চীনকে নিয়ে মার্কিন কৌশলপত্রে যা আছে

আমেরিকা ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের ওপর এই কার্টুনটি আাঁকা হয়েছে - স্পুটনিক নিউজ

  • মেহেদী হাসান
  • ৩০ মে ২০২০, ১৫:০৮

আমেরিকার বিশ্বাস চীন পশ্চিমা বিশ্বের সাথে একটি ব্যাপকভিত্তিক বাণিজ্যক আর আদর্শিক লড়াইয়ে লিপ্ত। চীনের কারণে পশ্চিমা বিশ্বের বাণিজ্যিক আধিপত্য আর আদর্শ, মূল্যবোধ ও বিশ্বাস হুমকির মুখে। চীনকে বড় ধরনের হুমিক হিসেবে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী তার ভবিষ্যত আধিপত্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে । ফলে চীনকে মোকাবেলায় এবার যুক্তরাষ্ট্র একা মাঠে নামার পরিবর্তে বিশ্বব্যাপী তার সমস্ত মিত্র দেশ আর আন্তর্জাতিক সমস্ত সংস্থাকে এক যোগে লড়াইয়ে লিপ্ত করার ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্র দেশগুলোর অভিন্ন আদর্শ, মূল্যবোধ, বিশ্বাস আর বিশ্বাসের ওপর চীনা যেকোনো আক্রমন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজ দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানিক শক্তির সাথে মিত্র দেশ ও বিশ্বব্যাপী সমস্ত আন্তর্জাতিক সংস্থার ব্যাপকভিত্তিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করবে।

মিত্র দেশ আর আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা নিশ্চিত করার আগে যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশের সমস্ত সরকারি, বেসরকারি সংস্থা, সিভিল সোসাইট এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারের পূর্ণ সহযোগিতা নিশ্চিত করবে চীনা সকল হুমকি মোকাবেলার ক্ষেত্রে।

এ লক্ষ্যে হোয়াইট হাউজ প্রকাশ করেছে ব্যাপকভিত্তিক একটি পলিসি পেপার। ট্রাম্প প্রশাসন ২১ মে তাদের প্রথম পলিসি পেপার উপস্থাপন করেছে। এতে চীন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপকভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির রুপরেখা প্রকাশ করা হয়েছে। চীকনে মোকাবেলায় আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত প্রতিরক্ষা কৌশল গ্রহনের আহবান জানানো হয়েছে এ পলিসি পেপারে। পলিসি পেপারে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কমন মূল্যবোধ সিস্টেম চীনের কারনে হুমকির মুখে পড়েছে।

চীনা হুমকি মোকাবেলায় হোয়াইট হাউজের পলিসি পেপারে সবার্ধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, জোট এবং অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা বিষয়ে । চীনকে মোকাবেলায় দ্বিতীয় যে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কাজকর্ম পরিহার করতে চীনকে বাধ্য করা। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র দেশগলোর মূল জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কোনো কিছু যেন চীন করতে না পারে। তবে চীনের সাথে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে দ্ব›দ্ব বা সংঘাত চায় না যুক্তরাষ্ট্র। বরং যে সব ক্ষেত্রে উভয় দেশের সমান স্বার্থ রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে পারষ্পরিক সহযোগিতা চায় যুক্তরাষ্ট্র। চীনা জনগনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র গভীর শ্রদ্ধাশলী বলে পলিসি পেপারে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয় আমরা চীনের উন্নতি থামিয়ে দিতে চাইনা। আর চীনা জনগণকেও এ থেকে বিরত রাখতে চাই না। আমরা চাই চীনের সাথে সুষম প্রতিযোগিতা যেখানে উভয় দেশের ব্যবসা বানিজ্য এবং ব্যক্তি বর্গ নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধি লাভ করবে।

চীনের সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে তাদের দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তিবর্গ, সিভিল সোসাইটি, বেসরকারি খাত এবং স্থানীয় সরকারের সহযোগিতা দরকার। হোয়াইট হাউজ পলিসি পেপারে এ নীতি বহাল রাখা হয়েছে। তবে তার সাথে সাথে চীনকে মোকাবেলায় বিদেশী মিত্র রাষ্ট্র, অংশীদার, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে নতুন পলিসি পেপারে।

এ ক্ষেত্রে মনোযোগ দেয়া হয়েছে ইউরোপ আর ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলকে। তবে এটি শুধু এ অসব অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। হোয়াইট হাউজের এ পলিসি পেপারের মাধ্যমে এটি পরিষ্কার করা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে আর কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।

আমেরিকা বনাম চীন
আমেরিকা বনাম চীন

 

২০০১ সালে চীন বিশ্ব বানিজ্য সংস্থা ডব্লিউ ডি ও তে যোগদিতে রাজি হয়। এর মাধ্যমে বেইজিং ডব্লিউ টি ওর মুক্ত বাণিজ্য দৃষ্টিভঙ্গি এবং বাণিজ্য পদ্ধতির মূলনীতি মেনে নেয়। ডব্লিউ টি ও সদস্য দেশগুলো তখন আশা করে চীন তার অর্থনীতিকে বাজার মুখী করার ক্ষেত্রে সংস্কার করবে। কিন্তু চীনের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত নকলবাজি, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট চুরি, পদ্ধতিগতভাবে প্রযুক্তি আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে চীন প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি করছে মর্মে অভিযোগ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি সব রাষ্ট্রের স্বার্থে চীনা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা দরকার।

চীনের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, লুন্ঠমূলক আচরণ, এবং বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে অন্যান্য কোম্পানীর ওপর চীনা কোম্পানীর প্রধান্য বিসন্তারের অভিযোগ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের কারণে শুধু বাণিজ্য হুমকির মুখে নয়। বরং চীনা কমিউনিস্ট পার্টি জোর প্রচারণা চালাচ্ছে যে, পশ্চিমা উন্নত দেশের তুলনায় তাদের দেশের শাসন ব্যবস্থা ভাল কাজ করছে। বেইজিং এটা পরিষ্কার করেছে যে, পশ্চিমাদের সাথে তারা একটি আদর্শিক লড়াইয়ে লিপ্ত হিসেবে দেখছে নিজেদের। আজকের প্রেসিডেন্ট শি যখন ২০১৩ সালে দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তখন তিনি দলের প্রতি আহবান জানিয়েছেন পশ্চিমাদের সাথে সহযোগিতা এবং সংঘাতের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার। তিনি তখন বলেন, পূঁজিবাদের বিনাশ অনিবার্য আর সমাজবাদের জয় সুনিশ্চিত।

হোয়াইট হাউজ পলিসি পেপারে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর অভিন্ন মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের ওপর চীনা আক্রমন প্রতিহত করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজ দেশের সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশ্বব্যাপী সমস্ত মিত্র দেশ আর আন্তর্জাতিক সংস্থার ব্যাপকভিত্তিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হবে।

চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া পদক্ষেপ দৃশ্যমান করতে যুক্তরাষ্ট্রে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন চীনা কোম্পানীর বিদেশী অর্থায়ন বন্ধের বিষয়ে আইন প্রনয়নের উদ্যোগ চলছে।

হংকংয়ের অভ্যন্তরীন বিষয়ে আরো হস্তক্ষেপ এবং চীনা কর্তৃত্ব আরো সংহত করার ক্ষেত্রে নতুন আইন করতে যাচ্ছে চীন। ফলে হংকংয়ের পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারন করতে যাচ্ছে সামনে। আর হংকং পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনুকুল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে চীন বিরোধী যুদ্ধে।

ট্রাম্প প্রশাসনের পলিসি পেপার প্রকাশের পরের দিন বেইজিং একে অগ্রাহ্য করেছে। আর এর প্রতি তেমন কোনো আগ্রহও দেখায়নি চীন। ২২ মে শুরু হওয়া চীনা সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে চীনা নেতৃত্ব আহবান জানিয়েছেন উন্নয়নের জন্য মূলে তথা গ্রামে ফিরে যাওয়ার ।

গ্রাম উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে চীন। ৪০ বছর আগে চীনের ৯০ ভাগ জনশক্তি নিয়োজিত ছিল কৃষিতে। কিন্তু বর্তমানে চীনের গ্রামে বাস করে ৪০ ভাগের কম মানুষ। মোট হিসেবে এ সংখ্যা হবে প্রায় ৫০ কোটি।

প্রধানমন্ত্রী লি কিকিয়াং তার সরকারি প্রতিবেদনে বলেন, গ্রামে উচ্চ মান সম্পন্ন ফার্মল্যান্ডের আওতা বাড়াতে হবে। শুকর, রাইস ব্যাগ এবং ভেজিটেলব বাস্কেট বাড়াতে হবে। রাইস ব্যাগ আর ভেজিটেবল বাস্কেট বিষয়ে পূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হবে যথাক্রমে রাজ্য সরকার আর সিটি মেয়রদের। ১৪০ কোটি মানুষকে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য এটা আমাদের করতে হবে এবং এটা আমাদের সামর্থ্যরে মধ্যে রয়েছে।

সোয়াইন ফেবারের কারনে চীনের গ্রামে অর্ধেকের বেশি শুকর মারা গেছে। ফলে বিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ শুকর বিলীন হয়ে গেছে। আর বর্তমানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিরাজমান চীন বিরোধী পরিস্থিতির কারনে চীন তাদের খাদ্য উৎপাদন বিষয়ে উদ্বিগ্ন হতে শুরু করেছে। কারন চীন ব্যাপকভাবে খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক এ বিরুপ পরিস্থিতির কারনে চীন আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর আর আস্থা রাখতে পারছে না। সে কারনে চীন তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান দেশেই নিশ্চিত করতে চাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটি কৌশল হলো উৎপাদন বৃদ্ধি করা। প্রধানমন্ত্রী লি বলেছেন, কৃষক যাতে কৃষিপন্য মজুদ করতে পারে আর তাদের সব ধরনের বানিজ্যিক সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমরা সহায়তা দেব।

চীনা এ গ্রামমুখী নীতির আওতায় গ্রামের বেকারদের সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে। চীনা ইতিহাসে প্রথম বারের মত গ্রামের বয়স্কদের জন্য পেনসন পদ্ধতির ব্যবস্থা করা হবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। এর আওতায় জমি চাষের বিনিময়ে কৃষকরা বেকার ভাতা এবং পেনসন সুবিধা পাবে।

২২ মে গ্রেট হলের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস অধিবেশনে ঘোষণা দেয়া হয়েছে চীন এ বছর ৮৫ লাখ নাগরিককে গ্রাজুয়েট করবে। এর মধ্যে অর্ধেক হবে ইঞ্জিনিয়ার। দেশব্যাপী তারা ৫জি নেটওয়ার্ক চালু করবে। বিশ্বে চীন হবে প্রথম উচ্চ ডিজটালাইজড দেশ। এগুলো কোনো বাজে প্রতিশ্রুতি নয়। তার প্রমান হলো ২০ বছরের কম সময়ে তারা ১ লাখ ৩০ হাজার কিলোমিটার নতুন রেল লাইন স্থাপন এবং সংস্কার করেছে । এক দশকে তারা ২০টি সাবওয়ে এবং ১০০টি লাইন স্থাপন করেছে চীনা বিভিন্ন মেট্রোপলিটনে।

অপর দিকে চীনের বিপরীতে গ্রাজুয়েটের সংখ্যা এবং মানের উন্নতি হয়নি যুক্তরাষ্ট্রে । ইউরোপের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের রেল এবং বিমান অবকাঠামোর মান অনেক নিম্ন অথচ অনেক ব্যয়বহুল।

সংসদ অধিবেশনে তাওয়ান বিষয়ে লি বলেন, তাইওয়ানের জনগনের সাথে আমরা কথা বলব। তাদেরকে এক চীন নীতি মেনে নেয়া এবং স্বাধীন তাইওয়ান এর চিন্তা পরিত্যাগের বিষয়ে আমরা উৎসাহিত করব। লির বক্তব্যে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল চীন বিরোধী হোয়াইট হাউজের পলিসি পেপার বিষয়ে।

কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন বিশ্বকে দেয়ার মত কোনো আদর্শ নেই চীনের কাছে। যা আছে তা হলো মূলত চীনের নিজের স্বার্থ। তারা চায় এমন একটি বানিজ্য যা উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক। আর এতে অনেকের কাছে মনে হচ্ছে অন্য পক্ষের চেয়ে চীনারা বেশি লাভ করছে।

অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রয়েছে বৃহত্তর আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি যা অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া। যুক্তরাষ্ট্রের এ দৃষ্টিভঙ্গি দেখাতে চায় যে, তারা শুধুা নিজের স্বার্থের জন্য নয় বরং সবার স্বার্থের জন্য কাজ করছে।

তবে সবার জন্য সত্যিকার অর্থে ভাল এমন একটি বিশ্বজনিন আদর্শ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র হলো অন্যন্যা রাজ্যের মধ্যে একটি রাজ্য মাত্র। আর এটা মূলত চীনের দৃষ্টিভঙ্গির মূল সমস্যা। এ দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথা হলো আমরা তোমাকে ভাল ব্যবসায় এনে দেব। সুতরাং তুমি আমাদের সাথে ভাল আচরণ কর। ট্রাম্পের মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন স্লোগান সত্ত্বেও এখনো অর্থের আগে তার আদর্শের প্রতি অন্য দেশগুলোকে প্রলুব্ধ করতে চায়।

আর এখানেই আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে যে, চীন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের বিপরীতে বিশ্বব্যাপী একটি ভাল ধারনা তৈরি করছে যা তাকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মত যুক্তরাষ্ট্র আর পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে সাংঘর্ষিক স্থানে নিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে