চীন-ভারতের সামরিক শক্তি, ব্যবধান অনেক

চীন সমরাস্ত্রের জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল নয়। এর বিপরীতে ভারত সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে বিদেশের ওপর নির্ভরশীল একটি দেশ - ইন্টারনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ০২ জুন ২০২০, ১৮:১১

সামরিক দিক দিয়ে বিশ্বে চীনের অবস্থান তৃতীয় আর ভারতের অবস্থান চতুর্থ। সামরিক শক্তির দিক দিয়ে দুই দেশের অবস্থান পাশপাশি হলেও মাঝখানে ব্যবধান অনেক বেশি। দুই দেশের সামরিক শক্তির তুলনামূলক আলোচনা করলে চীন ও ভারতের মধ্যে একটি অসম চিত্র ফুটে ওঠে। চীন বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহৎ সমরাস্ত্র প্রস্তুতকারক দেশ। অপর দিকে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহৎ সমরাস্ত্র আমদানিকারক দেশ। দুই দেশের সামরিক শক্তির পার্থক্যটা এখান থেকেই স্পষ্ট।

চীনের পিপলস আর্মি মূলত প্রতিযোগিতা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। চীনের লক্ষ্য ২০৩৫ সালের মধ্যে কৌশলগত দক্ষতা অর্জন এবং ২০৫০ সালের মধ্যে একটি ওয়ার্ল্ড ক্লাস আর্মিতে পরিণত হওয়ায়। এ লক্ষ্যে ২০১৫ সাল থেকে তারা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছে।

চীনা আর্মি বিষয়ে মার্কিন সামরিক সদর দপ্তর পেন্টাগনের সর্বশেষ বার্ষিক মূল্যায়ন হলো - চীনা আর্মি ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে বৃহৎ আকারে হস্তক্ষেপের জন্য তৃতীয় পক্ষ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরাস্ত করার শক্তি অর্জন করছে। পেন্টাগনের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে প্যাসিফিক অঞ্চলের বাইরেও চীন শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা অর্জন করছে ধীরে ধীরে।

গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ২০২০ তথ্য অনুসারে ১৩৮ টি দেশের মধ্যে সামরিক শক্তির দিক দিয়ে চীনের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পরে চীনের অবস্থান। চীনা সেনাবাহিনীতে মোট সৈন্য সংখ্যা ২৬ লাখ ৯৩ হাজার। এর মধ্যে সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা ২১ লাখ ৮৩ হাজার। রিজার্ভ সৈন্য ৫ লাখ ১০ হাজার।

চীনা আর্মি বা পিপলস লিবারেশন আর্মি স্থল, নৌ, বিমান, রকেট ফোর্স এবং স্ট্রাটেজিক সাপোর্ট ফোর্স এ ৫টি শাথা নিয়ে গঠিত। রকেট ফোর্স হলো মূলত মিসাইল ফোর্স । অপর দিকে সাইবার, স্পেস এবং ইলেকট্রনিক-ওয়ার ফেয়ার সার্ভিস বিষয়ে গঠিত স্ট্রাটেজিক সার্পোট ফোর্স। অপর দিকে গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ২০২০ তথ্য অনুসারে সামরিক শক্তির দিক দিয়ে বিশ্বে ভারতের অবস্থান চতুর্থ। ভারত সেনাবাহিনীতে মোট সৈন্য সংখ্যা ৩৫ লাক ৪৪ হাজার। এর মধ্যে সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা ১৪ লাখ ৪৪ হাজার। রিজার্ভ সৈন্য ২১ লাখ।

যে কোনো দেশের সামরিক শক্তি নির্ভর করে দেশটির সামরিক বাজেটের ওপর। চীনের সামরিক বাজেট ভারতের তিনগুন। এখন যুদ্ধে বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর ভুমিকা অনেকে বেড়েছে। আমরা এখন দেখবো চীন ও ভারতের বিমানবাহিনী, স্থলবাহিনী ও নৌবিাহিনীর একটি তুলনামুলক চিত্র।

২০২০ সালের ২২ মে চীন ১৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামরিক বাজেট ঘোষণা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর সামরিক বাজেট। অপরদিকে ১ ফেব্রুয়ারি ভারত ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের জন্য ৬৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামরিক বাজেট ঘোষণা করে।

চীনা বিমানবাহিনীর মোট বিমানের সংখ্যা ৩ হাজার ২১০টি। এর মধ্যে যুদ্ধ বিমান ১ হাজার ২৩২টি। সামরিক পরিবহন বিমান ২২৪টি। হেলিকপ্টার ৯১১টি। অপর দিকে ভারতের বিমানবাহিনীর মোট বিমানের সংখ্যা ২ হাজার ১২৩টি। যুদ্ধ বিমান ৫৩৮টি। সামরিক পরিবহন বিমান ২৫০টি। হেলিকপ্টার ৭২২টি।

চীনের কাছে ট্রাঙ্ক রয়েছে ৩ হাজার ৫০০টি। সাজোয়া যান ৩৩ হাজার। সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি ৩ হাজার ৮০০। টাউড আর্টিলারি ৩ হাজার ৬০০ এবং রকেট প্রপেলার ২ হাজার ৬৫০টি। অপরদিকে ভারতে ট্যাঙ্ক রয়েছে ৪ হাজার ২৯২টি। সাজোয়া যান ৮ হাজার ৬৮৬টি। সেলফ প্রপেল্ড আর্টিলারি ২৩৫টি। টাউড আর্টিলারি ৪ হাজার ৬০টি। রকেট প্রজেক্টর ২৬৬টি।

সীমান্তে দুই দেশের সেনাবিরোধ বিবিসি
সীমান্তে দুই দেশের সেনাবিরোধ- বিবিসি

 

চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী ট্যাঙ্ক হলো ভিটি-৪। এটি উচ্চ প্রযুক্তি সম্পন্ন এ ট্যাঙ্ক ৩ মাইল দূরে পর্যন্ত ব্যাপক বিধ্বংসী গোলা ছুড়তে পারে। ভারতের কাছে থাকা সবচেয়ে শক্তিশালী ট্যাঙ্কের নাম ভিস্ম। এটি রাশিয়ার তৈরি টি-৯০ ট্যাঙ্ক। ভারতে এর নাম দেয়া হয়েছে ভিস্ম। এতে রয়েছে শক্তিশালী জ্যামিং সিস্টেম। দিনে ও রাতে দেখার পদ্ধতি যুক্ত এ ট্যাঙ্ক ৫ মিটার পানির মধ্য দিয়েও চলতে পারে। তিনজন সৈন্য অবস্থান নিতে পারে একটি ট্যাঙ্কে। জ্বালানি ধারন ক্ষমতা ১ হাজার ৬০০ লিটার।

চীনে মোট রণতরীর সংখ্যা ৭৭৭টি। বিমানবাহী রণতরী ২টি। ডেস্ট্রয়ার ৩৬টি। সাবমেরিন ৭৪টি। ফ্রিগেটস ৫২টি। করভেটস ৫০টি। টহল যান ২২০টি এবং মাইন ওয়ারফেয়ার ২৯টি। অপর দিকে ভারতে মোট রণতরীর সংখ্যা ২৮৫টি। বিমানবাহী রণতরী ১টি। ডেস্ট্রয়ার ১০টি। সাবমেরিন ১৬টি। ফ্রিগেট ১৩টি। করভেট ১৯টি। টহল জাহাজ ১৩৯টি। মাইন ওয়ারফেয়ার ৩টি।

বর্তমান সময়ে একটি দেশের সামরিক শক্তি নির্ধারিত হয় সে দেশের সেনাবাহিনী নিজেরা কতটা সমরাস্ত্র উৎপাদন করতে পারে তার ওপর। কারন বিদেশ থেকে আমদানি করা অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে যুদ্ধে জয়লাভ করা প্রায় অসম্ভব। আসুন আমরা জেনে নেই ভারত ও চীনের সমরাস্ত্র উৎপাদন ও আমদানি রফতানির কিছু তথ্য জেনে আসি।

চীন বিশ্বে দ্বিতীয় সমরাস্ত্র প্রস্তুতকারক দেশ। স্টকহোম ইন্টারন্যশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউট এর ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বের বড় ১০টি সমরাস্ত্র প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠানের তিনটিই বর্তমানে চীনের।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে চীন বছরে ৭০ থেকে ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৬ লাখ কোটি টাকা থেকে ৭ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার অস্ত্র বিক্রি করে । এসব অস্ত্রের সিংহভাগই কেনে পিপলস লিবারেশন আর্মি পিএলএর বিভিন্ন শাখা।

অপর দিকে গত মার্চ মাসে প্রকাশিত স্টকহোম সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বের দ্বিতীয় সমরাস্ত্র আমদানিকারক দেশ হলো ভারত। চীন সমরাস্ত্রের জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল নয়। এর বিপরীতে ভারত সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে মূলত বিদেশের ওপর নির্ভরশীল একটি দেশ।

পারমানিবক বোমা ছাড়া ভারতের হাতে যেসব শক্তিশালী সমরাস্ত্র রয়েছে তা হয় যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত না হয় যৌথভাবে নির্মিত। ভারত তাদের প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্রের বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে।

তবে দুই দেশের মধ্যে সমর শক্তির এত পার্থক্য সত্ত্বেও একটি ক্ষেত্রে তা অনেকাংশে ভারসাম্য এনে দিয়েছে । আর তা হলো উভয় দেশের পারমানবিক অস্ত্র এবং তা ব্যবহারের নিজস্ব ক্ষমতা। একটি দেশ যতই দুর্বল হোক কিন্তু তার হাতে যদি পারমানিবক বোমা থাকে এবং তারা এ যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাহলে উভয়ের বিনাস অনিবার্য। সে কারনে এ বোমা অনেক দুর্বল আর শক্তিশালী দেশের মধ্যেও সামরিক শক্তির ব্যবধান অনেক কমিয়ে দিয়েছে। তবে যেহেতু পারমানবিক যুদ্ধে উভয়ের ধ্বংস অনিবার্য তাই এ বোমার ব্যবহারের সম্ভবনা নেই যেখানে উভয়ের হাতে এ ক্ষমতা রয়েছে। ফলে এ বোমা ছাড়া সামরিক শক্তির সব দিক দিয়ে চীনের অবস্থান ভারতের তুলনায় অনেক অনেক উপরে ।

এখনকার সমরাস্ত্র অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। সামরিক বাহিনীর প্রযুক্তিগত দক্ষতা নির্ভর করে সে দেশের সামরিক শক্তি কতটা শক্তিশালী। ফলে বিশ্বের সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী দেশগুলো সামরিক বাজেটের বড় অংশ বরাদ্দ করে সামরিক ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ওপর। এবার আমরা জানবো ভারত ও চীনের সামরিক প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কিছু দিক।

প্রযুক্তি ক্ষেত্রে চীনা অগ্রযাত্রায় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত ভীত। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা সাইবার আক্রমনের পর দেশটির কোনো প্রতিষ্ঠানই চীনা আক্রমন থেকে নিরাপদ মনে করছে না। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমানে আশঙ্কা যুদ্ধক্ষেত্রে পর্যন্ত মার্কিন সিস্টেম অচল করে দিতে পারে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা চীনের কাছে এনার্জি ইউপনস, অ্যাডভান্স স্পেস উইপনস, ইলেকট্রোম্যাগনেটিভ রেলগানস, হাই পাওয়ার্ড মাইক্রোওয়েভ ইউপনস রয়েছে।

আটিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই প্রযুক্তি চীনের বর্তমানে আলোচিত একটি বিষয়। চীন তাদের রণতরীতে যুক্ত করতে যাচ্ছে ইলেকট্রোম্যগানেটিক রেলগান যা শব্দের চেয়ে সাত গুন বেশি গতিতে মিসাইল ছুড়তে পারবে রণতরী থেকে। পেন্টাগন চীনা এই প্রযুক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন। মার্কিন কংগ্রেসের উন্থাপিত এক প্রতিবেদনে চীনা আর্মি সম্পর্কে আরো উদ্বেগজনক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয় চীনের লক্ষ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সুবিধাজনক জটিল সিস্টেমগুলিকে ব্যহত, অক্ষম বা ধ্বংস করে দেয়া। চীনের এ প্রযুক্তিগত অগ্রযাত্রার বিপরীতে ভারতে অবস্থান তেমন উল্লেখ করার মত নয়।

চীনের কাছে পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ ফাইটার ছাড়াও চীনের কাছে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান যা সম্পূর্ণরুপে তাদের নিজেদের তৈরি। চীনের কাছে রয়েছে হাইপারসনিক মিসাইলসহ ভয়াবহ ক্ষমতার বিভিন্ন ধরনের মিসাইল যা তাদের নিজস্ব উদ্ভাবিত। এমনকি চীনের রয়েছে এন্টি স্যাটেলাইট মিসাইল। এভাবে সমরাস্ত্র শিল্প, সমরাস্ত্র প্রযুক্তি, ড্রোন প্রযুক্তি, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সমহ সামগ্রিক প্রযুক্তি ক্ষেত্রে চীনের অগ্রযাত্রা, রকেট ও মহাকাশ কার্যক্রম, শক্তিশালী রণতরী প্রভৃতি বিষয় তুলনা করলে চীনের সাথে ভারতের বড় ধরনের শক্তির পার্থক্য স্পষ্ট।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে