উত্তর কোরিয়ার শক্তি কতটুকু

ট্রাম্প বনাম কিম। এমন কার্টুন প্রায়ই ভাইরাল হতে দেখা যায় - ফেয়ার অবজারভার

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২০ অক্টোবর ২০২০, ১৪:৪৬

নুতন এক আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শন করে আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে উত্তর কোরিয়া। দেশটির সামরিক বাহিনী। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি এযাবতকালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর একটি। এবং এর রয়েছে পারামাণবিক অস্ত্র বহনের ক্ষমতা। গত কয়েক বছর ধরেই উত্তর কোরিয়াকে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি থেকে নিবৃত রাখতে চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র; কিন্তু কিম জং উনের দেশ হাঁটছে তার নিজস্ব পথেই। পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নতুন অস্ত্রের।

উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন ও একমাত্র রাজনৈতিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয় ১০ অক্টোরব। এ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় সামরিক কুচকাওয়াজ। এই কুচাকাওয়াজেই প্রদর্শন করা হয় তাদের নতুন আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র। ২২ চাকার একটি সামরিক ট্রাকের ওপর ছিল বিশাল ওই ক্ষেপণাস্ত্রটি। দুই ঘণ্টার ওই কুচকাওয়াজে আরো অনেক কিছুই ছিলো; কিন্তু বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি কেড়েছে নতুন কিম জং উনের দেশের নতুন অস্ত্রটি। তারা বলছেন, নতুন এই অস্ত্রটি এখনো পরীক্ষা করা হয়েছে কিনা সেটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে এতবড় অস্ত্রটি যে একাধিক ওয়ারহেড বহন করতে পারবে সেটিতে সন্দেহ নেই। তাই বিষয়টি উত্তর কোরিয়ার শত্রæদের জন্য উদ্বেগের বিষয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস- এর নিউক্লিয়ার পলিসি প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো অঙ্কিত পান্ডা এই কুচাকাওয়াজের ভিডিও দেখেই টুইটারে লিখেছেন, কোন সন্দেহ নেই যে, আকারে সবচেয়ে বড়, সড়কে বহনযোগ্য তরল জ্বালানির ক্ষেপণাস্ত্র এটি। । আর ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওপেন নিউক্লিয়ার নেটওয়ার্কের ডেপুটি ডিরেক্টর মেলিসা হানহাম লিখেছেন, তরল জ্বালানির বিশাল এই ক্ষেপণাস্ত্র পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক সেন্টার ফর ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের সিনিয়র ডিরেক্টর হ্যারি কাজিয়ানিসের মত , এতদিন আমরা জানতাম হাসং-ফিফটিন উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে বড় ক্ষেপণাস্ত্র; কিন্তু এবার তারা দেখালো যে, এরচেয়েও বড় ও শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র আছে তাদের ভান্ডারে।

শক্তিশালী অস্ত্রের প্রদর্শনী কিংবা পরীক্ষা চালিয়ে এরকম মাঝে মধ্যেই বিশ্ববাসীকে চমকে দেয় উত্তর কোরিয়া। বিশ্ব থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে দেশটির সামরিক বাহিনীর শক্তিমত্তা বা অন্যান্য দিক সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা পাওয়া কঠিন। সামরিক শক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের র‌্যাঙ্কিংয়ে উত্তর কোরিয়ার বর্তমান অবস্থান ১৩৮টি দেশের মধ্যে ২৫তম।

উত্তর কোরিয়ার বার্ষিক প্রতিরক্ষা বাজেট ১৬০ কোটি মার্কিন ডলার। সশস্ত্র বাহিনীর অফিশিয়াল নাম কোরিয়ান পিপলস আর্মি যার মোট জনবল আনুমানিক ১৮ লক্ষ। ১২ লাখ ৮০ হাজার সক্রিয় সদস্য আর ৬ লক্ষ রিজার্ভ সদস্য।

কোরিয়ান পিপলস আর্মির ৫টি শাখা রয়েছে- গ্রাউন্ড ফোর্স, নেভাল ফোর্স, এয়ার এন্ড এন্টি এয়ার ফোর্স, স্ট্রাটেজিক রকেট ফোর্স ও স্পেশাল অপারেশন ফোর্স। ল্যান্ড ফোর্স বা স্থল বাহিনীর আছে ৬ হাজার ৪৫টি ট্যাঙ্ক, ১০ হাজার সাজোঁয়া যান। সেল্ফ প্রোপেল্ড আর্টিলারি বা ভ্রাম্যমান কামান ৮০০টি। টাউড আর্টিলারি বা অন্য যানবাহনের ওপর স্থাপনযোগ্য কামানের সংখ্যা ১ হাজার। আর রকেট প্রজেক্টর আছে ২ হাজার ১১০টি।

এদের আছে চীনের তৈরি টি ফিফটি নাইন ট্যাঙ্ক, সোভিয়েত ইউনিয়নের টি-ফিফটি ফোর, টি-ফিফটি ফাইভ, টি-সিস্কটি টু ও নিজস্ব উদ্ভাবিত চোনমা হু ট্যাঙ্ক। এছাড়া ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী কামানসহ স্থলপথে যুদ্ধের সব উপকারণই আছে দেশটির স্থল বাহিনীতে।

নৌ বাহিনীর আছে ৮৩টি সাবমেরিন, ১১টি ফ্রিগেট, ২টি করভেটস, ২৩টি মাইন বিধ্বংসী যান ও ৪১৬টি পেট্রোল নৌযান। নেই কোন বিমানবাহী রণতরী ও ডেস্ট্রয়ার। উত্তর কোরিয়ার নৌ বাহিনী মূলত দুটি বহরে বিভক্ত। ইস্ট ফ্লিট ও ওয়েস্ট ফ্লিট। জাপান সাগর ও পীত সাগরের উপকূল জুড়ে মোট বিশটি নৌ ঘাঁটি রয়েছে দেশটির।

১৯৯৩ সালে দেশটি ১২টি ফক্সট্রোট ক্লাস ও গলফ টু ক্লাস মিসাইল সাবমেরিন যুক্ত করে বাহিনীতে। আছে কিছু মিডগেট সাবমেরিন ও হিউম্যান টর্পেডো। ২০১৩ সালের পর থেকে নৌ বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দেন কিম জং উন। ২০১৪ সালে একটি যুদ্ধজাহাজ থেকে নিজেদের তৈরি কেএইচ-থার্টিফাইভ এন্টি শিপ ক্রুজ মিসাইলের পরীক্ষা চালায় দেশটি।

নিজেদের তৈরি এই মিসাইল মিয়ানমারের কাছে রফতানিও করেছে পিয়ংইয়ং। একই বছর দেশটি সম্পূর্ণ নতুন একটি সাবমেরিন তৈরি করেছে বলে স্যটেলাইট ইমেজে ধরা পড়ে। ৬৭ মিটার দৈঘ্যৈর ওই সাবমেরিনটি দেশটির নৌ বহরের সবচেয়ে বড় সাবমেরিন। পরের বছরই এই সাবমেরিনকে সমুদ্রে টহল দিতে দেখে স্যাটেলাইট ইমেজের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। নতুন এই সাবমেরিন থেকেই কেএন-ইলেভেন ব্যালেস্টিক মিসাইলের পরীক্ষা চলায় উত্তর কোরিয়ার নৌ বাহিনী।

উত্তর কোরিয়ার বিমান বাহিনীর মোট এয়ারক্রাফট সংখ্যা ৯৪৯টি। এর মধ্যে ফাইটার ৪৫৮টি, ডেডিকেটের অ্যাটাক ফাইটার ১১৪টি, প্রশিক্ষণ বিমান ১৬৯টি। হেলিকপ্টার ২০৪টি যার মধ্যে অ্যাটাক হেলিকপ্টার ২০টি।বিমান বাহিনীর আছে বিমান বিধ্বংসী কামান ও ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বা সারফেস টু এয়ার মিসাইল।

সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি মিগ-সেভেনটিন, মিগ-টুয়েন্টি ওয়ান, মিগ-টুয়েন্টি থ্রি ফাইটার আছে আছে দেশটির বিমান বহরে। আছে এই বিমানের সর্বশেষ ভার্সন মিগ-টুয়েন্টি নাইন ৩৫টি। আছে ২৫টি রাশিয়ার তৈরি সু-টুয়েন্টি ফাইভ ও ১৮টি সু-সেভেন অ্যাটাক এয়ারক্রাফট। আছে আইএল টুয়েন্টি এইট বোম্বার ও চীনের তৈরি চেংদু জে-সেভেন ফাইটার জেট। আর আছে রাশিয়ার তৈরি এমআই-ফোরটিন ও এমআই- টুয়েন্টি ফোর অ্যাটাক হেলিকপ্টার। এসব বিমানগুলো কেএইচ-টুয়েন্টি ফাইভ ও কেএইচ-টুয়েন্টি নাইন এয়ার টু সারফেস মিসাইল নিয়ে টহল দেয় দেশটির আকাশসীমায়।

দেশটির উল্লেখযোগ্য এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে স্বল্প পাল্লার স্ট্রেলা-থ্রি, লাগলা এয়ার মিসাইল ও জেডপিইউ-ফোর এন্টি এয়ারক্রাফট মেশিন গান।তবে তা সত্তে¡ও মার্কিন সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, উত্তর কোরিয়ার এয়ার পাওয়ার দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে পাল্লা দেয়ার ক্ষমতা রাখে না।

স্ট্রাটেজিক রকেট ফোর্সের প্রধান হাতিয়ার ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলো মূলত সোভিয়েত ও চীনা নকশার যুদ্ধ উপকরণ। এছাড়া দেশীয় তৈরি কিছু ক্ষেপণাস্ত্রও আছে এই ফোর্সের কাছে। দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দাদের তথ্য মতে, এই বাহিনীর কাছে ক্ষেপণাস্ত্র আছে এক হাজারের বেশি।২ হাজার সদস্যের স্পেশাল অপারেশন ফোর্সের কাজ বিশেষ মিশন সম্পন্ন করা। বিশেষ করে শত্রæর স্থাপনা বা জাহাজে নাশকতা বা প্রয়োজনের সময় বিদেশী ভূখন্ডে অনুপ্রবেশ।

পশ্চিমা বিশ্বসহ পুরো বিশ্বের অনেক দেশের সাথেই যোগাযোগ নেই উত্তর কোরিয়ার। সামরিক দিক থেকে দেশটি শুরু থেকেই ছিল রাশিয়ানির্ভর। পরবর্তীতে চীনে সাথেও সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। তবে দেশটি নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্পে উন্নতি করেছে। বিভিন্ন সময় বিধ্বংসী সব অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে দেশটি। স্বল্প, মাঝারি ও দূর পাল্লার আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা প্রায় নিয়মিতই চালিয়ে যাচ্ছে তারা। শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই দেশটি ১৬টি ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এছাড়া হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষাও চালিয়েছে কিম জং উনের দেশ।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শান্তি আলোচনা চলার মধ্যে ২০১৯ সালে অনেকগুলো অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে দেশটি। অন্তত ছয় বার তাদের ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে গেছে জাপানি ভূখন্ডের ওপর দিয়ে। ২০১৬ সালে তারা সাবমেরিন থেকে পুকোকসং ওয়ান নামে যে ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায় বলা হয় সেটি যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখন্ডে আঘাত হানতে সক্ষম।

উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র ভান্ডারে বেশিরভাগই সোভিয়েত যুগের পুরনো অস্ত্র; কিন্তু গত এক দশকে দেশটি যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টক্কর দিয়ে চলছে তাতে সবার ভুল ভাঙতে বাধ্য হয়। এর একটাই কারণ, পারমাণবিক অস্ত্র। এটিই উত্তর কোরিয়কে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে পশ্চিমাদের। চীন ও রাশিয়ার সহায়াতাই দেশটি এই অস্ত্র প্রস্তুত করেছে বলে মনে করা হয়।

সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উত্তর কোরিয়ার যুদ্ধবিমান কিংবা সাবমেরিন পুরনো যুগের হলেও তাদের ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে এমন কিছু আছে যেগুলো পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম। বিশেষ করে ২০১৭ সালে পরীক্ষা চালানো দুটি ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়ে এমন ধারণা করা হয়। এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ১০ হাজার ৪০০ কিলোমিটার।দেশটি যে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ সেটি নিয়েও কারো মধ্যে সন্দেহ নেই। বরং তাদের ধারনা দেশটির ১৫ থেকে ২০টি পারমাণবিক বোমা রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা মনে করে এর সংখ্যা ৩০ থেকে ৬০ এর মধ্যে।

২০০৬ সালের ৯ অক্টোবর প্রথমবারের মতো পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর কথা স্বীকার করে পিয়ংইয়ং। তবে তাদের সে পরীক্ষা ব্যর্থ হয় বলে নিজেরাই জানায়। ওই দিন যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে ও জাপানের সিসমোলজিক্যাল অথরিটি ওই পরীক্ষা ক্ষেত্রের আশপাশের এলাকায় ৪ দশমিক ৩ তিন মাত্রার ভ‚মিকম্প টের পায়। ২০০৯ সালে তারা স্বীকার করে পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হওয়ার কথা।এরপর কয়েকবারই পরীক্ষা চালায় গোপনে।আর ২০১৭ সালে তারা চালায় ভয়ঙ্করহাইড্রোজেন বোমার সফল পরীক্ষা।

এছাড়া উত্তর কোরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদ আছে প্রচুর। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মনে করে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক অস্ত্রের বিশাল মজুদ আছে পিয়ংইয়ংয়ের। ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় নির্বাসিত কিম জং উনের সৎ ভাই কিম জং ন্যামকে রাসায়নিক অস্ত্র ভিএক্স নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগে হত্যা করে উত্তর কোরিয়ার গুপ্তচরেরা। এই রাসায়নিক এতটাই বিষাক্ত যে, ত্বকের ওপর কয়েক ফোটা লাগলেও কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃত্যু হতে পারে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে