি শহর লক্ষ্য করে হামলা চালায় তারা। এতে বেশ কিছু বেসামরিক লোক হতাহত হয়েছে। এছাড়া বাকু-তিবলিস-চেহান আন্তর্জাতিক তেল পাইপলাইন লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে আর্মেনীয়া। বিশ্লেষকরা বলছেন, মুখোমুখি লড়াইয়ে টিকতে না পেরেই আর্মেনীয়া বেসামরিক লোকদের ওপর হামলার পন্থা নিয়েছে। এর মধ্যেমে তারা যুদ্ধের মোড় অন্যদিকে ঘুড়িয়ে দিতে চেয়েছে।

রাশিয়ার সাথে যে ছয়টি দেশের প্রতিরক্ষা সহায়তা বিষয়ক চুক্তি রয়েছে তার একটি আর্মেনীয়া। রাশিয়া আগেই বলেছে, নাগোরনো-কারাবাখের যুদ্ধ তাদের সেই চুক্তির আওতায় পড়বে না। তাই রাশিয়া এই যুদ্ধে আর্মেনিয়ার পক্ষ হয়ে লড়াই করবে না। কিন্তু আজারবাইজান যদি আর্মেনীয়ার মূল ভ‚খÐে হামলা চালায় তাহলে রাশিয়া তাদের রক্ষায় মাঠে নামতে পারে। আর্মেনীয়া সম্ভবত সেটাই চাইছে। কোনভাবে রাশিয়াকে যুদ্ধের মাঝখানে টেনে আনতে পারলে ফলাফল তাদের পক্ষে যাবে বলেই ভাবছে আর্মেনীয়ার সরকার। দেশটিতে রয়েছে রাশিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটি।

কিন্তু মধ্য এশিয়ার স্ট্রংম্যান ইলহাম আলিয়েভের দেশ সেই ভুল করেনি। তারা একটি বারের জন্যও আর্মেনীয়ার মূল ভূখন্ডে হামলা চালায়নি। আবার নাগরনো-কারাবাখের বেসামরিক এলকায়ও হামলা করেনি। আলিয়েভ বারবারই বলেছেন, আজারবাইজান তার ভূখন্ড থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করতে চায়। অন্য কোন উদ্দেশ্যে তারা যুদ্ধে নামেনি। শেষ পর্যন্ত সেই কথাতেই অটল থাকতে পেরেছে তার দেশের সামরিক বাহিনী। যে কারণে এই যুদ্ধকে অন্য দিকে টেনে নিতে পারেনি আর্মেনীয়া।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে