প্রতিরক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে মোদির ‘মেড ইন ইনডিয়া’

ইলাস্ট্রেশন করেছেন সোহাম সেন - দ্যা প্রিন্ট

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২২ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৫৭

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহারকে উৎসাহিত করার জন্য কাজ শুরু করেছিলেন। ভারতকে আত্মনির্ভরশীল একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য তার গৃহীত নানা পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং গত আগষ্ট মাসে ১০১ টি প্রতিরক্ষা উপকরণের একটি তালিকা প্রণয়ণ করে দেশের বাইরে থেকে এসব পণ্যেন আমদানি নিষিদ্ধ করেন।

জানা গেছে, দ্বিতীয় আরেকটি তালিকাও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে শীঘ্রই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। বিডি ভিউজ ইনফোটেইনমেন্টে স্বাগত জানাচ্ছি আমি সাবরিনা কাজী। প্রতিরক্ষা খাতে ভারত কতটা আতœনির্ভরশীল হতে পারছে আজ জানাবো সেই বিশ্লেষণ।

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে বিদেশে প্রস্তুত এমন আরো ৬৯টি সামরিক উপকরণ ক্রয় করতে পারবে না। এসব উপকরণের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি বৃহৎ অস্ত্র প্রযুক্তি, জাহাজ থেকে নিক্ষেপ যোগ্য ক্রুজ মিসাইল, ডিজেল সাবমেরিন, মিসাইল ধ্বংসকারক যন্ত্র, হালকা যুদ্ধ করার মতো বিমান এবং হেলিকপ্টার। তালিকায় থাকা এসব উপকরণের অনেকগুলোই এখন নতুন লাইসেন্সের আওতায় ভারতেই তৈরি হচ্ছে।

এ কারণেই ভারত সরকার আশাবাদি যে, পরিকল্পনা মোতাবেক যদি এই উপকরনগুলো আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্প আগামী এক দশকের মধ্যেই স্বয়ংসম্পুর্ন হয়ে উঠবে। কোনোভাবে সামরিক অস্ত্র আমদানিকে যদি বন্ধ করে দেয়া যায় তাহলে সামরিক বাহিনীকে বাধ্য হয়েই দেশীয় প্রকল্পগুলোতে সম্পৃক্ত হতে হবে।

কিন্তু এ ধরনের কড়া সিদ্ধান্ত নেয়ার দিন কয়েকের মধ্যেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে সরে আসতে হয়। তাদেরকে বিদেশ থেকে বেশ কিছু সামরিক উপকরণ কেনার বিষয়টিকে অনুমোদনও করতে হয়। মূলত লাদাখ সীমান্তে চীনের সাথে সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে পরিত্যাক্ত অস্ত্রের মজুদ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে সামরিক অস্ত্রের গুদামের ওপর চাপ বেড়েছে। আর সে চাপ মোকাবেলা করার জন্যই তাৎক্ষনিকভাবে বাইরের কিছু দেশ থেকে সামরিক উপকরণ না কিনে ভারতের কোনো উপায়ও ছিল না।
রাজনাথ সিং ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পকে ৫৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন। কিন্তু ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে বেশ কিছু সংশয়ও তৈরি হয়েছে। কারণ সামরিক উপকরণ কেনার জন্য যে পরিমান অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, তা এরই মধ্যে প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় চলে গেছে। এ হিসেবে বলা যায়, রাজনাথ সিং যে ৫৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির কথা বলেছেন তার মধ্যে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে বিদেশী অস্ত্র সরবরাহকারীদের সাথে। আর মাত্র ২০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করা হয়েছে ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে।

ভারতের প্রতিষ্ঠানকে দেয়া অর্থের তুলনায় বিদেশী অস্ত্র কেনার পরিমান অনেক বেশি। সরকার নতুন কোনো দেশীয় প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ করছে- এমন কোনো লক্ষনও দেখা যাচ্ছে না। এর বাইরে ভারতের ভবিষ্যত প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা নিয়ে আরো কিছু দুর্বলতাও চোখে পড়েছে। ভারতের মতো একটি দেশ পারমানবিক অস্ত্র ও মিসাইল নির্মান করেছে সেই দেশ আবার প্রথাগত অস্ত্র তৈরি করতে পারছে না।

ভারতের স্থানীয় প্রতিরক্ষা শিল্পের বিপরীতে বিদেশ থেকে অস্ত্র কেনার যে প্রক্রিয়া রয়েছে তাতে সাম্প্রতিক সময়ে বড়ো আকারের সংস্কার করা হয়েছে। সর্বশেষ অস্ত্র কেনার জন্য প্রনীত প্রক্রিয়ায় দেশীয় নকশায় উৎপাদিত আইডিডিএম উপকরণগুলোকেই ওপরের দিকে রেখে নতুন করে সামরিক অস্ত্রের শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে।

মেক ইন ইন্ডিয়া নীতিমালা অনুযায়ী বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের উপকরণগুলোকে আন্তর্জাতিক প্রোডাক্ট লাইন থেকেই তৈরি করতে হবে। যেমন বিদেশী অস্ত্র আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি ভারতের কাছে লকহিড মার্টিন এফ-সিক্সটিন বিমান বিক্রি করতে হয়, তাহলে তা এই নামে করা যাবে না। বরং এফ টোয়েন্টি ওয়ান হিসেবে বিক্রি করতে হবে।

আইডিডিএম উপকরণের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশই ভারতীয় কনটেন্ট রাখতে হবে। শুধু অস্ত্র উপকরণের ক্ষেত্রেই নয়, স্পেয়ার যন্ত্রপাতি, বিশেষ বিশেষ যন্ত্র এবং পরীক্ষা উপকরণের ক্ষেত্রেও ৬০ ভাগ উপাদান ভারতীয় হতে হবে। মেক ইন ইন্ডিয়া ক্যাটাগরিতে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোকে মাত্র ৪০ শতাংশ উপকরণের সরবরাহের সুযোগ দিয়েছে।

এ প্রক্রিয়াটি আরো জটিলতর হয়েছে কারণ এখানে দেশীয় উপকরণ ব্যবহারের জন্য চাপ দেয়া হলেও কোন দেশীয় পন্যকে কোন খাতে কতটুকু ব্যবহার করা হবে তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। ভারতের সামরিক বাহিনীকে অনেকটা অন্ধের মতো বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর মৌখিক কথা বা আশ্বাসের ওপর নির্ভর করতে হবে। ভারতের সেনাবাহিনীর একটি মানসিকতা এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে তারা বিদেশ থেকে আমদানিকৃত যে কোনো উপকরণের ওপর চোখ বন্ধ করে ভরসা রাখতে পারে। অথচ দেশে কোনো উপকরণ নির্মিত হয়েছে- এটা জানলেই তাদের মধ্যে নানা ধরনের সংশয় ও সন্দেহ তৈরি হয়।

ভারতের প্রণীত নকশা অনুযায়ী ৪ পয়েন্ট ৫ প্রজন্মের তেজস হালকা ধরনের যুদ্ধ বিমান তৈরি করেছে। এই বিমান নির্মানে ভারতীয় বিমান বাহিনী খুব একটা অবদান রাখতে পারেনি। এরপরও বিমানটি যখন তারা হাতে পেলো তখন তারা বললো প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিমানটা আধুনিক হয়নি বরং সেকেলে ধরনের রয়ে গেছে। অন্য বিমান কেনার জন্য বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়।

নিজস্ব সেনা প্রকৌশলীদের নকশায় প্রণীত অর্জুন যুদ্ধ ট্যাংকের ব্যাপারেও খুশি নয় ভারতীয় সেনাবাহিনী । এছাড়া দাম নিয়ে সামঞ্জস্যতা না থাকায় এ ট্যাংকটি খুব বেশি কেনাও সম্ভব হয়নি। ভারতীয় সেনাবাহিনী এখনো মনে করে যে, অর্জুন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি প্রশস্ত ও ভারি। সেনাবাহিনীর এ ধারণার কারণেই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এখনো রাশিয়ান টি-নাইনটি ট্যাংকের ব্যবহার বাড়ছেই।

ভারতে প্রস্তুতকৃত সমরাস্ত্রের বিষয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এ বিমাতাসুলভ আচরণের সূচনা হয় ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি। সে সময় ভারত নিজস্ব নকশায় মারুত এইচ এফ টোয়েন্টি ফোর নামে প্রথম একটি সুপারসনিক জেট ফাইটার নির্মান করে। ভারতীয় বিমান বাহিনী নিজ দেশে তৈরী হওয়া সুপার সনিকের চেয়ে বৃটেনে নির্মিত জাগুয়ার লো-লেভেল বিমানকে বেশি পছন্দ করে। ফলে স্থানীয়ভাবে নির্মিত সুপারসনিকের সমান দাম দিয়েই জাগুয়ার বিমান ক্রয় করা হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারী প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রাইভেট সেক্টরে কর্মরত ব্যক্তিগত বা বেসরকারী পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোও ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। তাদের নির্মাণ নকশা, কর্মনীতি এবং শ্রম উৎপাদন ও কাজে লাগানোর হারও সন্তোষজনক। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে মোদি সরকার প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যয়বহুল ও অপচয়মূলক প্রকল্পগুলোতে সাব-কন্টাক্টের ভ‚মিকাতেই রেখে দিয়েছে। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্ভাবনা থাকার পরও তাদেরকে কাজে লাগানো হচ্ছে না।

ফলে, একদিকে প্রতিরক্ষা প্রকল্পের ব্যয় যেমন বেড়ে যাচ্ছে, পণ্য সরবরাহতে বিলম্ব হচ্ছে আবার একইসঙ্গে সামরিক খাতের ক্রেতারাও অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ছে।

ভারতের অনেক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকের অভিযোগ প্রতিরক্ষা শিল্পকে লাভজনক ও রফতানিমুখী করার যে সম্ভাবনা ছিল ভারতীয় সরকার এ পর্যন্ত তা শুধু উপেক্ষা করে চলছে। মুখে যাই বলুক না কেন বিদেশ থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি বেড়েই চলছে।

ভারতীয় অনেক বিশ্লেষক মনে করেন এমনটা না হলে এতদিনে হিন্দুস্তান এ্যারোনটিকস লিমিটেড, যৌথভাবে টাটা ও মহেদ্র এরোস্পেসের সাথে মিলে তেজস এলসিএ’র জন্য নকশা প্রনয়ণ করে যুদ্ধবিমান তৈরির কাজে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারতো।

শুধু তাই নয়, লারসেন এন্ড টারবো’র মতো প্রকৌশলী খাতের মহীরূহ প্রতিষ্ঠানের সাথে আরিহান্ট এসএসবিএন’ এর যৌথ সমন্বয়ের মাধ্যমে তারা সাধারণ মানের সাবমেরিনও তৈরি করে ফেলতে পারতো।

ভারতীয় সরকার আরেকটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে। তা হলো প্রতিরক্ষা খাতে সরকারী গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম আর প্রতিরক্ষা শিল্প সম্পদকে বিভক্ত করার কথা ভাবছে। ভাগ করার পর এ দুটো খাতকেই তারা শীর্ষস্থানীয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠান টাটা এবং লারসেন এন্ড টার্বোর ব্যবস্থাপনায় দিয়ে দিয়েছে।

ভবিষ্যতে, এ দুটো খাত থেকেই আলাদা আলাদা ভাবে অস্ত্র জোগানের জন্য দরপত্র আহবান করা হবে। এ ধরনের বিচ্ছিন্ন উদ্যোগের কারণে প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের অর্থায়নও সঠিকভাবে হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিরক্ষা শিল্প সম্পদকে যদি যথাযথভাবে কাজে লাগানো হয়, তাহলে সামরিকখাতে ভারতের সাবলম্বী হওয়ার আশা দূরাশাই থেকে যাবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে