লিবিয়ায় তুরস্ক : মিশর আমিরাত সৌদি ও রাশিয়ার স্বপ্নভঙ্গ

লিবিয়া কার্যত এখন তুরস্কের - ইন্টারনেট

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ৩১ মে ২০২০, ১৬:২৪

গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত লিবিয়ায় একের পর এক বিজয় অর্জন করে চলেছে তুরস্ক সমর্থিত সরকারি বাহিনী। রাশিয়ার অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুড়িয়ে দিয়ে তুর্কি সাঁজোয়া ড্রোন দখল করেছে বিদ্রোহীদের একটি বিশাল বিমান ঘাঁটি। এরপর থেকে সরকারি বাহিনীর বিজয়ের ধারা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, লিবিয়ায় এখন তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উসমানীয় খেলাফতের অবসানের পর লিবিয়ায় আবারও কিংমেকারের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে তুরস্ক। এর মধ্যদিয়ে লিবিয়ায় যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতারকে লিবিয়ার শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মিশর ও রাশিয়ার প্রচেষ্টা ভন্ডুল হতে চলেছে। নিউইয়র্ক টাইমস, আলজাজিরা ও আনাদলু এজেন্সির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আজ আমরা আপনাদের জানাবো লিবিয়া পরিস্থিতির বিশ্লেষণ।

লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে তুরস্ক সমর্থিত বাহিনীর একের পর এক বিজয় দেশটির লৌহমানব খলিফা হাফতারের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এই বিজয়ের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় ছায়াযুদ্ধে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া বিদেশি শক্তিগুলোর মধ্যে নিয়ন্ত্রকের ভ‚মিকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তুরস্ক।

আঙ্কারার সমরাস্ত্রের শক্তিতে বলীয়ান লিবিয়ার সরকারি বাহিনী রাজধানী ত্রিপোলির পশ্চিমে একটি বড় বিমানঘাঁটি দখল করে নিয়েছে। তুরস্কের ড্রোনের সাহায্যে রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে হাফতারের বাহিনীকে ওই ঘাঁটি থেকে হটিয়ে দেয় তারা। এরপর ত্রিপোলির দক্ষিণের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর থেকে হাফতারের বাহিনীকে হটিয়ে দেয় সরকারি বাহিনী।

লিবিয়া সরকারের বাহিনী এরপর ত্রিপোলির দক্ষিণের তিনটি সামরিক ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে। এক বিবৃতিতে সামরিক মুখপাত্র মোহাম্মদ গুনু বলেছেন, তারা আল সাওয়ারিখ, ইয়ারমুক ও হামজা ঘাটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাদের বাহিনী এখন হাফতারের সন্ত্রাসী মিলিশিয়াদের ধাওয়া করছে এবং এটা অব্যাহত রাখবে।

এসব বিজয়ের মাধ্যমে লিবিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত বাহিনীর ভাগ্য খুলে গেছে। কিছুদিন আগেও হাফতারের বাহিনীর কারণে তারা ছিল দুর্বল ও অবরুদ্ধ । তবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়েপ এরদোগান গত জানুয়ারিতে লিবিয়ায় সৈন্য ও সাঁজোয়া ড্রোন পাঠানোর পরই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। একশ’ বছরের বেশি সময় আগে উসমানীয় খেলাফতের অবসানের পর উত্তর আফ্রিকার তেল সমৃদ্ধ দেশটিতে এটিই তুরস্কের সবচেয়ে শক্তিশালী হস্তক্ষেপ। লিবিয়া একসময় ছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীনে।

ইউরোপীয় ফরেন রিলেশন্স কাউন্সিলের এক ব্রিফিংয়ে সম্প্রতি বলা হয়েছে, লিবিয়া কার্যত এখন তুরস্কের। এক বছরের বেশি সময় আগে হাফতার ত্রিপোলি দখলে অভিযান শুরু করেন। সংঘাতের শুরুতে তিনি বেশ সুবিধাজনক অবস্থানেই ছিলেন। ফলে তার মিত্র রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশরসহ তার বিদেশি মদদদাতারা লিবিয়ার ভবিষ্যত নির্ধারণে গুরুত্বপূর্র্ণ ভ‚মিকা রাখার সুযোগ পাবেন বলে ধরা নেওয়া হয়। তবে হাফতারের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক বিজয় সেই স্বপ্নকে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে।

সরকারি বাহিনী এখন যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থানে চলে গেছে। ত্রিপোলির আল ওয়াতিয়া ঘাটিটি থেকে যে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরকারি বাহিনী দখল করেছে সেটি স্থাপন করেছিল রাশিয়া আর তার অর্থ যোগান দেয় আমিরাত। এখন হাফতারের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুই বিদেশি শক্তিই অবমাননাকর পরাজয়ের স্বীকার হয়েছে।

ওই বিমানঘাঁটি দখলের পর হাফতারের বাহিনীকে ত্রিপোলির ৬০ মাইল দূরের কৌশলগত গুরুত্বপূর্র্ণ শহর আসাবা থেকে হাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে তুরস্কের বিজয় এখনো চ‚ড়ান্ত হয়নি। ২০১১ সালে লিবিয়ার সাবেক স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর থেকেই দেশটিতে সংঘাত চলছে। এ সংঘাতের অন্যতম খলনায়ক ৭৬ বছর বয়সী স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল হাফতার এক সময় ছিলেন সিআইএর গুপ্তচর।

হাফতারের ভবিষ্যত গতিবিধি কী হবে তা নির্ধারণ করবে রাশিয়া, আমিরাত ও মিশর। গত ১৪ মাসের অভিযানে এই তিনটি দেশ তাকে সমর্থন দিয়েছে। এসব অভিযানে শত শত বেসামরিক লোক মারা গেছেন আর উদ্বাস্তু হয়েছেন ৪০ হাজার মানুষ। হাফতার রাজনৈতিক আলোচনার বিরোধী। তারা পৃষ্ঠপোষক তিন দেশ এখন তাকে নিয়ে মূল্যায়ন করতে বসেছে। ত্রিপোলি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফাথি বাশাঘা বলেছেন, হাফতারকে রক্ষার জন্য সিরিয়া থেকে রাশিয়ার ১০টি জঙ্গিবিমান লিবিয়ায় পাঠানো হয়েছিলো।

লিবিয়ায় এখন পর্যন্ত কার্যত নেপথ্যে থেকে শক্তি জুগিয়েছে রাশিয়া। ভাড়াটে সেনা দিয়ে মস্কো কার্যসিদ্ধির চেষ্টা করেছে। এখন রাশিয়া সরাসরি সংঘাতে জড়ালে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির দক্ষিণ-পশ্চিমে হাফতার বাহিনীর পরাজয়ের পর অঞ্চলটি ছাড়তে শুরু করেছে রুশ যোদ্ধারা। লিবিয়ার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জিএনএ সরকারের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।অপরদিকে আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি কমান্ড অভিযোগ করেছে লিবিয়ায় রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান অংশ নিয়েছে। রাশিয়া অবশ্য এ অভিযোগ করেছে। তবে বিভিন্ন গনমাধ্যমে রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধাদের সরিয়ে নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

রাশিয়া এসব ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সারগেই ল্যাভরভ এবং তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগ্লু সম্প্রতি টেলিফোনে আলাপের পর দুটি দেশই লিবিয়ায় অবিলম্বে অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। তারা লিবিয়ায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাজনৈতিক সংলাপও পুনরায় শুরুর তাগিদ দিয়েছেন।

গত জানুয়ারিতে লিবিয়া নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রাক্কালে রাশিয়া ও তুরস্ক একই আহ্বান জানিয়েছিল। তবে তাতে কর্নপাত করেননি হাফতার। তিনি বরং তার মিত্রদের একজনকে অন্যের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলেছেন।

বার্লিনে বিশ্ব নেতাদের ওই সম্মেলনের সময়ই আমিরাত গোপনে হাফতার বাহিনীর জন্য সামরিক সহায়তা পাঠাতে শুরু করে। লিবিয়ায় অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা লংঘন করে এসব অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো হয়। জাতিসংঘ এখন আমিরাতের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে।

তুরস্ক সমর্থিত বাহিনীর সাম্প্রতিক বিজয়ের ফলে ত্রিপোলির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হাফতার বাহিনী এখন লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এ বাহিনীর দখলে এখন আছে শুধু ত্রিপোলির দক্ষিণপূর্বের তারহাওনা।

লিবিয়া বিশেষজ্ঞ ওলফ্রাম ল্যাচার বলেন, লিবিয়ার সামরিক ভারসাম্য পুরোপুরি বদলে গেছে। এতে হাফতারের বাহিনীর নৈতিক শক্তির ওপর নাটকীয় প্রভাব পড়তে পারে। হাফতারের জোট ধরে রাখাও কঠিন হতে পারে।

তুরস্কের এই সাফল্যে প্রমাদ গুণতে শুরু করেছেন মিশরের স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। তিনি শঙ্কিত যে তুরস্ক তার এই অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে লিবিয়ায় একটি স্থায়ী সামরিক ঘাটি তৈরি করতে পারে। লিবিয়ার এই সংঘাতে প্রাণ যাচ্ছে বহু সাধারণ মানুষের। জাতিসংঘ বলছে, ১ এপ্রিল থেকে ১৮ মের মধ্যে দেশটিতে ৫৮ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। এর বেশিরভাগই ঘটেছে হাফতার বাহিনীর হাতে।

লিবিয়ায় নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চরম বিভক্ত থাকায় এসব অপরাধের বিচার হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে আশা করা হচ্ছে হাফতার এখন রাজনৈতিক সংলাপে রাজি হবেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রো লিবিয়ায় বিদেশি হস্তক্ষেপের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন। এরপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এরদোগানকে ফোন করে লিবিয়ায় উত্তেজনা প্রশনের আহ্বান জানিয়েছেন। তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তার দেশ লিবিয়ার ভারসাম্য বদলে দিয়েছে এবং একটি পূর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধ এড়াতে সক্ষম হয়েছে।

অতীতে হাফতার রাজনৈতিক আলোচনার পরিবর্তে সামরিক পদক্ষেপের ওপর দ্বিগুণ জোর দিয়েছেন। তিনি জাতিসংঘের আলোচনার প্রস্তাবও নাকচ করে দিয়েছেন। ইউরোপীয় ফরেন রিলেশন্স কাউন্সিলের কর্মকর্তা তাকের মেগেরিসি সতর্ক করে দিয়েছেন যে লিবিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ দরকার। না হলে সেখানেও সিরিয়ার মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

লিবিয়ার বিশ্লেষক মোহাম্মদ বুইশিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন খলিফা হাফতার চলতি বছরের মধ্যেই চ‚ড়ান্ত পরাজিত হবেনএমনকি তারও আগেই তার বিদায় হবে। বুইশিয়ার বলেন, হাফতার তার নিয়ন্ত্রিত পূর্বাঞ্চলে উপজাতীয়দের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে এসব উপজাতীয়রা তাকে পরিত্যাগ করেছে। তারা বুঝতে পারছেন হাফতারের পথ প্রাণসংহারি।

ইতোমধ্যেই পূর্বাঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম গোত্র আওয়াকির হাফতারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। লোকজন পরাজিত শক্তির সঙ্গে থাকতে চাচ্ছে না।

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র এক সময় হাফতারকে সমর্থন দিলেও এখন তাকে আমেরিকার জাতীয় স্বার্থের জন্য হুমকি মনে করা হচ্ছে। লিবিয়ায় রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র হাফতারকে তাদের কৌশলগত স্বার্থের জন্য হুমকি মনে করছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ১৯৫১ সালে লিবিয়ার স্বাধীনতাকে সমর্থন করেছিল দেশটিতে সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতি ঠেকানোর জন্য। এখনও সেখানে রাশিয়ার উপস্থিতি গ্রিস, ইতালি ও ফ্রান্সের জন্য হুমকি। তাই যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়ার রাশিয়ার উপস্থিতি চাইবে না।

হাফতারের বাহিনীর বেসামরিক ও ক‚টনীতিক মিশনের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এতেও যুক্তরাষ্ট্র বিরক্ত। তারা হাফতারকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মনে করতে শুরু করেছেন। আমেরিকানরা এখন লিবিয়া সরকারের পক্ষে তুরস্কেও অভিযানকে তাদের কৌশলগত স্বার্থের অনুকুল হিসেবে দেখছেন।

ন্যাটোও এখন লিবিয়ার বৈধ সরকারকে সমর্থন দানের কথা বলছে। তুরস্ক ন্যাটোর খুবই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আর ন্যাটোর অন্যতম মিশন হচ্ছে রাশিয়ার আগ্রাসন রোধ করা। এজন্যই ন্যাটো মহাসচিব লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন যে তার সংস্থা লিবিয়ার সামরিক পুলিশের সঙ্গে জোট গড়তে চায়। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র এখন আমিরাত সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে যাতে তারা হাফতারকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে