বিশ্বজুড়ে ইতালির সমরাস্ত্র বাজার

সারা বিশ্বের সামরিক বাহিনীর চাহিদা পূরণকে সামনে রেখে লিওনার্দো নির্মাণ করছে অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার - গেটি ইমেজ

  • মেহেদী হাসান
  • ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৫:২৯

প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল বর্তমান ইতালি। কিছু ধ্বংসস্তুপ ছাড়া রোমান সাম্রাজ্যের কোনো প্রভাব প্রতিপত্তি নেই বর্তমান ইতালিতে। তবে ইতালির একটি সমরাস্ত্র শিল্পের প্রভাব বিস্তার করেছে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সমর অঙ্গনে। ইতালির এ সমরাস্ত্র তৈরি প্রতিষ্ঠানের নাম লিওনার্দো । বিশ্বে ১৫০টি দেশে লিওনার্দোর তৈরি সমরাস্ত্র ও সিস্টেম ব্যবহার করে। ১৮০টি দেশে এর শাখা রয়েছে।

এরোস্পেস, প্রতিরক্ষা এবং সিকিউরিটি বিষয়ক ইতালির বহুজাতিক একটি কোম্পানির নাম লিওনার্দো। লিওনার্দোর সদর দফতর ইতালির রাজধানী রোমে। রেভিনিউ আয়ের দিক দিয়ে এটি বিশ্বের অষ্টম সমরাস্ত্র তৈরি শিল্প। ২০১৯ সালে লিওনার্দোর রেভিনিউ আয় করে ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। প্রায় ৫০ হাজার জনশক্তি নিয়োজিত রয়েছে লিওনার্দোতে।

বিশ্বব্যাপী লিওনার্দোর সবচেয়ে বেশি পরিচিতি সামরিক ও বেসামরিক হেলিকপ্টারের জন্য। বাংলাদেশ আর্মির কাছেও লিওনার্দোর হেলিকপ্টার রয়েছে। সিঙ্গেল ইঞ্জিন থেকে তিন ইঞ্জিন পর্যন্ত শক্তিশালী সামরিক এবং বেসামরিক হেলিকপ্টার তৈরি করে লিওনার্দো।

লিওনার্দোর তৈরি সমরাস্ত্র ৫টি প্রধান শাখায় বিভক্ত। হেলিপ্টার, যুদ্ধ বিমান, এরোস্ট্রাকচারস, ইলেকট্রোনিক্স এবং সাইবার সিকিউরিটি। যুদ্ধ বিমান, হেলিকপ্টার ছাড়াও লিওনার্দো, মিসাইল, টরপেডো, আনম্যানড গ্রাউন্ড ভিহিক্যালস, আনম্যানড আন্ডারওয়টার ভিক্যিালস, নেভল আর্টিলারি, রোটারি ক্যাননস, টারেটস, রিমোট কন্ট্রোলড উইপন স্টেশন, অটো ক্যাননস, আরমারড ভিহিক্যালস এবং এরোনটিক্স সামগ্রী তৈরি করে।

১৫০টি দেশের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এন্ড ম্যানেজমেন্ট এর জন্য ব্যবহার করে লিওনার্দোর সিস্টেম। এ ছাড়া ৭০ টি দেশের ১০০০ রণতরীতে রয়েছে লিওনার্দো সিস্টেম। লিওনার্দোর একটি যৌথ উৎপাদন ইউরো ফাইটার টাইফুন বহুমুখী যুদ্ধ বিমান।

ইউরো ফাইটার টাইফুন আকাশ থেকে আকাশে, আকাশ থেকে ভূমিতে শক্তিশালী মিসাইল হামলা পরিচালনায় সক্ষম। সুপারসনিক এ বিমানের গতি শব্দের চেয়ে দ্বিগুন বা ম্যাক২। সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ১ হাজার ৩২০ মাইল। বোমা ও মিসাইল বহনের জন্য বিমানটিতে রয়েছে ১৩টি হার্ড পয়েন্ট। ৯টি দেশের এয়ারফোর্সে যুক্ত রয়েছে এ বিমান।

টাইফুন একটি দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট সুপারসনিক যুদ্ধবিমান। এতে রয়েছে সর্বশেষ প্রযুক্তি। ইতালি, ফ্রান্স, জার্মান, বৃটেন এবং স্পেন যৌথ উদ্যোগে তৈরি করছে এ বিমান। সৌদি আরবের কাছে ৭১টি ইউরো ফাইটার টাইফুন রয়েছে। বৃটেন ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৬০টি ইউরো ফাইটার সংগ্রহ করেছে। জার্মানি ১৪৩টি, ইতালি ৯৬টি, স্পেন ৭৩টি ইউরো ফাইটার সংগ্রহ করেছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, ওমান, কুয়েত ও কাতারের কাছে এ যুদ্ধ বিমান রয়েছে।

ইউরো ফাইটারের দৈর্ঘ্য ৫২ ফিট ৪ ইঞ্চি, শুধু বিমানটির ওজন ১১ টন, মেক্সিম্যাম টেক অফ ২৩ টন ৫০০ কেজি। টাইফুনের কমব্যাট রেঞ্জ ১ হাজার ৩৮৯ কিলোমিটার। ইউরোফাইটার টাইফুন প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৯৪ সালে। সার্ভিসে যুক্ত হয় ২০০৩ সালে।

যুদ্ধবিমান ছাড়াও লিওনার্দো বিশ্বব্যাপী অনেক বেশি পরিচতি হেলিকপ্টারের জন্য। সামরিক, বেসামরিক মিলিয়ে ২৫ এর অধিক ধরনের হেলিকপ্টার তৈরি করে লিওনার্দো। লিওনার্দোর তৈরি অনেক সামরিক এবং বেসামরিক হেলিকপ্টার রয়েছে বেস্ট সেলিং এর তালিকায়। লিওনার্দো তৈরি কয়েকটি সামরিক হেলিকপ্টার রয়েছে যেগুলো বিশ্বের দ্রুত গতির হেলিকপ্টারের তালিকায় রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামরিক ও সিভিলিয়ান শাখায় রয়েছে লিওনার্দো তৈরি নানা ধরনের হেলিকপ্টার।

হেলিকপ্টারের ক্ষেত্রে লিওনার্দোর একটি ব্যতিক্রমী উদ্ভাবনী এ ডব্লিউ বা অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড ৬০৯ । এটি একটি হেলিকপ্টার কাম বিমান। বিমান এবং হেলিকপ্টার উভয়ের বৈশিষ্ট্য সমন্বয় ঘটানো হয়েছে এতে। এ হেলিকপ্টারটি বিমানের গতিতে আকাশে উড়তে পারে। আবার হেলিকপ্টারের মত ভার্টিক্যাল টেকঅফ ও ল্যান্ডিং করতে পারে।

সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ৫১০ কিলোমিটার। এটি দেখতেও সম্পূর্ণ বিমানের মত। কিন্তু এর ওঠা নামার জন্য কোনো রানওয়ের প্রয়োজন হয় না। এতে রয়েছে প্রেসারাইজড ক্যাবিন। ফলে খারাপ আবহাওয়ায় এবং দিনে রাতে চলতে সক্ষম এটি। ২৫ হাজার ফিট উচ্চতায় উড়তে পারে এ বিমান কাম হেলিকপ্টার।

এ ধরনের হেলিকপ্টার এর আগে উদ্ভাবন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর নাম বেল বোয়িং ভি-২২ অসপ্রে। লিওনার্দোর তৈরি অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড ৬০৯ টিলট্রোটর প্রথম আকাশে ওড়ে ২০০৩ সালে। ভিআইপিদের চলাফেরার জন্য তৈরি করা হয়েছে এ এয়ারক্রাফট। ছোট এ এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিন সংখ্যা দুটি। সর্বোচ্চ যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ১২ জন।

লিওনার্দোর অন্যতম বেস্ট সেলিং হেলিকপ্টার অগস্টা ওয়েস্ট ল্যান্ড ১০১ মার্লিন। এর সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ৩০৯ কিলোমিটার। বিশ্বের অন্যতম দ্রুত গতির এ হেলিকপ্টার ৩৮ জন সৈন্য, মিসাইল, টরপেডো, সৈনিকদের নিজ নিজ অস্ত্রসহ আরো বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্র বহনে সক্ষম একই সাথে। এর ইঞ্জিন সংখ্যা তিনটি। প্রতিটি ইঞ্জিনের ক্ষমতা ২ হাজার ২৭০টি হর্স পাওয়ারের সমান। ১৫ হাজার ফিট উচ্চতায় উড়তে সক্ষম এ হেলিকপ্টার।

লিওনার্দোর আরেকটি শক্তিশালী সামরিক হেলিকপ্টার হলো এ ডব্লিউ বা অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড ১৩৯ এম। এর গতি ঘন্টায় ৩০৬ কিলোমিটার। বাংলাদেশসহ প্রায় ৫০টি দেশে রয়েছে অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড ১৩৯ সামরিক হেলিকপ্টার। উউকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের কাছে ৪টি অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড ১৩৯ হেলিকপ্টার রয়েছে। বাংলাদেশ নেভির কাছে ২টি অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড ১০৯ বহুমুখী হেলিকপ্টার রয়েছে। এরও ইঞ্জিন সংখ্যা ২টি। সৈন্য বহন ক্ষমতা ৮ জন। এ ছাড়া বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের কাছে ২টি অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড ১১৯ হেলিকপ্টর রয়েছে। এটি প্রশিক্ষন হেলিকপ্টার।

চীন, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার কাছেও রয়েছে লিওনার্দোর অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড ১৩৯ হেলিকপ্টার। অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড ১৩৯ এর ইঞ্জিন সংখ্যা ২টি। ১৫ জন সৈন্য বহন করতে পারে এটি। ইতালি ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ায়ও যৌথভাবে নির্মান করে এ হেলিকপ্টার। ২০০৩ সালে সার্ভিসে যুক্ত হওয়ার পর অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড সিরিজের মধ্যে অন্যতম বেস্ট সেলিং হেলিকপ্টারে পরিণত হয় এটি।

লিওনার্দোর অপর শক্তিশালী সামরিক হেলিকপ্টারের মধ্যে রয়েছে অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড ১৪৯, অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড ১০৯ এলইউএইচ, অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড ১৫৯, ১৬৯ প্রভৃতি। লিওনার্দোর আরেকটি বেস্ট সেলিং হেলিকপ্টার হলো এনএইচ ৯০। ইউরোপের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় হেলিকপ্টার কর্মসূচী এটি।

সারা বিশ্বের সামরিক বাহিনীর চাহিদা পূরণকে সামনে রেখে লিওনার্দো নির্মাণ করছে অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ছাড়া ইউরোপের ১০টির অধিক দেশ ব্যবহার করছে এ হেলিকপ্টার। এটি একই সাথে টেকটিক্যাল ট্রান্সপোর্ট এবং নেভল ভার্সন এর সমন্বয়। এর ইঞ্জিন সংখ্যা ২টি।

ইতালি ছাড়া লিওনার্দোর গুরুত্বপূর্ণ অফিস রয়েছে যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র. ফ্রান্স এবং জার্মানি। লিওনার্দোর শতভাগ মালিকানায় ১০টির অধিক সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান এবং আংশিক মালিকানায় ১৫টি যৌথ সমরাস্ত্র তৈরি প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেশ ও বিদেশে।

বৃটেনের বিএই সিস্টেমের সাথে যৌথভাবে ইউরো ফাইটার, এয়ারবাস গ্রুপের সাথে সুপারসনিক বহুমুখী টাইফুন, এমবিডিএর সাথে মিসাইল, তালেজপাজিও এবং থেলস আলেনিয়া সেস্প ইন্ডাস্ট্রির সাথে যৌথভাবে স্পেস সিস্টেম, স্যাটেলাইট লঞ্চ ম্যানেজমেন্ট, স্যাটেলাইট নেভিগেশন সিস্টেম তৈরি করে। বিশ্বের অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠানের সাথে লিওনার্দো সমরাস্ত্র তৈরি করে যৌথভাবে। এমবিডিএ, তালেজপাজিও, থেলস আলেনিয়া স্পেস এর মালিকানা রয়েছে লিওনার্দোর। সামরিক পরিবহন বিমানের ক্ষেত্রে লিওনার্দোর সি-২৭ জে এবং এমসি-২৭ জে গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন বিমান। এটিআর ৪২ এমপি, এটিআর ৭২ এমপি লিওনার্দোর সমুদ্র এবং স্থলে বহুমুখী সার্ভিলেন্স বিমান।

লিওনার্দোতে ইতালি সরকারের ৩০ ভাগ মালিকানা রয়েছে। আর এটিই একভাবে সবচেয়ে বড় শেয়ার মালিকানা। লিওনার্দোতে ২ শতাংশ মালিকানা রয়েছে লিবিয়ার। লিওনার্দো প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৪৮ সালে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে