রাশিয়ান বেস্টসেলিং আর্মস

বিশ্বে যত সমরাস্ত্র বিক্রি হয় তার ২১ ভাগ বিক্রি করে রাশিয়া - ইন্টারনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৪:৫৯

রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ সমরাস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। রাশিয়ার আয়ের দ্বিতীয় উৎস অস্ত্র বিক্রি। রাশিয়ার জনগণের বিরাট একটি অংশ নিয়োজিত সমরাস্ত্র শিল্পে। রাশিয়ার সমরাস্ত্র শিল্প কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টর। বিশ্ব সমরাস্ত্র বাজারে অন্যতম দেশ রাশিয়া। ২০১৮ সালে রাশিয়া ১৯ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রির্সাস ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুসারে বর্তমানে বিশ্বে যত সমরাস্ত্র বিক্রি হয় তার ২১ ভাগ বিক্রি করে রাশিয়া।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর রাশিয়ার সামরিক বাজেট ছয় ভাগের এক ভাগে নেমে আসে রাশিয়ার। ধ্বস নামে সমরাস্ত্র শিল্প আর অস্ত্র বিক্রি খাতে। অর্থ আর রক্ষাণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে যায় রাশিয়ান অনেক মূল্যবান সমরাস্ত্র। এসময় রাশিয়া হারায় তার অনেক বড় বড় সমরাস্ত্র ক্রেতা।

চরম দুরবস্থা কাটিয়ে রাশিয়া অনেকটাই আবার ফিরে এসেছে পূর্বের অবস্থানে। রাশিয়া এখন আবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বের সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বদ্বীতে পরিণত হয়েছে। সমরাস্ত্রের ক্ষেত্রেও কয়েকটি দিক দিয়ে রাশিয়া এখন বিশ্ব সেরা এবং অনেক পেছনে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে মিসাইল সিস্টেমে।

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর অবিশ্বাস্য শক্তির মিসাইলের অধিকারী রাশিয়া। শব্দের চেয়ে ২৭ গুন শক্তির এ মিসাইল প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিশ্বের কোনো দেশের কাছে নেই। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার মতে রাশিয়ান এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে অ্যাডভান্সড আর বেস্ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম।

অপর দিকে রাশিয়ার কাছে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাবমেরিন। সোভিয়েত আমল থেকে এখন পর্যন্ত রাশিয়া যত সাবমেরিন তৈরি করেছে বিশ্বের সব দেশ মিলেও তত সাবমেরিনের অধিকারী হতে পারেনি এখনো। শক্তিশালী যুদ্ধ বিমানের দিক দিয়েও রাশিয়া সমানতালে এগিয়ে চলছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। বিশ্ব সমরাস্ত্র বাজারে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পর রাশিয়ার নাম।

বর্তমানে বিশ্ব সমরাস্ত্র বাজারে রাশিয়ার বেস্টসেলিং কয়েকটি অস্ত্র হলো এসইউ সিরিজের যুদ্ধ বিমান, মিগ, এটাক হেলিকপ্টার, পরিবহন হেলিকপ্টারসহ বিভিন্ন ধরনের হেলিকপ্টার, এস-৩০০ ও এস -৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম, সাবমেরিন, ট্যাঙ্ক, ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভিহিক্যালস, আরমারড পারসোনেল ক্যারিয়ার, কালাশ্ নিকভসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচলিত অস্ত্র।

বর্তমানে সমরাস্ত্র বাজারে আলোচিত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হলো রাশিয়ার এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম। এটি মূলত এন্টি এয়ারক্রাফট মিসইল সিস্টেম। এর আওতা ৪০০ কিলোমিটার। যুক্তরাষ্ট্রের বি-১, বি-২, বি-৫২, এফ-৩৫, এফ-২২, এফ-১৬সহ সারা বিশ্বের বর্তমান সকল শক্তিশালী যুদ্ধ বিমানকে চ্যালেঞ্জ করে রাশিয়া তৈরি করেছে এ মিসাইল সিস্টেম। এ ছাড়া টোমাহক ক্রুজ মিসাইল, ব্যালিস্টিক মিসাইলও টার্গেট এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম এর।

এস-৪০০ মিসাইল ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য। রাশিয়ার তৈরি এস-৩০০ মিসাইল সিস্টেম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঠান্ডা লড়াই চলকালে গেম চেঞ্জারের ভ‚মিকা পালন করে। এস-৩০০ মিসাইল শত্রুপক্ষের বিমান চিহ্নিত করতে পারে। এক সাথে অনেকগুলো লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম এ মিসাইল। এস-৩০০ মিসাইল সিস্টেমে এক সাথে স্বল্প ও দূর পাল্লার মিসাইল নিক্ষেপ করা যায়। ফলে এটি এক সাথে এন্টি এয়ারক্রাফট রাইফেল ও শটগানের ভূমিকা পালন করতে পারে ।

এস-৩০০ মিসাইলেরই উন্নত ভার্সন হলো এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম। এস-৩০০ মিসাইলের যে ক্ষমতা আরো বাড়িয়ে এর মাধ্যমে চার ধরনের মিসাইল ছোড়ার সক্ষম করা হয়েছে। এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম রাশিয়ান আর্মিতে যুক্ত হয় ২০০৭ সালে। রাশিয়া ছাড়া বর্তমানে আলজেরিয়া, চীন, তুরস্ক, বেলারুশের কাছে রয়েছে এ মিসাইল। ভারত, সৌদি আরবসহ আরো অনেক দেশ এ মিসাইল সংগ্রহের পথে।

রাশিয়ার সমরাস্ত্র বিক্রির শীর্ষে রয়েছে যুদ্ধ বিমান। রাশিয়া বর্তমানে অস্ত্র বিক্রি বাবদ যে আয় করে তার প্রায় ৪০ ভাগ আসে এভিয়েশন সেক্টর থেকে। ২০১২ সালে রাশিয়া ১৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে তার ৩৭ ভাগ ছিল এভিয়েশন সেক্টরের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রধান যুদ্ধ বিমান রাশিয়ার তৈরি সুখোই এসইউ সিরিজের বিভিন্ন বিমান। রাশিয়ার কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে চীন ও ভারত এ বিমান তৈরি করছে।

রাশিয়া সুখোই এসইউ সিরিজের ২৭ ধরনের যুদ্ধ বিমান তৈরি করেছে। এসইউ-২ থেকে এসইউ- ৫৭ নামে বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ বিমান, বোমারু বিমান রয়েছে এ সিরিজে। এসইউ সিরিজে রয়েছে অনেক সুপারসনিক যুদ্ধ বিমান। এসইউ সিরিজের সবচেয়ে শক্তিশালী বিমান বর্তমানে এসইউ-৫৭। এটি একটি সুপারসনিক বিমান । হাইপারসনিক মিসাইল ছুড়তে সক্ষম এ বিমান । হাইপারসনিক মিসাইলে থাকবে পারমানবিক বোমা। এসইউ সিরিজের ১৩ হাজারের অধিক বিমান তৈরি করেছে রাশিয়া। এ বিমান প্রথম আকাশে ওড়ে ১৯৩৭ সালে।

সমরাস্ত্র বাজারে আরেকটি বেস্ট সেলিং হচ্ছে রাশিয়ান কেএ-৫২ অ্যালিগেটর, এমআইসহ বিভিন্ন ধরনের হেলিকপ্টার। কামভ ৫২ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপাচি হেলিকপ্টারের সমান ক্ষমতা রয়েছে এর। এর গতি ঘন্টায় ১৮৬ মাইল। এতে ট্যাঙ্ক বাস্টার, ৩০ মিলিমিটার গান, ৮০ মিলিমিটার আনগাইডেড রকেট এন্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল সজ্জিত।

বর্তমানে ৬০টির বেশি দেশে সমরাস্ত্র রপ্তানি করে রাশিয়া। রাশিয়ার অস্ত্রের প্রায় অর্ধেক বিক্রি করে দক্ষিন পূর্ব এশিয়া ও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোতে। এরপর রাশিয়ান অস্ত্রের বড় বাজার হলো মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা। ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত রাশিয়ান অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা ছিল ভারত। একসময় চীন এবং ভারত ছিল রাশিয়ান অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা। এখনো রাশিয়ান অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা ভারত। তবে সম্প্রতি ভারতের রাশিয়ান অস্ত্র ক্রয় কমেছে। বর্তমানে রাশিযার অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা দেশ হলো ভারত, মিশর, ইরাক, ভিয়েতনাম, তুরস্ক, আলজেরিয়া, গ্রিস, চীন, ইনন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, কম্বোডিয়া, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, সৌদি আরব, বাংলাদেশ প্রভৃতি।

স্টকহোম সংস্থার তথ্য অনুসারে বাংলাদেশও রাশিয়ার কাছ থেকে ২০১৫ সালে ৬টি এমআই-৮ ও এমআই-১৭ পরিবহন হেলিকপ্টার ক্রয় করে। ২০১৭ সালে এগুলো বাংলাদেশ বুঝে পায়। এরপর ২০১৭ সালে আরো ৫টি হেলিকপ্টার কেনে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছ থেকে ৩৪০টি বিটিআর-৮০ এমফিভিয়াস আরমারড পারসোনেল ক্যারিয়ার কেনে যা ২০১৬-১৭ সালে ডেলিভারি পায়।

ভিয়েতনাম বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। ২০০০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনাম তার ৮০ ভাগ অস্ত্র কিনেছে রাশিয়ার কাছ থেকে। সম্প্রতি ভিয়েতনাম রাশিয়ার কাছ থেকে ১২টি এসইউ-৩৫ ফাইটার জেট ক্রয় করে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালে ভিয়েতনাম রাশিয়ার কাছ থেকে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে ৬টি কিলো ক্লাস টাইপ ৬৩৬ সাবমেরিন সংগ্রহ করে। মায়ানমারও তার ৮০ ভাগ অস্ত্র কেনে রাশিয়ার কাছ থেকে। সৌদি আরব ২০১৭ সালে রাশিয়ার সাথে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার অস্ত্র ক্রয় চুক্তি করে।

আফ্রিকা মহাদেশে বর্তমানে যত অস্ত্র বিক্রি হয় তার অর্ধেক বিক্রি করে রাশিয়া। এর পরিমান যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের দ্বিগুন করে। চীন ২০১৬-১৭ সালে ২ বিলিয়ন ডলারে রাশিয়ার কাছ থেকে ২৪টি এসইউ-৩৫ যুদ্ধ বিমান কেনে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে ৩ বিলিয়ন ডলারে ৬টি এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম কিনেছে।

দি ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট এর তথ্য অনুসারে ভারত ২০১৮ সালে রাশিয়ার সাথে ৫ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র ক্রয় চুক্তি করে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে ভারত সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয় অনুমোদন দিয়েছে এবং এসব অস্ত্র মূলত তারা ক্রয় করবে রাশিয়া থেকে। এর মধ্যে রয়েছে ৩৩টি মিগ-২৯ ও এসইউ-৩০ যুদ্ধ বিমান । গত কয়েক বছরে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে এক হাজারের বেশি টি-৯০ ব্যাটল ট্যাঙ্ক সংগ্রহ করেছে।

রাশিয়ার কাছ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারে ৫টি এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম সংগ্রহের জন্য ২০১৭ সালে চুক্তি করেছে ভারত। এ ছাড়া একটি আকুলা ক্লাস টাইট ৯৭১ সাবমেরিন কিনেছে যা ২০২২ সালে পাওয়ার কথা।

২০১৬ থেকে ২০১৭ আলজেরিয়ার রাশিয়ার কাছ থেকে ৫০টি হেলিকপ্টার সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৪২টি এমআই-২৮ কমব্যাট হেলিকপ্টার এবং ৮টি এমআই-২৬ পরিবহন হেলিকপ্টার। এছাড়া সম্প্রতি ২টি কিলো ক্লাস সাবমেরিনও কিনেছে আলজেরিয়ার রাশিয়ার কাছ থেকে। মিশর ২০১৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে ৫০টি মিগ-২৯ যুদ্ধ বিমান এবং ৪৬টি কামভ-৫২ কমব্যাট হেলিকপ্টার সংগ্রহ করে।

রাশিয়ান মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স পুনর্গঠনের ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়ান সরকার। এ লক্ষ্যে তারা ৭৫০ বিলিয়ন রুবেল ঋনের অর্ধেক মাফ করে দেবে। সিরিয়া যুদ্ধে রাশিয়ার অংশ গ্রহনের ফলে বিশ্ব বাজারে রাশিয়ান সমরাস্ত্রের একটি ভাল বিজ্ঞাপন হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। সিরিয়া যুদ্ধে রাশিয়া তাদের বিভিন্ন অস্ত্রের সক্ষমতা পরীক্ষা নীরিক্ষার সুযোগ পেয়েছে এবং বিশ্ব বাজারে রাশিয়ার অস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।

রাশিয়ান সমরাস্ত্র শিল্পে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নিয়োজিত। রাশিয়ান শিল্প খাতের মোট জনশক্তির ২০ ভাগ নিয়োজিত সমরাস্ত্র শিল্পে। রাশিয়ান ২০টি বড় সমরাস্ত্র শিল্পের বার্ষিক আয় ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। রাশিয়ার সবচেয়ে বড় শিপবিল্ডিং ইন্টাস্ট্রির নাম সেভম্যাশ। এটি বর্তমানে রাশিয়ার একমাত্র পারমানবিক সাবমেরিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয় দেড় বিলিয়ন ডলারের বেশি।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে