রহস্যময় আর ভয়ঙ্কর এক সমরাস্ত্রের নাম সাবমেরিন। সাগরে হাজার হাজার ফিট পানির নিচে গোপনে চলতে পারে অনেক সাবমেরিন। পরমানু শক্তিচালিত সাবমেরিন মাসের পর মাস অবস্থান করতে পারে পানির নিচে। সাবমেরিন যুদ্ধ খুবই ভয়াবহ এক যুদ্ধ। সোনার আর রাডারের মাধ্যমে সনাক্ত করা যায় সাবমেরিন। তবে বর্তমনে অনেক সাবমেরিনের অবস্থান সনাক্ত করা কঠিন। ফলে এসব স্টেলথ সাবমেরিন প্রতিপক্ষের জন্য ভয়ানক এক হুমকি বা সাক্ষাত জম হিসেবে বিরাজ করছে। কারন এসব স্টেলথ সাবমেরিন বহন করছে পারমানিবক বোমা। আর এ বোমা বহনের জন্য মোতয়েন রয়েছে দূর পাল্লার মিসাইল।
যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত ইউনিয়ন দীর্ঘ ঠান্ডা লড়াইকালে নৌ শক্তির ক্ষেত্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সোভিয়েত রাশিয়া ব্যাপক মাত্রায় সাবমেরিন নির্মান করে । এখনো এ দুই দেশের মধ্যে ভয়ঙ্কর শক্তির সাবমেরিন নির্মানের প্রতিযোগিতা চলছে। বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে দানবীয় শক্তির সাবমেরিনের অধিকারী এ দুই দেশ।
পশ্চিমা গণমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা সাবমেরিনকে সবচেয়ে শক্তিশালী সাবমেরিন হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে বর্তমানে। তবে বিশ্বের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে দ্রুত গতির, আর পানির সবচেয়ে গভীরে চলতে সক্ষম রাশিয়ার সাবমেরিন। যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটার পর রাশিয়া নির্মাণ করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাবমেরিন বেলগোরোড যার অনেক কিছ‚ এখনো অজানা। রাশিয়ার এ সাবমেরিন বহন করতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পারমানবিক বোমা।
বিশ্বে রহস্যময় সাবমেরিন হিসেবে পরিচিত রাশিয়ার লোশারিক সাবমেরিন। এটি একটি সামরিক গোয়েন্দা সাবমেরিন । পরমানু শক্তিচালিত সাবমেরিন লোশারিক ২০১২ সালে আর্কটিক সাগরে ৮ হাজার ২শ ফিট পর্যন্ত গভীরে পৌছায়। তবে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সাবমেরিন লোশারিক ২০ হাজার ফিট গভীরে পর্যন্ত পৌছার ক্ষমতা থাকতে পারে।
সাগরের সবচেয়ে গভীরতম স্থান হলো পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের গুয়াম দ্বীপের কাছে মারিয়ানা ট্রেন্স। এর গভীরতা ৩৫ হাজার ৮৫৩ ফিট বা ১০ দশমিক ৯২ কিলোমিটার।
মূলত গোপন মিশন পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা হয় সাবমেরিন। সে কারনে অনেক দেশই সাবমেরিনের প্রকৃত ক্ষমতা ও শক্তি প্রকাশ করে না ।
লোশারিক অপারেশন পরিচালনা শুরু করে ২০০৩ সাল থেকে। গবেষণা, উদ্ধার এবং বিশেষ সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য রাশিয়া তৈরি করে এ সাবমেরিন। রাশিয়ান মিলিটারি গোয়েন্দা এজেন্সি জিআরইউ’র কাছে রিপোর্ট করে এ সাবমিরন ।
রহস্যময় এ সাবমেরিন বিষয়ে রাশিয়া খুব অল্প তথ্যই এখন পর্যন্ত প্রকাশ হয়েছে। এমনকি রাশিয়া এর ছবিও প্রকাশ করেছে মাত্র কয়েকটি। তবে ২০১৯ সালে দুর্ঘটনায় ১৪ জন উচ্চ পদস্থ নাবিক মৃত্যুর ঘটনার পর এ সাবমেরিন বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসে।
বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী সাবমেরিন হলো যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া ক্লাসের সাউথ ডাকোটা আর রাশিয়ার বেলগোরোড । দুটি সাবমেরিনই চালু হয় ২০১৯ সালে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আর সবচেয়ে ভয়ানক শক্তির অধিকারী হিসেবে পরিচিত সাউথ ডাকোটা চালু হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
অপর দিকে বিশ্বের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় আর শক্তিশালী রাশিয়ার বেলগোরোড চালু হয় ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে। দুটি সাবমেরিনই পরমানু শক্তিচালিত।
অপর যেসব সাবমেরিন বিশ্বে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী হিসেবে পরিচিত সেগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্রের সি উলফ ক্লাস, যুক্তরাজ্যের এসটিউট ক্লাস, রাশিয়ান ইয়াসিন ক্লাস, সিয়েরা ক্লাস, যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলস ক্লাস, রাশিয়ার আকুলা ক্লাস, জাপানের সরিউ ক্লাস, যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও ক্লাস এবং রাশিয়ার অসকার-২ ক্লাস সাবমেরিন।
বিশ্বে কোন সাবমেরিন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর শক্তিশালী তা নির্ভর করে শত্রুপক্ষকে ফাঁকি দেয়ার ক্ষমতা এবং মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতার ওপর। শত্রুপক্ষের সাবমেরিন সনাক্ত করার জন্য এতে থাকতে হবে ভাল সোনার পদ্ধতি। একই সাথে এতে থাকতে হবে শত্রুপক্ষের সাবমেরিন এবং অন্যান্য রণতরীর কাছে পুরোপুরি গোপনে পৌছানো এবং ফিরে আসার ক্ষমতা।
শত্রু পক্ষের কোনো সাবমেরিন, টহল জাহাজ, বিমান বা এন্টি সাবমেরিন শিপ একে সনাক্ত করতে পারবে না। থাকতে হবে স্থলে এবং সাগরে শক্তিশালী দূর পাল্লার মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা। এসব ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ভয়ঙ্কর সাবমেরিনের তালিকা।
বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত সাবমেরিন নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সাবমেরিন হলো রাশিয়ার বেলগোরোড সাবমেরিন। এর দৈর্ঘ ৬ শ ৪ ফুট বা ৫০ তলা উচু ভবনের সমান । বেলগোরোড সাবমেরিন ১ হাজার ৭শ ফুট পানির গভীরে চলতে পারে। আসুন জেনে নেই এই সাবমেরিন সর্ম্পকে কিছু তথ্য
বেলগোরোড বহন করতে পারে সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শক্তির অধিকারী টরপোডো মিসাইল পজিডন। ধারণা করা হয় এটি ২ মেগাটন শক্তির পারমানবিক টরপেডো বোমা । সাগর তলে বেলগোরোড চলতে প্রয়োজন হয় ১৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের । ক্রু সংখ্যা ১১০ জন। বেলগোরোড একটি সামরিক গোয়েন্দা সাবমেরিন।
বেলগোরোড নির্মানের আগে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাবেরিমন ছিল রাশিয়ার টাইফুন ক্লাস সাবমেরিন। এর দৈর্ঘ্য ৫৭৪ ফিট। ১৯৮১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এটি সার্ভিসে যুক্ত রয়েছে। সোভিয়েত আমলে সোভিয়েত নেভির জন্য এ সাবমেরিন নির্মিত হয়। পরমানু শক্তিচালিত এ সাবমেরিন আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র বা ব্যালিস্টিক মিসাইলে সজ্জিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও ক্লাস সাবমেরিনের বিপরীতে নির্মান করা হয় এ সাবমেরিন। টাইফুন ক্লাসের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ সাবমেরিন হলো বোরি ক্লাস সাবমেরিন এবং এটাও রাশিয়ার।
তবে রাশিয়ার টাইফুল ও বোরি ক্লাসের তুলনায় শক্তির দিক দিয়ে এগিয়ে রাশিয়ার সিয়েরা ক্লাস, অসকার ক্লাস এবং আকুলা ক্লাস সাবমেরিন। রাশিয়ার সিয়েরা ক্লাস সাবমেরিন ২ হাজার ৪৬০ ফিট পর্যন্ত গভীরে অবস্থান করতে পারে। এ ছাড়া ১৯৮০ সালে নির্মিত রাশিয়ার আকুলা ক্লাস সাবমেরিন তখনকার সময়ের সবচেয়ে এডভান্সড সাবমেরিন হিসেবে পরিচিত। এটি ৪০টি টরপেডো এবং মিসাইল বহন করতে পারে।
অপর দিকে রাশিয়ার অসকার ক্লাস সাবমেরিন ২ হাজার ৭২৫ ফিট নিচে চলতে পারে।
বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতির সাবমেরিনেরও রেকর্ড সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়ার কাছে। এর নাম কে ২২২। ১৯৬৯ সালে এ সাবমেরিন সোভিয়েত নেভিতে যুক্ত হয়। ২০১০ সালে এটি ভেঙ্গে ফেলা হয়।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বর্তমান রাশিয়া মোট ২৪৮টি সাবমেরিন নির্মান করে। এর মধ্যে ৯১টি ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার এর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে রাশিয়ার ৬২টি সাবমেরিন বর্তমানে সার্ভিসে যুক্ত রয়েছে । এর মধ্যে ৩৭টি পরমানু শক্তিচালিত । বাকীগুলো ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন। রাশিয়ার নৌ শক্তির প্রতীক আর গৌরব তাদের এসব সাবমেরিন। অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ৬৬টি সাবমেরিন বর্তমানে সার্ভিসে যুক্ত রয়েছে। এর সবই পরমানু শক্তিচালিত। আসুন জেনে আসি সাবমেরিন সর্ম্পকে আরো কিছু তথ্য
সি উলফ ক্লাস সাবমেরিন যুক্তরাষ্ট্র নির্মান করেছে রাশিয়ার শক্তিশালী টাইফুন ক্লাস আর আকুলা ক্লাস সাবমেরিন ধ্বংসের জন্য। সি উলফ ক্লাস সাবমেনি এতই ব্যয়বহুল যে ২৯ টি নির্মানের পরিকল্পনা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র তিনটির বেশি আর নির্মান করতে সাহস করেনি।
একটি সি উলফ সাবমেনি ৫০টি টরপেডো, সাব হারপুন ও টোমাহক মিসাইল বহন করতে পারে। টোমাহক ল্যান্ড ক্রুজ মিসাইল ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দূরে আঘাত করতে সক্ষম। সি উলফ ক্লাস সাবমেরিন ১ হাজার ৬শ ৭ ফুট গভীরে চলতে পারে। এর দৈর্ঘ্য ৩৫৩ ফিট।
যুক্তরাষ্ট্রের সি উলফ ক্লাস, ভার্জিনিয়া ক্লাস এবং যুক্তরাজ্যের এসটিউট ক্লাস সাবমেরিনের ক্ষমতা প্রায় একই।
পানির নিচে সবচেয়ে ভয়ানক সাবমেরিন হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া ক্লাসের সাউথ ডাকোটা সাবমেরিন। এটি ভূমিতে ১ হাজার ৫শ মাইল দূরে টোমাহক মিসাইল হামলা পরিচালিত করতে পারে। আর কয়েক ডজল টোমাহক মিসাইল বহন করতে পারে সাউথ ডাকোটা। মোস্ট এডভ্যান্সড টেকনোলজিতে সজ্জিত সাউথ ডকোটা সাবমেরিন। সাউথ ডকোটা একটি স্টেলথ সাবমেরিন। এটি একটি ফাস্ট এটাক সাবমেরিন। এর দৈর্ঘ্য ৩৭৭ ফিট।
ভার্জিনিয়া ক্লাসের মোট ১৯টি সাবমেরিন নির্মান করে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রথমটি সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০০৪ সালে। সাউথ ডকোটা সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। চীন এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে ফার্স্ট লাইন অব ডিফেন্স হিসেবে ভূমিকা পালন করবে এ সাবমেরিন।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে