লিবিয়ায় তুরস্কের এস-৪০০ বনাম মিশরের রাফালে

আনকারায় রাশিয়ান বিমান থেকে নামছে এস-৪০০ এর পার্টস - আনাদুলো

  • মেহেদী হাসান
  • ২৩ জুলাই ২০২০, ২০:৩৪

তুরস্ক লিবিয়ায় মোতায়েন করতে পারে রাশিয়ার তৈরি এস -৪০০ মিসাইল। ফ্রান্সের তৈরি রাফালে যুদ্ধ বিমান মোকাবেলায় তুরস্ক এ মিসাইল মোতায়েন করবে। লিবিয়ার আল ওয়াতিয়া বিমান ঘাটিতে হামলা চালানো হয় রাফালে যুদ্ধ বিমানের মাধ্যমে। আল ওয়াতিয়া বিমান ঘাটি ব্যবহার করছে তুরস্ক। এ হামলার পরে তুরস্ক লিবিয়ায় এস -৪০০ মিসাইল মোতায়েন করতে পারে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকর ৩রা জুলাই লিবিয়া সফর করেন। এর একদিন পর লিবিয়ায় তুরস্কের ঘাটিতে কয়েক দফা বিমান হামলা চালানো হয়। ফ্রান্স, মিশর অথবা সংযুক্ত আরব আমিরাত এ তিনটি দেশের যে কোনো একটি দেশ হামলা চালিয়েছে। ফ্রান্সের রাফালে যুদ্ধ বিমানের মাধ্যমে এই হামলা চালানো হয়। ফ্রান্স ছাড়াও মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে এই বিমান রয়েছে। তবে মিশর থেকে এ হামলা চালানো হয়েছে বলে কোনো কোনো খবরে বলা হয়েছে।মিশরের প্রেসিডেন্ট জেনারেল সিসি সম্প্রতি কঠোর হুশিয়ারি দিয়ে বলেন, তুরস্ক যদি লিবিয়ায় অগ্রযাত্রা বন্ধ না করে তাহলে মিশর লিবিয়ায় সররাসরি সামরিক অভিযান চালাবে।

তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে থাকা আল ওয়াতিয়া বিমান ঘাটিতে এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান ও বায়রাকটার বি২, আঙ্কা এস ড্রোন বিমান মোতায়েন রয়েছে। এ বিমান ঘাটি প্রতিরক্ষায় মোতায়েন করা আছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এমআইএম-২৩ হক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। এটি মাঝারি পাল্লার মিসাইল সিস্টেম। এছাড়া লিবিয়ায় তুরস্কের তৈরি স্বল্প পাল্লার হিসার এবং করকুট এন্টি এয়ারক্রাফট গান মোতায়েন রয়েছে। তবে এর কোনটিই ফোর প্লাস জেনারেশনের রাফালে বিমান আক্রমন প্রতিহত করতে সক্ষম হয়নি।

তুরস্কের রাডার এবং মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম ফাঁকি দিয়ে কমপক্ষে ৫০ মাইল দূর থেকে বিমান হামলা চালিয়েছে রাফালে জেট। লিবিয়ার স্থানীয় গণমাধ্যমে এ হামলায় তুরস্কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা বলা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে সেখানকার তুরস্কের রাডার ও ডিফেন্স সিস্টেম।

হাফতার বাহিনীর বিরুদ্ধে তুরস্ক সম্প্রতি ড্রোন হামলার মাধ্যমে ব্যাপক সফলতা অর্জন করে। ত্রিপোলির আশপাশ থেকে সরে যেতে বাধ্য হয় হাফতার বাহিনী। এরপর তুরস্ক আল ওয়াতিয়ায় বড় ধরনের সামরিক স্থাপনা তৈরির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু রাফালের হামলা লিবিয়ায় তুরস্কের জন্য বড় ধরনের একটি আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ ক্রমে জটিল আকার ধারণ করছে। লিবিয়ায় তুরস্ককে কোনঠাসা করতে রাশিয়া, ফ্রান্স, মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত নানা ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় লিবিয়ায় তুরস্কের অবস্থান ধরে রাখতে হলে উন্নত মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন ছাড়া বিকল্প পথ নেই। কিন্তু রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ মিসাইল লিবিয়ায় মোতায়েন নিয়ে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা নিয়ে চলছে নানা ধরনের বিতর্ক আর জটিল হিসাব নিকাশ।

তুরস্ক যদিও রাশিয়া থেকে এস-৪০০ মিসাইল সংগ্রহ করেছে কিন্তু এখনো সেটি সে নিজ দেশে মোতায়েন করেনি । এ মিসাইল কেনার কারনে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে বের করে দেয় এফ-৩৫ যৌথ বিমান প্রকল্প থেকে। তুরস্কের কাছে ১০০ এফ-৩৫ বিমান হস্তান্তর বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া তুরস্কের ওপর অবরোধ আরোপের হুমকি দিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র এমন পরিকল্পনা করছে তুরস্ক থেকে এস-৪০০ মিসাইল কিনে নিয়ে তুরস্ককে এ মিসাইল ব্যবস্থা থেকে বের করে আনার। ফলে এ মিসাইল লিবিয়ায় মোতায়েন পরিকল্পনা নিয়ে অনেক সন্দেহ রয়েছে।

অনেক বিশেষজ্ঞের মতে লিবিয়ায় এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম মোতায়েনের বিরোধীতা করতে পারে রাশিয়া। কারন এটি সেখানে মোতায়েন করলে তা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যাবে। কারন রাশিয়া হাফতার বাহিনীর পক্ষে। অপর দিকে এ মিসাইল তৃতীয় দেশে মোতায়েন করতে হলে অবশ্যই তুরস্ককে অনুমতি নিতে হবে রাশিয়ার কাছ থেকে। কারন রাশিয়ান অস্ত্র ক্রয়ের সময় অবশ্যই ক্রেতাকে এর এন্ড- ইউজার সার্টিফিকেট দিতে হয়।

তুরস্ক-রাশিয়া সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ বাসেল হাজ জাসেম মনে করেন লিবিয়ায় এস-৪০০ মিসাইল মোতায়েন তুরস্কের জন্য উইন-উইন ফলাফল বয়ে আনবে। এটা শুধু রাফালে জেটের আক্রমন মোকাবেল করবে তাই নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য অবরোধের হাত থেকেও রেহাই মিলতে পারে। কারন এস-৪০০ মিসাইল তৃতীয় কোনো দেশে মোতায়েনে আপত্তি নেই যুক্তরাষ্ট্রের। এস-৪০০ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দাবির মধ্যে রয়েছে তুরস্কে এ মিসাইল মোতায়েন না করার বিষয়ে লিখিত অঙ্গীকার দিতে হবে। অথবা রাশিয়ার কাছে এ মিসাইল ফেরত দিয়ে অন্য কোনো দেশের কাছে বিক্রি করতে হবে। ফলে তুরস্ক যদি লিবিয়ায় এ মিসাইল মোতায়েন করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের তাতে খুশী হওয়ার কথা।

এস-৪০০ লিবিয়ায় মোতায়েনতে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিতে পারে। এর ফলে তুরস্ক নিজ দেশ থেকে সরিয়ে ফেলতে পারছে যা যুক্তরাষ্ট্র চাইচে। অপর দিকে এটি তুরস্ক ব্যবহার করবে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে তুরস্ককে লিবিয়ায় এ মিসাইল মোতায়েন করতে হলে রাশিয়ার সাথে সমঝোতায় আসতে হবে। আর রাশিয়ার সাথে সমঝোতায় আসার অর্থ হচ্ছে লিবিয়ায় তাকে রাশিয়ার পক্ষে ছাড় দিতে হতে পারে।

মস্কো এবং ওয়াশিংটনের সম্মতির ভিত্তিতে তুরস্ক যদি লিবিয়ার সাথে এস-৪০০ মিসাইল মোতায়েন বিষয়ে কোনো চুক্তি করতে পারে তাহলে এটা সবচেয়ে ভাল একটি পদক্ষেপ হতে পারে। তুরস্কের ডেইলি সাবাহর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুরস্ককে লিবিয়ায় খুবই কৌশলী ভ‚মিকা পালন করতে হবে । কারন রাশিয়াকে ক্ষুব্ধ করতে পারবে না আংকরা। আবার ওয়াশিংটন ও মস্কোর মাঝে দাড়িয়ে ভারসাম্যপূর্ন অবস্থান নিতে হবে।

লিবিয়া গৃহযুদ্ধ ঘিরে মিত্র পরিণত হচ্ছে শত্রুতে। শত্রু পরিণত হচ্ছে মিত্রে। সিরিয়ায় তুরস্ক ও সৌদি আরব ছিল মিত্র। কিন্তু লিবিয়ায় তারা পরষ্পর শত্রু। একইভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশরসহ মধ্যপ্রাচের অনেক দেশ লিবিয়ায় তুরস্কের ঘোরতর শত্রুর ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছে। অনেক দিন ধরে লিবিয়া, সিরিয়াসহ নানা ইস্যুতে তুরস্কের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক জটিল অবস্থার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে।

লিবিয়ায় রাশিয়ার অবস্থান তুরস্কের বিরুদ্ধে। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে রাশিয়ার ১৪টি মিগ-২৯ বিমান এবং এসইউ-২৪ বিমান সিরিয়া থেকে উড়ে এসেছে লিবিয়ায় বিদ্রোহী হাফতার বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধের জন্য। লিবিয়ায় প্রবেশের আগে রাশিয়ান বিমানগুলোর রং পরিবর্তন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

তুরস্কের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত সর্বশক্তি নিয়োগ করছে হাফতার বাহিনীর পক্ষে। বিপুল অর্থ এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কেনা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র, জ্বালানি তেল সরবরাহ করছে হাফতার বাহিনীকে। ফলে লিবিয়ায় চলছে বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রক্সি যুদ্ধ।

লিবিয়ার দিকে নজর রাখছেন অনেক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ। আল ওয়াতিয়ায় বিমান ঘাটিতে রাফালে যুদ্ধ বিমানের মাধ্যমে হামলা যদি মিশর করে থাকে তাহলে তুরস্কের জন্য এটি বড় এক বার্তা। এস-৪০০ মিসাইল মোতায়েন করতে হলে তুরস্ককে রাশিয়ার কাছে দেন দরবার করতে হবে এবং সেটা তার জন্য লাভজনক নাও হতে পারে। আর সেখানে শক্তিশালী মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন ছাড়া তুরস্কের পক্ষে অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

ভবিষ্যতে লিবিয়ায় তুরস্কের অবস্থানের ওপর এ ধরনের হামলা আরো হতে পারে। ফলে তুরস্ককে এখন সরাসরি মোকাবেলা করতে হবে মিশরকে। এস ৪০০ মিসাইল মোতায়েন করতে না পারলে তুরস্ককে সম্পূর্ণ নতুন যুদ্ধ কৌশল নিতে হবে ।

বর্তমানে বিশ্বে যে কয়টি মোস্ট এডভান্সড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো রাশিয়ার এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত আকাশে শত্রæর হামলা সনাক্ত এবং ট্রাক করে ধ্বংস করতে পারে। এ মিসাইল আকাশে শত্রæর যুদ্ধ বিমান, ক্রুজ মিসাইল, মাঝারি পাল্লার মিসাইল এবং ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিহতহ ও ধ্বংস করতে সক্ষম। এ মিসাইল আকাশ ছাড়া ভ‚মিতে আক্রমনের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়।

লিবিয়ায় তুরস্কের এস-৪০০ মিসাইল মোতায়েনের সম্ভাবনার খবরে সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটি সত্য হলে, লিবিয়ায় পরীক্ষা হতে যাচ্ছে ফ্রান্সের রাফালে যুদ্ধ বিমান এবং রাশিয়ার এস-৪০০ মিসাইলের ক্ষমতা ও দক্ষতা। এদিকে ভারতও চোখ রাখছে লিবিয়ার দিকে রাফালে জেট এবং এস -৪০০ এর সত্যিকারের পরীক্ষার দিকে। কারন ভারত ফ্রান্স থেকে সংগ্রহ করছে রাফালে যুদ্ধ বিমান। আর রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করার পথে রয়েছে এস-৪০০ মিসাইল।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে