কোন কৌশলে জয় পাচ্ছে আজারবাইজান

নাগরনো-কারাবাখে নিজের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের পাশ দিয়ে হাঁটছেন একজন - এএফপি

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২২ অক্টোবর ২০২০, ১৫:২৯

আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দু'টি দেশ পাকিস্তান ও ভারতের সম্পর্ক যেমন চিরবৈরী, মধ্য এশিয়ায় আজারবাইজানের সাথে আর্মেনিয়ার সম্পর্কও তেমনই। গত দশকজুড়ে তারা তাদের সশস্ত্র বাহিনীগুলোকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছে এবং এখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এবারের যুদ্ধ কৌশলে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা।

আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া দেশ-দু'টি এখন যেমন পরস্পরের সাথে লড়ছে, '৯০এর দশকেও তেমনই যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। ওই যুদ্ধে উভয় পক্ষের কয়েক লাখ মানুষ নিহত হয় এবং লাখ-লাখ মানুষ হয় বাস্তুহারা। ওই যুদ্ধে টিকে থাকতে পারেনি আজারবাইজান। আর্মেনীয় বাহিনী সে-সময় আজারবাইজানের বেশ-কিছু এলাকা দখল করে নেয়। এর মধ্যে দক্ষিণে ইরান সীমান্ত সংলগ্ন দু'টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ফুজুলি ও জাব্রাঈলও রয়েছে। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ অঙ্গীকার করেছেন দখল হয়ে যাওয়া এসব এলাকা আবার আজারবাইজানে ফিরিয়ে আনার।

আজারবাইজানের সাথে তাদের প্রতিবেশী বন্ধু দেশ তুরস্কের রয়েছে একটি প্রতিরক্ষা ও পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি। এর অধীনে গত জুলাইয়ের শেষ এবং আগস্টের গোড়ার দিকে দু' দেশের এক ব্যাপক যৌথ সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। আজারবাইজান জানায়, ওই মহড়ায় তুরস্কের ১১ হাজারেরও বেশি সেনা অংশ নেয় এবং বিভিন্ন বিষয়ে আজারী সেনাদের প্রশিক্ষণ দেয়। তুর্কী বিমানবাহিনীর জেট বিমান, আর্মড ড্রোন এবং লং রেঞ্জ মহড়ার পাশাপাশি আজারবাইজানের সশস্ত্র বাহিনীকে এসবের ব্যবহারও শিখিয়ে দেয় তুরস্ক।

জুলাই মাসের শুরুতে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া - এ দু' শত্রু দেশের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অল্প ক'দিন পরই এ যৌথ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক দিন ধরে চলা ওই যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় চালকবিহীন আকাশযান বা ড্রোন।

সারা বিশ্বেই যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোনের ব্যবহার বাড়ছে। আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার সর্বসাম্প্রতিক যুদ্ধও তার ব্যতিক্রম নয়। ড্রোনের হামলায় বিধ্বস্ত সাঁজোয়া যানের অনেক ছবি ছাপা বা সম্প্রচার হয়েছে পশ্চিমা মিডিয়ায়, দেখানো হচ্ছে কিভাবে আর্মেনিয়ার ট্যাংকগুলো আজারবাইজানের আর্মড ড্রোনের হামলার শিকারে পরিণত হচ্ছে।

আজারবাইজান অবিচলভাবে তার ড্রোনশক্তি গড়ে তুলছে। বিশ্বের অন্যতম ড্রোন রফতানিকারক দেশ ইসরাইল হ্যারপের মতো মানুষবিহীন যুদ্ধসরঞ্জাম দিচ্ছে আজারবাইজানী সশস্ত্র বাহিনীকে। 'চার দিনের যুদ্ধ' নামে খ্যাত ২০১৬ সালের যুদ্ধে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল হ্যারপ। এটা হচ্ছে একটা নতুন ধরনের অস্ত্র, যাকে বলা চলে আত্মঘাতী মানুষবিহীন আকাশযান। এটি একইসাথে ড্রোন ও বোমা, যা যুদ্ধক্ষেত্রের ওপর দিয়ে উড়ে যায় আর বহু দূরে বসে এর অপারেটর স্থির করে দেয় এটি কোথায় আঘাত হানবে। টার্গেট বা লক্ষ্যবস্তুুকে সামনে পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে এর ওপর। টার্গেটকে ধ্বংস তো করেই, নিজেও ধ্বংস হয়।

হ্যারপ বা হ্যারপি-র একটা বড় অসুবিধা ছিল এর ইঞ্জিনের শব্দ। কিন্তু আজারবাইজানকে নতুন মডেলের যেসব ড্রোন দিয়েছে ইসরাইল, সেগুলো চলে ইলেক্ট্রিক মোটরের সাহায্যে এবং আক্রমণ শুরু না-করা পর্যন্ত সেগুলো এক রকম শব্দহীনই থাকে।

আজারবাইজান অতি সম্প্রতি তুরস্কের কাছ থেকে কিনেছে বারাকতার টিবি২ এবং সেগুলো ব্যবহার করে পেয়েছে চমকলাগা সাফল্য। এগুলো দামে সস্তা, কাজে দারুণ। এসবে আছে অধিকতর উন্নত অপটিকস ও সেন্সর। এগুলো ঘাঁটিতে ফিরে আসতে পারে, দ্রæত জ্বালানি ভরতে এবং অস্ত্রসজ্জিত হতে পারে। ফিরে যেতে পারে যুদ্ধক্ষেত্রে এবং খুঁজতে পারে নতুন টার্গেট।

এসব ড্রোনের নতুন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। তা হলো, এর ক্যামেরায় লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসের পুরো চিত্র ধারণ করা যায়। এর ফলে এ ড্রোন ব্যবহারকারী পক্ষ প্রচার- প্রচারণায় সহজে এগিয়ে থাকতে পারে।

পশ্চিমা মিডিয়া যে আজারবাইজানী ড্রোনের হামলায় আর্মেনীয় সাঁজোয়া যান ধ্বংসের ছবি দেখাতে পারছে, তা এভাবেই তোলা। কোথাও-কোথাও আজারবাইজানীরা হেরে গেলেও আর্মেনিয়ান বাহিনী কিন্তু ওই প্রযুক্তির অভাবে তা দেখাতে পারছে না। পক্ষান্তরে এসব ছবি রণাঙ্গনে আজারবাইজানী বাহিনীর মনোবল যেমন বৃদ্ধি করছে, তেমনি বিশ্বজুড়ে একটা ধারণা তৈরি করে দিচ্ছে যে, যুদ্ধে আজারবাইজানের বিজয় সম্পন্ন হলো বলে!

কেবল ড্রোনই যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ধারণে মূল ভূমিকা রাখে না। আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রগুলো কিন্তু নানা রকম সেন্সরে ভর্তি। এসব সেন্সরের সাহায্যে শত্রুর কাছের-দূরের অবস্থান শনাক্ত করা অনেক সহজ। ড্রোন অস্ত্রসজ্জিত হোক বা না-হোক, সেন্সর তাতে থাকবেই। তা দিয়ে সেগুলো শত্রুর গতিবিধির মৌলিক তথ্যাবলী সংগ্রহ করতে এবং তা কম্যান্ড সেন্টারে জমা দিতে পারে।

সব মিলিয়ে বলা চলে, রণাঙ্গনের কোনো খবরই গোপন রাখা এখন ক্রমেই আরো বেশি কঠিন হয়ে উঠছে। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সাফল্যের সাথে এ প্রযুক্তির পরীক্ষা চালিয়েছে তুরস্ক। ধারণা করা হয়, সাম্প্রতিক যৌথ মহড়াকালে আজারবাইজানী বাহিনীকেও প্রযুক্তিটি ভালো করে শিখিয়ে দিয়েছে তুর্কী বাহিনী।

এসব কৌশল এমনই কাজে দিয়েছে যে, অনেক ভাষ্যকার এখন জোর গলায় বলতে শুরু করেছেন, কার্যকর যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ট্যাঙ্কের দিন ফুরিয়ে গেছে। কথাটা যতোই তিক্ত মনে হোক, এটা তো সত্য যে, টিকে থাকতে হলে তাকেও সময়ের প্রয়োজনমাফিক পরিবর্তিত হতে হবে। সম্ভাব্য দু'টি পরিবর্তন হতে পারে এ রকম - শত্রুর সেন্সরকে ঠেকিয়ে দিতে ট্যাঙ্কে যুক্ত করতে হবে রেডার ও ড্রোন সিগন্যাল জ্যামিংয়ের ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা এবং দ্বিতীয়ত ট্যাঙ্কে থাকতে হবে বিমান আক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
তবে সমালোচকরা যা-ই বলুন না কেন, সত্যি বলতে কী, স্থলযোদ্ধাদের কাছে ট্যাঙ্ক এখনও অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে। বড় বড় সেনাবাহিনীগুলো তাই ট্যাঙ্ক নিয়ে ভাবছে ভবিষ্যতের যুদ্ধে একে কিভাবে আরো কার্যকররূপে ব্যবহার করা যায়।

ইউএস মেরিন কোর তাদের ভারী ট্যাঙ্কের সংখ্যা কমানোর কথা ভাবছে, ভাবছে ব্রিটিশ আর্মিও। তার বদলে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে সেন্সর, ড্রোন এবং দূরপাল্লার হামলায় সক্ষম যুদ্ধসরঞ্জামের কথা, যা আধুনিক রণাঙ্গনে বিজয় এনে দেবে। যুদ্ধক্ষেত্রে লং-রেঞ্জ আর্টিলারি ও বিমান হামলা যদিও শতাব্দীব্যাপী চলে আসছে, এখন প্রয়োজন হচ্ছে তার আরো নিখুঁত ও নির্ভুল ক্ষমতা। সেটাও এখন আয়ত্তে আনতে চলেছে বিভিন্ন সেনাবাহিনী।

সেন্সরের ঝাঁকের সাথে মিলিত হয়ে নতুন সিস্টেমগুলো আরো বেশি নির্ভুলভাবে কাজ করছে। লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে ওয়ারহেডের ঝাঁক বসাতে হচ্ছে না। এখন কয়েক শ' কিলোমিটার দূরে বসেও হামলার লক্ষ্যবস্তু খুঁজে পাওয়া এবং ধ্বংস করা সম্ভব হচ্ছে।

আজারবাইজানের তেল বিক্রির আয় অনেক কমে গেছে। তারপরও দেশটি নতুন এসব সিস্টেমের পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। তারা ইসরাইলের কাছ থেকে কিনছে লরা ব্যালিস্টিক মিসাইল, যার আওতা হচ্ছে প্রায় ৪০০ কিলমিটার। এ সিস্টেম ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র কেনার জন্য আজারবাইজান ২০১৬ সালে ইসরাইলের সাথে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি করে। আজারবাইজান এখন ইসরাইলের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার। তারা তাদের তেলের প্রায় ৪০ ভাগই দিয়ে থাকে ইসরাইলকে।
ইসরাইল, তুরস্ক এবং কোনো-কোনো সময় রাশিয়াও যখন বন্ধু, তখন আর অস্ত্র কিনতে আজারবাইজানের কোনো সমস্যা হয় না। বরং রাশিয়াই এ ক্ষেত্রে বিব্রতকর অবস্থায় আছে। আর্মেনিয়ায় তাদের সামরিক ঘাঁটি আছে, অথচ তারা আজারবাইজানকেও অস্ত্র দিয়ে থাকে।

অন্যদিকে আজারবাইজানের সেনাবাহিনী আর্মেনিয়ার চাইতে অনেক বড়। তার ওপর তুরস্ক তাদেরকে বিভিন্ন অত্যাধুনিক সিস্টেম শিখিয়ে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধে আজারবাইজান এখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে বলা যায়। গত যুদ্ধে হারানো অঞ্চলগুলোও তারা নিজেদের দখলে আনতে চলেছে।

এ সবই সম্ভব হয়েছে সেন্সর, ড্রোন ও দূরপাল্লার যুদ্ধাস্ত্রের কল্যাণে। আজারবাইজান বাহিনীকে এসব যুদ্ধাস্ত্র পরিচালনার ট্রেনিং দিয়েছে তুরস্ক। বলা যায়, যুদ্ধ এখন আর আগের মতো নেই; বদলে গেছে আমূল। এ কঠিন সত্যতাই প্রতিষ্ঠিত হলো আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সাম্প্রতিক লড়াইয়ে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে