চীন-মার্কিন সম্পর্কের নানা ঘটনা প্রবাহ নিয়ে ওয়ার্ল্ড মিডিয়ার খবর দেখলে মনে হতে পারে, এই বুঝি দু'দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগে গেলো। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তেমন-কিছু ঘটে না। কী করে যুদ্ধ এড়ায় চীন তা নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।
পর্যবেক্ষকরা দেখতে পেয়েছেন, চীন ব্যাপকভাবে অ্যান্টি-অ্যাকসেস বা এরিয়া ডিনায়াল উইপন ব্যবহার করে, যার ফলে আমেরিকার কাছে যুদ্ধটা হয়ে ওঠে অবাস্তব।
অ্যান্টি-অ্যাকসেস বা এরিয়া ডিনায়াল উইপন সিস্টেম হচ্ছে একটি ডিভাইস বা কৌশল, যা জলে-স্থলে-আকাশে কোনো স্থান দখল থেকে শত্রুকে ঠেকিয়ে রাখে।
ব্যাপারটা বোঝার জন্য আমরা স্বল্প সময়ের জন্য ফিরে যাই ১৯৭৬ সালে। সে-বছর টোকিওতে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী ও ক্যারাটে মাস্টার অ্যান্টনিও ইনোকির মধ্যে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইনোকিকে আলীর জোড়া পায়ের প্রায়-সব আঘাত ঠেকাতে দেখা যায় নিজের পিঠ দিয়ে। তিনি আলীকে কিক মারেন গোটা দুই এবং তা-ই এত প্রচন্ড ছিল যে তা আলীর রক্তে দু'টি ক্লট এবং এমন ইনফেকশন সৃষ্টি করে যে তাঁর একটি পা-ই কেটে বাদ দেয়ার উপক্রম হয়। সেবার ম্যাচটি ড্র ঘোষিত হয়। আর্কাইভে রক্ষিত ফুটেজেও দেখা যায় আলী কিভাবে ইনোকি-র জোড়া পায়ের কিক থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছেন।
ক্যারাটে মাস্টার ইনোকি যেভাবে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলীকে ঠেকিয়েছিলেন, আমেরিকাকে ঠেকাতে একই কৌশল নিয়েছে চীনও। আমেরিকাকে তার সুপিরিয়র ফোর্স নিয়ে নিজের খুব কাছাকাছি আসা অসম্ভব করে তুলতে চায় চীন।
বড় শক্তিগুলো এখন এবং সম্ভবত এযাবৎ যত স্থলবাহিনী মোতায়েন করেছে, চীনের পিপলস লিবারেশ আর্মি বা পিএলএ তাদের মধ্যে সবচাইতে কম-প্রশিক্ষিত ও কম অস্ত্রসজ্জিত। পিএলএ তার একজন পদাতিক সৈন্যকে অস্ত্রসজ্জিত করতে ব্যয় করে মাত্র দেড় হাজার মার্কিন ডলার, যা একটি রাইফেল ও একটি ইউনিফর্মের দামের চাইতে কিছু বেশি। বিপরীতে একজন মার্কিন পদাতিক সৈন্যের জন্য এ কাজে ব্যয় হয় ১৮ হাজার ডলার।
চীনের ট্যাঙ্কগুলো মাঝারি মানের। এগুলো আমেরিকা ও রাশিয়ার নতুন সাঁজোয়া যানের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না। পিএলএ-র বিমান বাহিনীতে নেই কোনো ডেডিকেটেড গ্রাউন্ড-অ্যাটাক এয়ারক্র্যাফট, যেমন আমেরিকার আছে এ-১০ ওয়ারথগ কিংবা রাশিয়ার এসইউ-২৫। তাইওয়ান দখলের জন্য চীনের ৩০ হাজার নৌসেনা এবং ৬০ হাজার সমুদ্রবাহিত মেকানাইজড ইনফ্যান্ট্রি সদা প্রস্তুত। কিন্তু যুদ্ধের গোড়াতেই যদি ব্যাপক বোমাবর্ষণ করা হয়, তাহলে তাইওয়ান দেশটির কিছু অবশিষ্ট থাকবে কি?
আমেরিকার তুলনায় চীনের দ্রুত মোতায়েনযোগ্য বাহিনীর সংখ্যাও একেবারেই নগণ্য। চীনের স্পেশ্যাল ফোর্সের সৈন্যসংখ্যা সাত হাজার থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে। পক্ষান্তরে আমেরিকার চলতি প্রতিরক্ষা বাজেটে এ সংখ্যা ধরা হয়েছে প্রায় ৬৬ হাজার।
তবে উপকূল প্রতিরক্ষায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে চীন। তারা উদ্ভাবন করেছে স্থল থেকে জাহাজে আঘাত হানতে সক্ষম একটি নতুন ক্ষেপণাস্ত্র। ডিএফ-২৬ নামের এ ক্ষেপণাস্ত্রটি ২০১৮ সালে প্রথম প্রদর্শন করা হয়। এর অভিনবত্বে চমকিত সংবাদমাধ্যম এর নাম দিয়েছে ''ক্যারিয়ার কিলার''।
যতদূর জানা যায়, ডিএফ-২৬ নামের ক্ষেপণাস্ত্রটি আড়াই হাজার মাইল দূর থেকেই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। গুয়ামে মার্কিন সামরিক স্থাপনায় হামলা চালানোর জন্য এটুকু আওতাই যথেষ্ট। চীনের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো হামলা চালানোর সময় বায়ুমন্ডলের স্তর স্ট্রাটোস্ফিয়ার থেকে খাড়াভাবে নেমে আসে। মার্কিন জাহাজ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এ ধরনের হামলা ঠেকানোর উপযোগী করে নির্মিত নয়।
এছাড়া চীনের আছে ডিএফ-জেডএফ হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিক্যাল, যা ডিএফ-১৭এর মতো ভারী ক্ষেপণাস্ত্র বহন করে দ্রুত বেগে চলতে এবং বিদ্যমান যে-কোনো অ্যান্টি-মিসাইল সিস্টেমকে হারিয়ে দিতে সক্ষম।
ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে কিংবা অবস্থান নির্ণয় করা যায় না এমন ডিজেল-বিদ্যুৎচালিত সাবমেরিনের সাহায্যে চীনারা আমেরিকান জাহাজ ডুবিয়ে দিতে পারে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। সমস্যাটা হলো, বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার একটাই মাত্র পথ খোলা আছে, সেটি হলো যুদ্ধ।
বছরখানেক আগে সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনাইটেড স্টেটস স্টাডিজ সেন্টার এ বিষয়ে একটি কড়া মূল্যায়ন উপস্থাপন করে। এতে বলা হয় : ''এসব নিখুঁত লক্ষ্যভেদী দূরপাল্লার মিসাইল পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র ও অংশীদারদের প্রায়-সব ঘাঁটি, বিমানক্ষেত্র, সমুদ্রবন্দর ও সামরিক স্থাপনার জন্য হুমকিস্বরূপ। যে-কোনো সংঘাতের শুরুতে এগুলোকে অকার্যকর করে ফেলা না-গেলে চীনা মিসাইলগুলো গোটা অঞ্চলে আমেরিকার অবাধ চলাচলের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।''
মূল্যায়নটিতে আরো বলা হয়, ''চতুর্থ প্রজন্মের বিপুলসংখ্যক জঙ্গি জেট বিমান, অত্যাধুনিক সি৪আইএসআর সিস্টেম, আধুনিক অ্যাটাক সাবমেরিন, ইলেক্ট্রনিক যুদ্ধক্ষমতা এবং অসংখ্য সফিস্টিকেটেড সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল - এসবই চীওনর পিপলস লিবারেশন আর্মিকে দিয়েছে এমন সক্ষমতা যে, স্থলে ও আকাশে শত্রুর সব চলাচলই হবে তার আক্রমণের আওতায়।''
এতে বলা হয়, ''দক্ষিণ চীন সাগরে চীন তৈরী করেছে মিলিটারি আউটপোস্টের একটি নেটওয়ার্ক। সেখানে আছে অত্যাধুনিক রেডার, মিসাইল ব্যাটারি এবং জঙ্গি বিমান। এসব ওই জলপথে আমেরিকা ও তার মিত্রদের জন্য আরো বড় হুমকি সৃষ্টি করেছে।''
তবে এটা নিশ্চিত, চীনের সামরিক ক্ষমতার অনেক কিছুই এখনও বাকি বিশ্বের অজানা। মার্কিন পর্যবেক্ষকদের কেউ-কেউ মনে করেন, আমেরিকান নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ও উড়োজাহাজের জন্য চীনের জে-২০ স্টেলথ জঙ্গি বিমানই কার্যকর ওয়েপন প্ল্যাটফর্ম; অন্যগুলো তেমন আহামরি কিছু নয়।
এর মানে দাঁড়ালো এই যে, আকাশে ডগফাইট বা মুখোমুখি সংঘর্ষে চীনা জঙ্গি বিমানগুলো এফ-১৮ বা এফ-৩৫কে পরাজিত করতে পারবে না। চীনাদের যেটা প্রয়োজন হবে সেটা হলো, মার্কিন বাহিনীকে চীনের কাছ থেকে দূরে রাখা এবং তাইওয়ানে মার্কিন সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধিকে কঠিন করে তোলা।
২০০৮ সালে ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে মার্কিন স্যাটেলাইট ধ্বংস করার ক্ষমতা অর্জন করে চীন। তারা এখন সম্ভবত লেসার দিয়ে স্যাটেলাইটগুলোকে 'অন্ধ' করে দিতে পারে। তা যদি হয়, তাহলে চীন-মার্কিন যুদ্ধের প্রথম কয়েক মিনিটেই মার্কিন মিলিটারির কমিউনিকেশন ও পজিশনিং সিস্টেমগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে।
এছাড়া রাশিয়ার এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও মোতায়েন করেছে চীন, যার রয়েছে তাইওয়ানের আকাশে উড়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত ক্ষমতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা ব্যবস্থা রুশ সিস্টেমটিকে পরাভূত করতে পারবে কি না, সেটা মিলিটারি সিক্রেট বা সামরিক গোপনীয় বিষয়, তবে এটা পরিষ্কার যে, রুশ সিস্টেমটি তাইওয়ানের প্রতিরক্ষার নিশ্চয়তা দেবে।
একটা কথা অবশ্যই বলে রাখা দরকার যে, চীনের উপকূলের কাছে চীনা ও মার্কিন বাহিনীর সংঘাত শুরু হলে তা শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, পাশাপাশি পারস্য উপসাগরীয় এলাকা থেকে চীনের তেল আমদানিতে বাধা সৃষ্টির চেষ্টাও করতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটা বুঝতে পেরেই রাশিয়া থেকে স্থলপথে তেল ও গ্যাস আমদানিতে এতটা উদগ্রীব চীন।
চীনের তেল আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির আরো অসুবিধা আছে। চীনের জ্বালানি চাহিদার ৮৫ ভাগই এখনও উৎপাদিত হয় দেশেই। পক্ষান্তরে আমেরিকার মিত্র জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানকে জ্বালানির জন্য পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় আমদানির ওপর। কাজেই তেল আমদানির পথে কোনো রকম বাধা সৃষ্টি করলে তা মার্কিন মিত্রদের জন্যই বিপদ ডেকে আনবে।
চীনের ভয়াল মিসাইল অস্ত্রকে হারাতে সক্ষম নতুন অস্ত্র নির্মাণের কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র। এর সম্ভাব্যতা যাচাই করতে চলতি বছরের গোড়ার দিকে সামরিক সরঞ্জাম নির্মাতা কম্পানি গ্রুম্যানকে ১৩ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে মার্কিন সরকারী সংস্থা দ্য ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি। এর বাইরে মার্কিন নৌবাহিনী জানিয়েছে যে তারাও একটি ডিফেন্সিভ সিস্টেম নিয়ে কাজ করছে। তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়নি।
তত্ত্বগতভাবে যে-কোনো গতিসম্পন্ন অস্ত্রের ওপর আলোর গতিতে এনার্জি ট্রান্সমিট করতে পারে লেসার। তবে দ্রুত গতিসম্পন্ন বস্তু ধ্বংস করার অনেক বিপদও আছে, যার সমাধান প্রক্রিয়া এখনও উদ্ভাবিত হয়নি।
লেসার অস্ত্র দিয়ে চীনের উপকূলের ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দিতে আরো বহু বছর লেগে যাবে। আর সে-কারণেই নিকট-ভবিষ্যতে চীন-মার্কিন যুদ্ধ বলতে গেলে একরকম অসম্ভব। তবে সাথে এও বলতে হয়, বিশ্ব রাজনীতির দাবার বোর্ডে 'অসম্ভব' বলতে কিছু নেই।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে