আরব দেশগুলো যেভাবে ইসরাইলি অস্ত্রের বাজারে পরিণত হচ্ছে

ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক সমরাস্ত্র ও প্রযুক্তি সংগ্রহ করলেও দেশটি বিশ্বের অন্যতম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ - নিউজব্রেক

  • মেহেদী হাসান
  • ১২ অক্টোবর ২০২০, ১৫:২৬

ইসরাইল-সংযুক্ত আরব আমিরাত শান্তি চুক্তির ফলে মধ্য প্রাচ্যের অস্ত্র বাজারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে ইসরাইল। একই সাথে মধ্য প্রাচ্যের উপসাগরীয় দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি নীতিতে আসছে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে।

১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলো উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছে এমন কোনো অস্ত্র বিক্রি না করা যা ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। ইসরাইলকে আরব দেশগুলোর মধ্যে সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী রাখা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। ইসরাইলের সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এখন অনেক ধরনের সমরাস্ত্র আরব দেশগুলোতে বিক্রির অনুমোদন দিতে যাচ্ছে।

অপর দিকে ইসরাইলও তার অনেক অস্ত্র ও প্রযুক্তি আরব দেশগুলোতে বিক্রি করবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে ইসরাইল বেশ কিছু অস্ত্র ও প্রযুক্তি বিক্রি করবে বলে ইসরাইলি গরমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। তবে ইসরাইল সরকারের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিভক্তি। একটি পক্ষ মনে করছে অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে ইসরাইলের সাবেক এ শত্রæ রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক আরো সংহত হবে। আরেকটি পক্ষ মনে করছে এর মাধ্যমে ইসরাইলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।

আরব আমিরাতের কাছে অস্ত্র বিক্রির পক্ষে রয়েছেন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। মোসাদ চেষ্টা করছে ইসরাইলের এডভান্সড উইপন সিস্টেম এবং উচ্চ গোপনীয় প্রযুক্তি আরব আমিরাতে বিক্রি করতে। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় এর ঘোর বিরোধী। মন্ত্রনালয়ের আশঙ্কা এর মাধ্যম ইসরাইলের গোপনীয়তা শত্রæ রাষ্ট্রের কাছে ফাঁস হয়ে যেতে পারে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ইসরাইলের মধ্যে গত আগস্টে শান্তি চুক্তি হয়েছে। বাহরাইন, লেবানন, ওমানসহ আরো অনেক দেশ ইসরাইলের শান্তি শান্তি চুক্তির বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইসরাইলকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয় মিশর। ১৯৭৭ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ইসরাইল সফর করেন এবং ১৯৭৯ সালে মিশর-ইসরাইল শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে অস্ত্র বিক্রি নিয়ে বির্তকের জেরে এ সংক্রান্ত খবরের তথ্য অস্বীকার করেছে নেতানিয়াহুর অফিস। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ ধরনের কোনো অনুরোধ সাম্প্রতিক বছরে আসেনি। আর এ ধরনের কোনো প্রস্তাব আসলেও প্রধানমন্ত্রী কখনো তা অনুমোদন দিতেন না। এতে মনে করা হয় অস্ত্র বিক্রির বিষয়টি এখনও গোপন রাখতে চায় ইসরাইল।

আরব দেশের কাছে ইসরাইলী অস্ত্র বিক্রির গুঞ্জনে সামনে এসেছে ইরানের নাম। ইসরাইলের সাথে বাহরাইন এবং ওমানের তেমন কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু প্রতিবেশি ইরান নিয়ে এই দুদেশের রয়েছে ভয়ানক রকমের আতঙ্কে রয়েছে। কারন এই দুই দেশের সরকারের আশঙ্কা ইরান তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে পারে। বাহরাইন আর ওমান ধনী দেশ হলেও ইরানের সামরিক শক্তির কাছে অনেকটাই অসহায়। বিশাল যুদ্ধ বিমানের বহর ছাড়াও রয়েছে ইরানের বিপুল পরিমান ব্যালিস্টিক মিসাইল যা তারা নিজেরা তৈরি করে। এ ছাড়া সম্প্রতি ড্রোন প্রযুক্তিতে অনেক উন্নতি করেছে ইরান। ফলে এই দুটি দেশ হতে পারে ইসরাইলি অস্ত্রের সাম্ভাব্য প্রধান ক্রেতা।

ইসরাইল সংযুক্ত আরব আমিরাতে কী ধরনের অস্ত্র বিক্রি করতে পারে সে বিষয়ে এখন আলোচনা চলছে । এ তালিকায় প্রথমেই থাকতে পারে ইসরাইলের আয়রন ডোম মিসাইল সিস্টেম। ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বরে সৌদি দুটি তেল ক্ষেত্রে ঝাকে ঝাকে ড্রোন আর ক্রুজ মিসাইল হামলার পর আরব দেশগুলো শক্তিশালী মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।

সৌদি তেল ক্ষেত্রে হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র দায়ী করে ইরানকে। এ হামলার সবচেয়ে উদ্বেগের দিক হলো লক্ষ্যবস্তুতে নিখুতভাবে আঘাত করার ক্ষমতা। সৌদি তেল ক্ষেত্রে ১৯টি মিসাইল হামলা করা হয়। এর মধ্যে ১৭টি মিসাইল নিখুতভাবে লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত করেছে। এরমধ্যে আবার ১৪টি মিসাইল আঘাত করে তেল সংরক্ষনাগারে।

তবে ইসরাইল আলোচিত আয়রন ডোম মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম প্রযুক্তি সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে হস্তান্তর করতে চাইবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আরবে রপ্তানিযোগ্য ইসরাইলের অন্যান্য অস্ত্রের মধ্যে থাকতে পারে মিসাইল আমর্ড হেরন অ্যাটাক ড্রোন এবং স্মার্ট বম্ব। ইরানের মিসাইল উৎপাদন কেন্দ্র এবং মজুদ ধ্বংসের জন্য ইসরাইলের এ অস্ত্র যথেষ্ট উপযুক্ত ।

ইসরাইলের লয়টারিং বোমা হারপি ইরানের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া ইসরাইলের রয়েছে এন্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল স্পাইক। ইতোমধ্যে খবর প্রকাশ হয়েছে ইসরাইল -আমিরাত শান্তি চুক্তির কারনে আরব আমিরাতের কাছে ফিফথ জেনারেশন স্টেলথ ফাইটার এফ-৩৫ বিক্রি করতে রাজি হয়েছে।

১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলো মধ্য প্রাচ্যে ইসরাইলের চেয়ে শক্তিশালী কোনো সমরাস্ত্র যেন অন্য কোনো দেশের কাছে না থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক দিক দিয়ে ইসরাইলকে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। এখন যেহেতু ইসরাইলকে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলো স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং ইসরাইলের সাথে গোপনে ও প্রকাশ্যে সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এখন অন্যান্য আরব দেশে শক্তিশালী অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দেবে। ট্রাম্প প্রশাসন এফ-৩৫ বিমানের পাশাপাশি সামরিক ড্রোন বিমান বিক্রি করতে রাজি হয়েছে।

ইসরাইলকে রক্ষায় আরব দেশের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি বিষয়ে সংরক্ষন নীতির কারনে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শক্তিশালী অ্যাডভান্সড অস্ত্রের একক মালিক হয়েছে ইসরাইল। এসব অস্ত্র আরবের অন্য কোনো দেশে নেই। ইসরাইল ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ বিমানের অধিকারী হয়েছে। ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক সমরাস্ত্র ও প্রযুক্তি সংগ্রহ করলেও দেশটি বিশ্বের অন্যতম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। অপর দিকে বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র আমদানীকারক দেশ সৌদি আরবও অনেক উন্নত প্রযুক্তি ও অস্ত্র সংগ্রহ করে চলছে।

উপসাগরীয় দেশের কাছে ইসরাইলী কোনো সমরাস্ত্র প্রতিষ্ঠানের অস্ত্র বিক্রিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এখনো ইসরাইলের এ শর্তের অধীনে রয়েছে। অর্থাৎ ইসরাইল এখনো সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে সব ধরনের অস্ত্র বিক্রির উপযুক্ত মনে করছে না। তবে কাগজে কলমে এ নীতি গত আট বছর ধরে মানছে না ইসরাইল। গত আট বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের কাছ থেকে ব্যাপক অস্ত্র ও প্রযুক্তি ক্রয় করেছে।

আরবের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ইসরাইলের আর্থিক এবং নিরাপত্তা বিষয়ক লেনদেন অনেকটা ওপেন সিক্রেট। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যর বিভিন্ন দেশ এবং ইসরাইলের এখন কমন শত্রু হলো ইরান। ইরান বিষয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য এসব দেশ পরষ্পর আদান প্রদান করে থাকে। ইরানকে মোকাবেলায় ইসরাইলের সাইবার টেকনোলজি ও বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে থাকে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় কয়েকটি দেশ।

অফিশিয়াল চ্যানেল ছাড়াও অনেক আরব দেশ বিভিন্ন রুটে ইসরাইলের অস্ত্র পেয়ে থাকে। যেমন মরক্কোর কাছে রয়েছে ইসরাইলের তিনটি হেরন ড্রোন। এসব ড্রোন আকাশে মাঝারি উচ্চতায় অবস্থান করে পর্যবেক্ষন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। মরক্কোর আগে এসব ড্রোন ফ্রান্স ব্যবহার করেছে। ফ্রান্স আর্মি এগুলো ডিকমশিন করার পর মরক্কো এগুলো তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে। একই ভাবে থার্ড পার্টির মাধ্যমে লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধরত বিভিন্ন গ্রæপ ইসরাইলী ড্রোন সংগ্রহ করেছে ।

১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলো মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের চেয়ে শক্তিশালী কোনো সমরাস্ত্র যেন অন্য কোনো দেশের কাছে না থাকে। ছবি : নিউজব্রেক
১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলো মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের চেয়ে শক্তিশালী কোনো সমরাস্ত্র যেন অন্য কোনো দেশের কাছে না থাকে। ছবি : নিউজব্রেক

 

তবে সাইবার প্রযুক্তি বিক্রি আর মিসাইল বিক্রি এক কথা নয়। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় জানিয়েছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন গোপন অস্ত্র উপসাগরীয় দেশের কাছে হস্তান্তর ইসরাইল তার নিজের জন্য হুমকি মনে করছে। এসব প্রযুক্তি চলে যেতে পারে ইরানের কাছে। রেজা শাহ পাহলবীর সময় ৭০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের কাছে অনেক শক্তিশালী সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর এসব অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এ ধরনের আশঙ্কা সত্তে¡ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে ইসরাইলী অস্ত্র বিক্রির সম্ভাবনা অযৌক্তিক নয়। ইসরাইলের সেচ প্রযুক্তি উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর এ প্রযুক্তি ইসরাইলের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। আর ইসরাইল-আমিরাত প্রতিরক্ষা চুক্তির চেয়েও সহজ রাজনৈতিক প্রস্তাবে অস্ত্র বিক্রি করা।

লেবাননে হিজুল্লাহর মাধ্যমে ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ চালাচ্ছে ইরান। লেবানেন- ইসরাইল সীমান্তে মোতায়েন রয়েছে ইরানি অস্ত্র। এখন ইসরাইল উপসাগরীয় দেশগুলোতে অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে ইরানের বিরুদ্ধে এসব অস্ত্র ব্যবহার করবে। এই সমীকরনে সৌদি আরব, বাহরাইন এবং ওমানের সাথে ইসরাইলের ঘণিষ্ঠতা আরো বাড়বে। ফলে শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাত নয় অন্যান্য আরব দেশেও অস্ত্র বিক্রি করতে পারে ইসরাইল।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে