কার জন্য অস্ত্র কেনে সংযুক্ত আরব আমিরাত

সংযুক্ত আরব আমিরাতের জনসংখ্যা এবং সামরিক শক্তির দিক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের তুলনায় পেছেনে - ইন্টারনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ২৩ জুন ২০২০, ২০:১৩

দীর্ঘকাল ধরে মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের সবচেয়ে অস্থিতিশীল একটি অঞ্চল। গত ৫ বছরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সমরাস্ত্র আমদানি বেড়েছে ৬১ ভাগ। গত ৫ বছরে বিশ্বে যত অস্ত্র বিক্রি হয়েছে তার ৩৫ ভাগেরও বেশি কিনেছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ। মধ্যপ্রাচ্যে অব্যাহত অস্ত্র আমদানি বৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা পালনকারী অন্যতম একটি দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। সম্প্রতি দেশটির অর্থনীতি কিছুটা নেতিবাচক হলেও থামেনি অস্ত্র আমদানি। এর কারন দেশটির ইয়েমেন এবং লিবিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। লিবিয়ায় বিদ্রোহী হাফতার বাহিনীর অস্ত্রের প্রধান যোগানদাতা সংযুক্ত আরব আমিরাত।

লিবিয়া এবং ইয়েমন ছাড়াও মিশর, তিউনিশিয়া, জিবুতিসহ বিভিন্ন দেশ ও সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বিভিন্ন গোষ্টীর পেছনে সংযুক্ত আরব আমিরাত অবাধে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করেছ সংযুক্ত আরব আমিরাত।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের জনসংখ্যা এবং সামরিক শক্তির দিক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের তুলনায় পেছেনে। কিন্তু অস্ত্র খাতে দেশটির ব্যয় অন্য অনেক শক্তিশালী দেশের চেয়ে বেশি। সৌদি আরবের নেতৃত্বে ইয়েমেন যুদ্ধে জড়ানো ছাড়া অপর যে কারনে দেশটি প্রতি বছর অস্ত্রের মজুদ বৃদ্ধি করছে তা হলো ইরান ভীতি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফেডারেল সামরিক বাজেট ২০১৯ সালে শতকরা ৪১ ভাগ বৃদ্ধি করা হয়। ২০১৮ সালে দেশটি ফেডারেল সামরিক বাজেট ছিল ১ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাড়ায় ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ফেডারেল এ বাজেট ছাড়া প্রত্যেকটি আমিরাতের আলাদা সামরিক বাজেট আছে।

২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সামরিক খাতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের গড় ব্যয় ২৬ দশমিক ৬ বিলিযন ইউএস ডলার। ২০২৫ সাল পর্যন্ত একে প্রায় বছরে ৩৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির।

সুইডেনের স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে সংযুক্ত আরব আমিাতের ইয়েমন ও লিবিয়া যুদ্ধে জড়ানোর পর এভাবে অস্ত্র আমদানি বৃদ্ধি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। একই সাথে এসব সংস্থার প্রতিবেদনে দেশটির কাছে পশ্চিমা দেশগুলোর অবাধে অস্ত্র বিক্রি বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বে যত সমরাস্ত্র বিক্রি হয়েছে তার ৩ দশমিক ৪ ভাগ ক্রয় করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এসময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত যত অস্ত্র ক্রয় করেছে তার ৬৮ ভাগই ক্রয় করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে।

সামরিক শক্তির দিক দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবস্থান বিশ্বে ৪৫ তম। গ্লোবাল ফায়ার পারওয়ার এর তথ্য অনুসারে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মোট সৈন্য সংখ্যা ৬৪ হাজার। সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে রয়েছে শক্তিশালী মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম এবং স্বল্প পাল্লার ব্যালেস্টিক মিসাইল। এসব অস্ত্র দেশটি সংগ্রহ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। তবে দেশটি সম্প্রতি আধুনিক সমরাস্ত্র শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে আরব আমিরাত এজ নামে একটি সমরাস্ত্র শিল্পের উদ্বোধন করেছে যেটি হবে দেশের সবচেয়ে বড় এবং আধৃনিক সমরাস্ত্র শিল্প। আসুন আমরা দেখে নেই দেশটির সামরিক শক্তির কিছু চিত্র :

বিমান বাহিনী : সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ৭৭টি সুপারসনিক এফ-১৬ জঙ্গি বিমান রয়েছে। ফ্রান্সের তৈরি চতুর্থ প্রজন্মের মিরেজ-২০০০ বিমান রয়েছে ৬৩টি। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সি-১৭ গেøাব মাস্টার নামক আটটি ভারী পরিবহন বিমান রয়েছে । এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন নির্মিত চার ইঞ্জিন বিশিষ্ট সি-১৩০ হারিকিউলিস নামক বিশাল আকৃতির পরিবহন বিমানও রয়েছে ৮টি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিমান বাহিনীতে মোট বিমানের সংখ্যা ৫৩৮টি। যুদ্ধ বিমান ৯৮টি। পরিবহন বিমান ৪০টি। হেলিকপ্টার ২২৯টি। এর মধ্যে এটাক হেলিকপ্টার ৩০টি।
স্থল বাহিনী : সংযুক্ত আরব আমিরাতের ট্যাঙ্ক সংখ্যা ৪৩৪টি। সাজোয়া যান ৮ হাজার ৬৯১টি। সেলফ প্রপেপল্ড আর্টিলারি ১৮৩টি। টাউড আর্টিলাটির ৭৬টি। রকেট প্রজেক্টর ৭২টি।

নৌ বাহিনী : মোট রণতরীর সংখ্যা ৭৫টি। এর মধ্যে করভেট ১১টি। টহল জাহাজ ৩৫টি।
২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মধ্য প্রাচ্যে অস্ত্র আমদানির পরিমান ৮৭ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে আগের ৫ বছরের তুলনায়। অপর দিকে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে অস্ত্র আমদানি বেড়ে ৬১ ভাগ। মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র আমদানি বৃদ্ধির পেছনে মূল ভ‚মিকা পালন করছে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। আর এ দেশ দুটির অস্ত্র আমদানি বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে ইয়েমনে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া । দীর্ঘকাল ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাম রয়েছে বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশের তালিকায়।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউট ২০২০ সালের বিশ্বে শীর্ষ ১০টি অস্ত্র আমদানিকারক দেশের আরব আমিরাতের নাম রয়েছে অষ্টম স্থানে। এ সংস্থার ২০১০ সালের তালিকা অনুযায়ী সংযুক্ত আরব আমিরাত ছিল বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতে অস্ত্রের মূল যোগানদাতা হলো যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া ফ্রান্সের সমরাস্ত্রেরও অন্যতম গন্তব্য হলো আরব আমিরাত। গত ৫ বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অস্ত্র আমদানির পরিমান রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। আসুন জেনে নেই সংযুক্ত আরব আমিরাতে সামরিক খাতের আরো কিছু তথ্য

সংযুক্ত আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক প্রভাব ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন গোষ্টীকে অস্ত্র সরবারহ করে থাকে। ইয়েমেন যুদ্ধ ছাড়াও লিবিয়ায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ন্যাশনাল একর্ড সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী খলিফা হাফতার বাহিনীকে বিপুল পরিমান সমরাস্ত্রের যোগান দিচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এমনকি বিদ্রোহী বাহিনীকে হেলিকপ্টার পর্যন্ত সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে। হাফতার বাহিনীর অস্ত্রের প্রধান যোগানদাতা হলো আমিরাতিরা। এ ছাড়া যুদ্ধের জ্বালানি তেলেরও যোগান দিচ্ছে দেশটি।

যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন পলিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে চলতি বছরের মধ্য জানুয়ারির থেকে আরব আমিরাত লিবিয়ায় বিদ্রোহীদের ১০০ বেশি প্লেন ভর্তি সমরাস্ত্র পাঠিয়েছে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ১ দশিক ১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র আমদানি করেছে। ২০১৯ সালের ফেব্রæয়ারিতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ডিফেন্স এক্সিবিশেন এন্ড কনফারেন্সে ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র ক্রয় চুক্তির কথা ঘোষনা দেয় সংযুক্ত আরব আমিরাত।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের আয়তন ৩২ হাজার ৩০০ বর্গমাইল। দেশটির ৭৫ ভাগ মানুষ বাস করে আবুধাবি, দুবাই এবং সারজা এ তিনটি রাজ্যে। সাতটি রাজ্য নিয়ে গঠিত সংযুক্ত আরব আমিরাত। প্রতিটি রাজ্যে রয়েছে একজন করে আমির। যে সাতটি রাজ্য নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত গঠিত সেগুলো হলো আবুধাবি, দুবাই, সারজা, আজমান, উম আল কুয়াইন, রাস আল খাইমাহ ও ফুজাইরাহ। দেশটির রাজধানী আবুধাবি। আসুন আমরা জেনে নেই সংযুক্ত আরব আমিরাত সর্ম্পকে আরো কিছু তথ্য

সংযুক্ত আরব আমিরাতের মোট জনসংখ্যার ৮৮ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ বিদেশী নাগরিক বা শ্রমিক। দেশটিতে স্থানীয় জনগণের সংখ্যা মাত্র ১১ দশমিক ৫ ভাগ। জাতিসংঘের ২০২০ সালের তথ্য অনুসারে বিদেশীসহ দেশটির মোট জনসংখ্যা ৯৮ লাখ ৯০ হাজার । বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুসারে আরব আমিরাতে স্থানীয় বা আমিরাতি জনসংখ্যা মাত্র ১০ থেকে ১১ লাখ । ভারতের দূতাবাসের দেয়া তথ্য অনুসারে ২০১৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভারতীয় নাগারিক রয়েছে ২৬ লাখ। এ হিসেবে দেশটির মোট জনসংখ্যার ২৭ ভাগ ভারতীয়।

অপর দিকে ২০১৯ সালের সেপ্টম্বরে জাতিসংঘের পপুলেশন ডিভিশন কর্তৃক মাইগ্রেশন বিষয়ক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ৩৩ লাখ ভারতীয় রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে।

২০১৪ সালের পাকিস্তানের সরকারি তথ্য অনুসারে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাকিস্তানের জনসংখ্যা রয়েছে ১২ লাখ এবং তা দেশটির মোট জনসংখ্যার ১২ দশমিক ৫৩ ভাগ।

জনসংখ্যার শতকরা হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভারত ও পাকিস্তানের পর রয়েছে দেশটির স্থানীয় জনসংখ্যার হার। সে হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের জনসংখ্যার স্থান দেশটিতে তৃতীয়। অর্থাৎ দেশটিতে স্থানীয় আমিরাতিরা তৃতীয় সারির সংখ্যালঘু এবং তা মাত্রা সাড়ে ১২ শতাংশ।

সৌদি আরব অনেক দিন ধরে বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। অনেকেরই প্রশ্ন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন আরব দেশ এত অস্ত্র কিনছে কেন। কার বিরুদ্ধে তারা ব্যবহার করবে এ অস্ত্র। কে তাদের শত্রু। এর একটিই উত্তর। মুসলিম দেশ হয়ে আরেকটি মুসলিম দেশ ইরানের মোকাবেলায় তারা প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে গড়ে তুলছে অস্ত্র মজুদের এ পাহাড়। ইরানভীতি মোকাবেলা ছাড়া তাদের এসব অস্ত্রের আর তেমন কোনো কার্যকারিতা নেই।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে