বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরী যেভাবে চলে

সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরীর নাম জেরাল্ড আর ফোর্ড - নেভি রিকোগনেশন ডটকম

  • মেহেদী হাসান
  • ২৩ জুলাই ২০২০, ২০:২৫

বিশ্বে এযাবতকালের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরীর নাম জেরাল্ড আর ফোর্ড। এর দৈর্ঘ্য তিনটি ফুটবল মাঠের চেয়েও বেশি। এর মালিক যুক্তরাষ্ট্র। জেরাল্ড আর ফোর্ড যুক্তরাষ্ট্রের ফিউচার সুপার ক্যারিয়ার নামে পরিচিতি।

ফোর্ড ক্লাসের প্রথম বিমানবাহী রণতরী নাম জেরাল্ড আর ফোর্ড। যুক্তরাষ্ট্র নেভিতে এটি যুক্ত হয় ২০১৭ সালের মে মাসে। একই বছর জুলাইয়ে এটি কমিশনপ্রাপ্ত হয়। ২০২০ সালে এটি পূর্ণ অপারেশনে যাওয়ার কথা রয়েছে। দুটি পরমানু রিএক্টর দ্বারা চালিত জেরাল্ড ফোর্ড। দুটি রিএক্টরের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট।

জেরাল্ড আর ফোর্ড নির্মানে খরচ হয়েছে ১৩ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া গবেষণার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে আরো ৫ বিলিয়ন ডলার।

জেরাল্ড ফোর্ড নির্মানের আগে বিশ্বে সবচেয়ে বড় আর শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিমিটজ ক্লাসের রণতরী। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি আর আধিপত্যের প্রতীক পরমানু শক্তিচালিত নিমিটজ ক্লাসের ১০টি বিমানবাহী রণতরী।

বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের আজ যে আধিপত্য আর প্রভাব তার অন্যতম সঙ্গী যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী এসব বিমানবাহী রণতরী। ৯০টি যুদ্ধ বিমান ধারণ করতে পারে জেরাল্ড ফোর্ড রণতরী। এসব বিমানের মধ্যে রয়েছে এফ-৩৫ জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটার, এফএ-১৮ই এফ সুপার হরনেট, ই-২ ডি এডভান্সড হকি, ইএ-১৮ জি গ্রলার ইলেকট্রনিক এটাক এয়ারক্রাফট, এমএইচ-৬০ আর এস হেলিকপ্টার । এছাড়া রয়েছে ড্রোন, বিমান এবং কমব্যাট ভেহিক্যাল।

ফোর্ড রণতরীর থেকে দিনে ১৬০ থেকে সর্বোচ্চ ২২০ বার বিমান হামলা পরিচালনা করা সম্ভব শত্রæর বিরুদ্ধে। ফোর্ডের ফ্লাইট ডেক ৭৮ মিটার বা ২৫৬ ফিট প্রশস্ত। এর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ১০৬ ফিট। উচ্চতা ২৫০ফিট। ডেক বা তলার সংখ্যা ২৫টি। বিমান উডডয়নের জন্য রানওয়ের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৯২ ফিট। গতি ঘন্টায় ৩৫ মাইল।

জেরাল্ড আর ফোর্ড বিমানবাহী রণতরির আরেক নাম সিভিএন-৭৮। জেরাল্ড ফোর্ডের ফুল লোড ডিসপ্লেসমেন্ট ক্ষমতা ১ লাখ টন। জেরাল্ড ফোর্ডে রয়েছে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক এয়ারক্রাফট লঞ্চিং সিস্টেম এন্ড এডভান্সড এরেস্টিং গিয়ার। যেসব অস্ত্রে সজ্জিত রেজাল্ড ফোর্ড তার মধ্যে রয়েছে ইভলভড সি স্প্যারো মিসাইল, রোলিং এয়ারফ্রেম মিসাইল এবং ফালানক্স ক্লোজ ইন উইপন সিস্টেম। সি স্প্যারো মিসাইল উচ্চ গতির এবং শক্তিশালী এন্টি শিপ মিসাইল প্রতিহত করতে সক্ষম।

ফোর্ড ক্লাসের মোট ১২টি বিমানবাহী রণতরী নির্মানের পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ফোর্ড ক্লাসের দ্বিতীয় বিমানবাহী রণতরীর নাম জন এফ কেনেডি বা সিভিএন ৭৯। জন এফ কেনেডি ২০২২ সালের মধ্যে ইউএস নেভিতে যুক্ত হওয়ার কথা।

ফোর্ড ক্লাসের তৃতীয় বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ নির্মানের কাজ ২০১৬ সালে শুরু হয়েছে। আরো দুটি নির্মানের অর্ডার দেয়া হয়েছে। ৩ থেকে ৫ বছর পরপর একটি করে ফোর্ড ক্লাসের নতুন বিমানবাহী রণতরী যুক্ত হবে এবং এভাবে ২০৫৮ সালে ১২ তম বিমানবাহী রণতরী নির্মানের কাজ শেষ হবে। ২১০৫ সাল পর্যন্ত জেরাল্ড ফোর্ড বিমানবাহী রণতরী সার্ভিসে রাখার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের।

জেরাল্ড আর ফোর্ড নির্মান করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র নির্মান প্রতিষ্ঠান নরথ্রপ গ্রæম্যান। নরথ্রম গ্রæম্যানের নিউ পোর্ট নিউজ শিপ বিল্ডিং কোম্পানীয় ভার্জিনিয়ায় নির্মান করেছে জেরাল্ড। ফোর্ড ক্লাসের অপর বিমানবাহী রণতরীও নির্মান করছে নিউপোর্ট নিউজ কোম্পানী।

জেরাল্ড আর ফোর্ড নির্মান শুরু হয় ২০০৫ সালে। ফোর্ড ক্লাসের দ্বিতীয় বিমানবাহী রণতরী জন এফ কেনেডির নির্মান কাজ শুরু হয় ২০১১ সালে। নিমিটজ ক্লাসের ১০টি বিমানবাহীর রণতরীর সবগুলো নির্মান করে নরথ্রপ গ্রুম্যানের নিউপোর্ট নিউজ শিপ বিল্ডিং কোম্পানী।

বস্তুত ১৯৬০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র যত বিমানবাহী রণতরী নির্মান করেছে তার সবই নির্মান করেছে নরথ্রপ গ্রæপম্যান নিউপোর্ট নিউজ কোম্পানী। ৪ হাজার ৫৩৯জন নৌ সেনাসহ শিপ কোম্পানী, এয়ার উইং এবং অন্যান্য স্টাফ একত্রে অবস্থান করতে পারে ফোর্ডে।

জেরাল্ড ফোর্ড আয়তনে নিমিটজ ক্লাসের চেয়ে বড় তবে এর সৈন্য ধারণ সংখ্যা ৫০০ থেকে ৯০০ কম। অপর দিকে নিমিটজের তুলনায় জেরাল্ড ফোর্ডে থাকবে ২৩টি নতুন আপগ্রেড সিস্টেম। জেরাল্ড ফোর্ডে ম্যান পাওয়ার কমানোর কারন হলো উন্নত প্রযুক্তি। এতে যেসব নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়েছে তা পূরণ করবে জনবলের ঘাটতি। নতুন প্রযুক্তির কারনে রক্ষানাবেক্ষন বাবদ ম্যান পাওয়ার ৩০ ভাগ কম প্রয়োজন হবে জেরাল্ড ফোর্ডে।

জেরাল্ড ফোর্স ক্লাসকে বলা হয় সিভিএন ২১ ফিউচার সুপার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। নিমিটজ ক্লাসের মোট ১০টি বিমানবাহী রণতরী রয়েছে। এর প্রথমটি চালু হয় ১৯৭৫ সালে। আর দশম রণতরী চালু হয় ২০০৯ সালে। দশম বিমানবাহী রণতরীর নাম জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ।

১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেভিতে নিমিটজ ক্লাস বিমানবাহী রণতরী যুক্ত হওয়ার পর থেকে এটি পরিণত হয় তাদের পাওয়ার প্রজেকশন বা বর্হিবিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শনের অংশ। নিমিটজ ক্লাসের চতুর্থ বিমানবাহী রণতরী থিওডর রুজভেল্ট ।

থিওডর রুজভেল্ট ২০০১ সালে আফগানিস্তান অভিযানের সময় কোনো বন্দরে নেঙ্গার করা ছাড়া ১৫৯ দিন সাগরে অবস্থান করে। বর্তমানে এটি ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে নিয়োজিত। বিতর্কিত দক্ষিন চীন সাগরে মহড়া চালায় থিওডর রুজভেল্ট। এর সাথে অংশ নেয় নিমিটজ ক্লাসের আরেক বিমানবাহী রণতরী রোনাল্ড রিগান।

নিমিটজ ক্লাসের এসব বিমানবাহী রণতরী থেকে শত শত মাইল দূরে বিমান আক্রমন পরিচালনা করা সম্ভব। নিমিটজ ক্লাসের পুরনো বিমানবাহী রণতরীর স্থলে মোতায়েন করা হবে জেরাল্ড ফোর্ড ক্লাসের রণতরী।

১৯৮০ সালে ইরানে অপারেশন ইগল ক্ল, ১৯৯০-৯১ সালে উপসগারীয় যুদ্ধ, আফগানিস্তানে অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম এবং ইরাক অভিযানে অংশ নেয় নিমিটজ ক্লাসের বিভিন্ন বিমানবাহী রণতরী।

নিমিটজ ক্লাসসহ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য রনতরীতে বর্তমানে প্রযুক্তিগত যেসব দুর্বলতা বা ঘাটতি রয়েছে তার সবকিছুর সমন্বয় করা হবে জেরাল্ড ফোর্ডে। এতে থাকবে ইন্টিগ্রেটেড ওয়ারফেয়ার সিস্টেম, শিপ সেলফ ডিফেন্স সিস্টেম। অন্যান্য বিমানবাহী রণতরীর চেয়ে ফোর্ডের বিমান হামলা পরিচালনার পরিমান ২৫ শতাংশ বেশি।

জেরাল্ড ফোর্ড বিমানাহী রণতরীতে রয়েছে দুটি এ১বি পারমানবিক রিএক্টর। দুটি রিএক্টরের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৬৮৭ মেগাওয়াট। নিমিটজ ক্লাসেরও প্রতিটি রণতরীতে বসানো দুটি করে পারমানবিক রিএক্টর। দুটি রিএক্টরের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৫৫০ মেগাওয়াট।

পারমানবিক শক্তিচালিত হওয়ায় পুন জ্বালানি সংগ্রহ ছাড়া নিমিটজ ক্লাসের বিমানবাহী রণতরী ২০ বছর সমুদ্রে চলতে পারে। ফোর্ড ক্লাসের রণতরীর এ ক্ষমতা হবে আরো অনেক বেশি। নিমিটজ ক্লাস রণতরীর চেয়ে আড়াইশগুন বেশি এর শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা ফোর্ডের। জেরাল্ড ফোর্ডে রয়েছে ৪টি ব্রোনজ প্রপেলার ।

জেরাল্ড ফোর্ড ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ একদিন পরিচালনার খরচ ধরা হয়েছে সাড়ে ৬ মিলিয়ন ডলার বা ৫৫ কোটি টাকা। ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রæপে থাকে ৭০টি বিমানসহ একটি বিমানবাহী রণতরী, একটি ক্রুজার, দুটি ডেস্ট্রয়ার বা ফ্রিগেট, সাড়ে সাত হাজার নৌ সেনা। এ ছাড়া এর সাথে একটি ফাস্ট এটাকা সাবমেরিন এবং অন্যান্য সাপ্লাই শিপ থাকতে পারে।

তবে নিমিটজ ক্লাস বিমানবাহী রণতরীর তুলনায় জেরাল্ড ফোর্ড এর অপারেশন পরিচালনা খরচ অনেক কম এবং সহজ । যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বর্তমানে পরমানু শক্তিচালিত ১১টি বিমানবাহী রণতরী রয়েছে। এর বাইরেও তাদের আরো ৯টি রণতরী রয়েছে যা বিমান এবং হেলিকপ্টার বহন করতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এমফিভিয়াস এসল্ট শিপ। এই রণতরীতে এফ-৩৫ বিমান ওঠা নামা করতে পারে।

জেরাল্ড ফোর্ড যুক্তরাষ্ট্রের ৩৮ তম প্রেসিডেন্ট। তার নামে নাম করণ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সুপার ক্যারিয়ার বিমানবাহী রণতরীর। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউজে ছিলেন তিনি।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে