দক্ষিণ চীন সাগরে শক্তিশালী মিসাইল ছুড়েছে চীন

চীনা মিসাইল ডিএফ-২১ডি - ইন্টারনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৪:৫৮

দক্ষিণ চীন সাগরে শক্তিশালী দুটি ব্যালেস্টিক মিসাইল ছুড়েছে চীন। চীনের এ মিসাইল বিমানবাহী রনতরী ধ্বংসকারী বা ‘এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার কিলার’ নামে পরিচিত। চীনা এ মিসাইলের নাম ডিএফ-২১ডি এবং ডিএফ-২৬ বি।

পরমাণু এবং প্রচলিত উভয় ধরনের বোমা বহন করতে পারে এ মিসাইল। চীন এ মিসাইলের মহড়া চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে। গত দুই মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র কয়েকবার বড় আকারে নৌ মহড়া চালিয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরে। এর প্রেক্ষিতে চীনা এ ব্যালেস্টিক মিসাইল পরীক্ষা সাগরে চীন-যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনার নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মাঝারি পাল্লার আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র ডিএফ-২৬ বি ছোড়া হয়েছে কিংহাই প্রদেশ থেকে। আর মাঝারি পাল্লার আন্তমহাদেশীয় ডিএফ-২১ডি ক্ষেপনাস্ত্র ছোড়া হয়েছে ঝিজিয়াং প্রদেশ থেকে। দুটি ক্ষেপনাস্ত্রই ছোড়া হয়েছে ২৬ আগস্ট। মিসাইল দুটি হাইনান প্রদেশ এবং প্যারাসেল আইল্যান্ডস এর মধ্যবর্তী এলাকায় ছোড়া হয়েছে।

চীন ঘোষিত নো ফ্লাই জোনে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিমানের টহল এবং দক্ষিণ চীন সাগরে উপর্যপুরি মহড়ার জবাবে চীন এ মিসাইল মহড়া চালিয়েছে। ইউ-২ নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্পাই প্লেন গত ২৫ আগস্ট বারবার চীনা নো ফ্লাই জোনে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করে।

এসময় চীনের নৌ মহড়া চলছিল এবং মহড়ায় লাইভ ফায়ারিং চালানো হয় বোহাই সাগরে।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র মুখপাত্র কর্ণেল উ কিয়ান বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এ গোয়েন্দা বিমানের কারণে চীনের স্বাভাবিক মহড়া এবং প্রশিক্ষন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয় । চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মেরিটাইম সেফটি এবং রুলস অব বিহেভিয়ার লঙ্ঘন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একইভাবে তারা আন্তর্জাতিক নীতিও লঙ্ঘন করেছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে চীনের ছোড়া দুটি মিসাইলের শক্তি পরীক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্র। অপর দিকে পেন্টাগণ স্বীকার করেছে চীনা ঘোষিত নো ফ্লাই জোনে তাদের গোয়েন্দা বিমান নজরদারি চালিয়েছে। পেন্টাগনের দাবি, তবে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে এই নজরদারি করা হয়েছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয় বলছে ডিএফ-২৬ বি মিসাইল পরমানু এবং প্রচলিত উভয় ধরনের বোমা বহন করতে সক্ষম। আর সাগর এবং স্থল উভয় ক্ষেত্রে এ মিসাইল নিখুঁতভাবে সঠিক নিশানায় আঘাত করতে পারে।

ডিএফ-২৬ এর আওতা ২ হাজার ৮০০ মাইল। ফলে এটি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাটি গুয়াম দ্বীপ, দিয়েগো গার্সিয়া, অস্ট্রেলিয়ার ডারউইন শহরসহ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন লক্ষ্য বস্তু এ মিসাইলের আওতায় রয়েছে।

চীনের ডিএফ-২৬ বি বিমানবাহী রণতরী বা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার কিলার হিসেবে পরিচিত। এ মিসাইল সাগরে চলমান রণতরীতে আঘাত হানতে সক্ষম। একটি মিসাইল আক্রমন করে একটি বিমানবাহী রণতরী ধ্বংসের লক্ষ্য নিয়ে চীন উদ্ভাবন করেছে এ মিসাইল। ডিএফ-২৬ এর মত ডিএফ-২১ ও একটি এন্টি শিপ ব্যালেস্টিক মিসাইল এবং সমুদ্রে চলমান রণতরীতে আঘাত পরিচালনা করতে পারে।

চীনের নৌ মহড়া এবং মিসাইল ছোড়া বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মার্ক এসপার বলেছেন আন্তর্জাতিক আইন মানার বিষয়ে চীন বার বার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে। দক্ষিণ চীন সাগরের অধিকাংশ এলাকা চীন দখল করার চেষ্টা করছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
তিনি আরো বলেন, প্রশান্ত মহাসাগরে নেতৃত্বের দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের। অন্য দেশের কাছে এক ইঞ্চিও ছেড়ে দেয়া হবে না। চীন আন্তর্জাতিক আইন, নিয়ম নীতি মানতে রাজি নয় তারা বিশ্বকে তাদের শক্তি দেখাতে চাইছে।

এসপার বলেন, চীনা আর্মি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিয়োজিত রয়েছে । আর এই শতকের মাঝামাঝি চীনা আর্মিকে ওয়ার্ল্ড ক্লাস আর্মিতে রুপান্তরের লক্ষ্যে আগ্রাসী আধুনিকায়ন পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। আর এর ফলে দক্ষিন এবং পূর্ব সাগরে চীনা আর্মির উসকানীমূলক কার্মকান্ড বৃদ্ধি পাবে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে চীনের ২৪টি প্রতিষ্ঠানকে কালোতালিকাভূক্ত করছে যুক্তরাষ্ট্র। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সামরিক কার্যক্রমের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র এ উদ্যোগ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ দক্ষিণ চীন সাগরে বিতর্কিত বিভিন্ন দ্বীপে সামরিক স্থাপনা নির্মাণে এসব প্রতিষ্ঠান চীনের পিপলস আর্মিকে সহায়তা করছে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে পুরনো বিরোধের মধ্যে এই মিসাইল পরীক্ষা উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দক্ষিণ চীন সাগরের অধিকাংশ এলাকার ওপর চীনা দাবিকে বে আইনী আখ্যায়িত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। পেট্রোলিয়াম সমৃদ্ধ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা দাবি নিয়ে বিরোধ চলছে ব্রুনাই, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনামের সাথে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ দক্ষিণ চীন সাগরের তেল গ্যাসের ওপর এসব দেশকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে চীন। এসব দেশের তেল গ্যাস উত্তোলনে বাধা সৃষ্টি করছে চীন।

দক্ষিণ চীন সাগর দিয়ে বছরে তিন লাখ কোটি ডলারের পন্য বহন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে চীনা দূতাবাসের মুখপাত্র জানিয়েছেন, দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বীপগুলো চীনা ভূখন্ডের অংশ। আর সেখানে সামরিক স্থাপনা তৈরি ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন আমাদের পূর্ণ অধিকার। চীনা ভূখন্ডের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চীন সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

গত জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বিমানবাহী রণতরী একসাথে টহল শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরে। গত তিন বছরের মধ্যে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে এক সাথে যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বিমানবাহী রণতরীর অভিযানে নামার ঘটনা এই প্রথম। এ ঘটনায় নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম তখন জানায় এ অঞ্চলে স্বার্থ রক্ষায় চীন পিছপা হবে না। বিমানবাহী রণতরী রোনাল্ড রিগান, থিওডর রুজভেল্ট এবং ইউএসএস নিমিটজ মহড়ায় অংশ নেয়।

মহড়ার সময় প্রত্যেকটি বিমানবাহী রণতরীতে মোতায়েন রাখা হয় ৬০টির অধিক শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান। তিনটি বিমানবাহী রণতরীর সমর্থনে রয়েছে বেশ কয়েকটি শক্তিশালী নেভি ক্রুজার, ডেস্ট্রয়ার এবং কয়েক ডজন অন্যান্য রণতরী।

২০১৭ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে আর এত বড় আকারে সমুদ্র টহলের আয়োজন করেনি। ২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়া হুমকি দেয় প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের গুয়াম দ্বীপ আক্রমনের। এতে করে উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র তখন এ অঞ্চলে বড় ধরনের শক্তি প্রদর্শনের আয়োজন করে। জুন মাসে বিশাল এ মহড়া পরিচালনার পর ৪ জুলাই দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বিমানবাহী রণতরী আবারো মহড়া পরিচালনা করে।

এরপর ১৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও ঘোষণা দেন দক্ষিন চীন সাগরের অধিকাংশ এলাকা চীন নিজেদের বলে যে দাবি করছে তা বেআইনী। এ ঘোষণার দুই দিনের মাথায় ১৫ জুলাই চীন বিতর্কিত এ এলাকার দ্বীপে উডি দ্বীপে চারটি শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান মোতায়েন করে।

৪ জুলাই দক্ষিন চীন সাগরে মহড়ার মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে ১৭ জুলাই দক্ষিন চীন সাগরে আবারো দ্বৈত মহড়া চালায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রনতরী। ইউএসএস প্যাসিফিক ফ্লিটের বিবৃতিতে বলা হয়েছে তড়িৎ সাড়া দানের অংশ হিসেবে এ দুটি ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রস্তুত রয়েছে।

মার্কিন ইউ-২। ছবি : সিএনএন
মার্কিন ইউ-২। ছবি : সিএনএন

 

জুলাই মাসে দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র যে মহড়া পরিচালনা করে ২০১৪ সালের পর এ এলাকায় এটি ছিল তাদের এ ধরনের এ ধরনের বড় মহড়া। আর আগে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের মহড়া পরিচালনা করে ২০০১ সালে। ফ্রিডম অব নেভিগেশনের নামে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিন চীন সাগর, তাইওয়ান প্রণালীসহ বিভিন্ন এলাকায় এভাবে অপারেশন পরিচালনা নিয়ে চীন যুক্তরাষ্ট্র উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে।

দক্ষিণ চীন সাগরে পরিচালিত মহড়ায় অংশ নেয়া বিমানবাহী রণতরীকে কাগুজে বাঘ আখ্যায়িত করেছে চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস। চীনের দাবি যুক্তরাষ্ট্রের এসব বিমানবাহী রণতরী ডুবিয়ে দেয়ার মতো মিসাইল রয়েছে তাদের কাছে। এই প্রতিবেদনে ডিএফ-২১ এবং পিএফ২৬ মিসাইলের নাম উল্লেখ করা হয়।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে