চীন-ভারত যুদ্ধের দামামা

চীনা সেনা - ইনসাইডাপেপার

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ৩০ মে ২০২০, ১৪:৪৭

মাঝে মাঝে উত্তেজনা দেখা দিলেও গত তিন দশক ধরে চীন ও ভারত সীমান্ত অনেকাংশে শান্ত ছিল। তবে ভারতের সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপের জবাবে চীন এবার বেশ শক্ত অবস্থান নিয়েছে। ভারত সীমান্তে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে চীন। এমনকি ভারতের মাটিতে ঢুকে পড়েছে হাজার হাজার চীনা সেনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদীয়মান পরাশক্তি চীন এবার পরিকল্পিতভাবেই এসব পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা বলছেন, চীন ও ভারতের এই উত্তেজনা একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এমন সময় ভারতের বিরুদ্ধে চীন রণপ্রস্তুতি নিচ্ছে যখন নেপাল ও পাকিস্তানের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।

পরমাণু শক্তিধর ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। সঙ্ঘাতের উপকেন্দ্র লাদাখে দু’পক্ষই সৈন্য সংখ্যা দ্রুত বাড়াচ্ছে । পূর্ব লাদাখে চীন ও ভারতের প্রকৃত সীমান্ত রেখার বেশ কিছু অঞ্চলে দু’দেশের সেনারা মুখোমুখি অবস্থানে নিয়েছে। ২০১৭ সালে ডোকলাম বিরোধের পর সীমান্তে দু'দেশের মধ্যে এবারই সবচেয়ে বড় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।

মে মাসের প্রথমদিকে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে হাতাহাতির পর কমান্ডাররা আলোচনা করে বিষয়টি মিটিয়ে নিলেও উত্তেজনা কমেনি। বরং তা আরো বাড়ছে।

ভারত-চীন সীমান্ত হিসেবে যা গণ্য হয়, লাদাখে সেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসিতে চীন এবার অন্যান্যবারের তুলনায় ভিন্নরকম প্রস্তুতি নিয়েছে। প্যাংগং সো আর গালওয়ান উপত্যকায় হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করেছে চীন।

গত দু'সপ্তাহে গালওয়ান উপত্যকায় শক্তি বাড়িয়েছে চীনের সেনাবাহিনী। ১০০টি শিবির তৈরি করেছে তারা। বাঙ্কার তৈরিরও চেষ্টা চলছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বিতর্কিত এলাকায় ভারতও সেনা সমাবেশ বাড়িয়েছে।

সমর বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, দিন দিন পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটছে তাতে দু’পক্ষ জলদি কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে না পারলে রণক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে পূর্ব লাদাখের এলএসির আশপাশের এলাকা।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় চীনা সেনার উপস্থিতি এবং সংখ্যাবৃদ্ধি। এটা সবচেয়ে বেশি হয়েছে গালওয়ান উপত্যকায়।

ভারতের অবসরপ্রাপ্ত নর্দান আর্মি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডিএস হুডা বলছেন, ‘বিষয়টি গুরুতর। পরিস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক নয়, বরং যথেষ্ট অস্বস্তির। বেশ কিছু জায়গায় চীনের সেনা সীমান্তরেখা লঙ্ঘন করেছে। এটি রুটিনমাফিক সীমান্ত লঙ্ঘন নয়। উদ্বেগের বিষয় সেটিই।

চীনা সৈন্যরা এবার ঘাঁটি তৈরি করেছে লাদাখের গালওয়ান ভ্যালির মতো সম্পূর্ণ নতুন জায়গাতেও, যেখানে আগে কোনও বিরোধের ইতিহাস ছিল না। সেদিক থেকেও এ এলাকায় চীনা সেনা সমাবেশ উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

৫ মে দু’দেশের সেনার মধ্যে সংঘর্ষের পর থেকেই পূর্ব লাদাখ পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। ওইদিন ভারত ও চীনের সেনারা সংঘর্ষে জড়িয়েছিল লোহার রড, লাঠি নিয়ে। পাথর ছোড়াছুড়িও হয়েছিল। পরে বৈঠকে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও ৯ মে উত্তর সিকিমে ফের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুপক্ষের সেনারা। ওই সময়েই চীন অভিযোগ করে, ভারতীয় সেনারা ঢুকেছিল তাদের এলাকায়। একজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা চীনা সেনাদের মার খেয়ে গুরুতর আহত হলে তাকে বিমানে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। এমন কী কয়েকজন ভারতীয় সেনাকে চীন বেশ কিছুক্ষণ আটকে রেখেছিল। অবশ্য ভারত তা অস্বীকার করেছে।

উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে দেখা যায়, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে চীন প্রায় ১০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে। তিব্বতের গারি গুনশা ঘাঁটিতেও চলছে নির্মাণকাজ। সেখানে রয়েছে বেশ কিছু যুদ্ধবিমানও। এ উত্তেজনার মধ্যেই ভারত থেকে নিজেদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ারও প্রস্তাব দিয়েছে চীন।

কেন আচমকা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এই ধরনের সামরিক উত্তেজনা তৈরি হল, তা পর্যবেক্ষকদেরও বেশ দ্ব›েদ্ব ফেলেছে।

প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল লাদাখ থেকে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। সীমান্তে ভারতের অবকাঠামোর নির্মাণের জেরে সাম্প্রতিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন। চীন সীমান্তে গত ১০ বছরে ভারত বিমানঘাঁটিসহ বহু সামরিক স্থাপনা তৈরি করেছে।

তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, ভারতীয় সেনার স্বাভাবিক টহল বা পেট্রলিং প্যাটার্নকে বাধা দিয়ে চীন সীমান্তে নানা কর্মকান্ড চালাচ্ছে। অন্যদিকে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের বিবৃতিতে ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা ট্রেসপাসিং বা অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগ এনেছিল।

১৯৬২ সালে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে চীন ভারতকে নাস্তানাবুদ করার পর বড় ধরনের সংঘাত হয়নি। এমনকি ১৯৭৫ সাল থেকে সীমান্তে একটি বুলেটও ছোড়া হয়নি। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন এখন ভারতের সামরিক শক্তির পরীক্ষা নিতে চাইছে। ফলে এখন শান্তির কোনো গ্যারান্টি নেই।

ভারত ও চীনের মধ্যে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম অচিহ্নিত সীমান্ত যা ৩৪৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন রিপোর্ট অনুসারে, গত দু-তিনসপ্তাহের ভেতর চীনা সেনাবাহিনী এই এলএসি অন্তত চার জায়গায় অতিক্রম করে অবস্থান নিয়েছে।

ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা লিখেছেন, এই প্রথম সমগ্র গালওয়ান ভ্যালিকেই চীন নিজেদের বলে দাবি করছে। চীনের এই অনুপ্রবেশ হয়েছে বিরাট জায়গা জুড়ে। উত্তর লাদাখের গালওয়ান ভ্যালি থেকে কযয়েকশো কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ লাদাখের ডেমচক আর সেখান থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে সিকিমের নাকু লা পাস পর্যন্ত। এটা থেকে বোঝা যায় এই গোটা অভিযানটার পরিকল্পনা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে খুবই উঁচু মহলে। এমন নয় যে স্থানীয় কমান্ডাররা তাদের ইচ্ছেমতো এগুলো করছেন।

চীনে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত অশোক কান্থা মনে করেন, প্রত্যেক গ্রীষ্মে দুদেশের সেনাদের মধ্যে যেমন হাতাহাতি বা মারামারি হয় তার চেয়ে এবারের সংঘাত কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। প্রথমত চীন এবার অনেক বেশি আগ্রাসী, দ্বিতীয়ত তারা একসঙ্গে অনেক জায়গায় হামলা চালাচ্ছে। আর গালওয়ান ভ্যালিতে এলএসির নতুন ব্যাখ্যা এনে নতুন একটা ফ্রন্ট খুলতে চাইছে।

অশোক কান্থা বলেন, এর কারণ কী বলা মুশকিল, তবে হতে পারে তারা বিতর্কিত সীমানার ওপর নিজেদের দাবি জোরেশোরে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। আবার এটা তাদের প্রেসার ট্যাকটিক্সের অংশও হতে পারে, যার মাধ্যমে তারা মনে করিয়ে দিতে চায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানা ইস্যুতে বা এমন কী করোনাভাইরস প্রশ্নেও ভারত যেন চীনের সংবেদনশীলতা খেয়াল রাখে।

চীন ও ভারতের মধ্যে বছরে বাণিজ্যের পরিমাণ ৯২ বিলিয়ন ডলার। তবে ভারতের বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি নয়াদিল্লিকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের মাখামাখিকে সুনজরে দেখছে না চীন। আবার পাকিস্তান ও নেপালের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। অন্যদিকে চীনের উচ্চাভিলাসী বেল্ট ও রোড প্রকল্প ভারতের জন্য একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন চাচ্ছে সীমান্ত সমস্যা জটিল করে তুলতে যাতে ভারত তিব্বতের দিকে নজর দিতে না পারে। নয়াদিল্লিভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা বলেন, এই উত্তেজনা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। হাজার হাজার চীনা সেনা এখন ভারতের মাটিতে অবস্থান করছে। তারা যুদ্ধ চায়।

ভারতের সঙ্গে নজিরবিহীন উত্তেৎনার মধ্যেই চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। জিনপিং বলেন, যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করে তুলতে হবে। সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং দেশের কৌশলগত স্থিতিশীলতার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি রাখতে দেশটির সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন জিনপিং।

এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লাদাখের পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়ত ও তিন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

তিন দশক আগে ভারত ও চীন সমঝোতায় পৌছেছিল যে তারা যুদ্ধে জড়াবে না। তবে চীন এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। তিন দশক আগে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে চীন ও ভারত ছিল প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু এরপর থেকে চীনের নাটকীয় উত্থান ঘটেছে। ফলে যুদ্ধ বেধে গেলে ভারতের শোচনীয় পরাজয় হতে পারে।

চীনের জিডিপি এখন ১৩ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার আর ভারতের জিডিপি ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের। চীনের অর্থনীতির আকার ভারতের ৫ গুনেরও বেশি। গত বছর চীনের ঘোষিত প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল ২৬১ বিলিয়ন ডলার আর ভারতের ৭১ বিলিয়ন ডলার। চীনের সামরিক বাজেট ভারতের প্রায় চারগুণ। ভারত যেখানে আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার জন্য চেষ্টা করছে চীনের সেখানে লক্ষ্য বিশে^র অন্যতম শক্তিতে পরিণত হওয়া।

বর্তমানে ২০ লাখের বেশি সেনা নিয়ে বিশ্বের সব থেকে বড় সামরিক বাহিনী চীন। যেখানে ভারতের রয়েছে ১৩ লক্ষ সেনা।

গতবছর পর্যন্ত চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির ছিল ৩ হাজার ১৮৭ বিমান। এর মধ্যে ১২৭১টি জঙ্গিবিমান, ১৩৮৫টি অ্যাট্যাক বিমান, ২০৬টি অ্যাট্যাক হেলিকপ্টার । অন্যদিকে, গত বছর পর্যন্ত ভারতের কাছে ৬৭৬টি জঙ্গিবিমান,, ৮০৯টি অ্যাট্যাক বিমান, ১৬টি অ্যাট্যাক হেলিকপ্টার। চীনের সাবমেরিন রয়েছে ৭৬টি আর ভারতের ১৬টি।

যুদ্ধের জন্য চীনের কাছে প্রায় ১৩ হাজার কামান রয়েছে। ভারতের কাছে সেই সংখ্যা তিনভাগের এক ভাগ, মাত্র ৪ হাজার ১০০। চীনের কাছে ২০৫০ টি রকেট লঞ্চার রয়েছে সেখানে ভারতের কাছে সেই সংখ্যা মাত্র ২৬৬।

ভারত এবং চীনের মধ্যে সীমান্তের কিছু এলাকা নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। ভারত সরকার জানিয়েছে, ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে চীনা সেনারা ১০২৫ ভার ভারতীয় ভূখন্ডে অনুপ্রবেশ করেছে। তবে ১৯৬২ সালের যুদ্ধ বা ১৯৬৭র গোলাগুলি বিনিময়ের পর থেকে ভারত-চীন সীমান্তে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রয়োগ হয়নি বললেই চলে।

২০১৭ সাল থেকে অবশ্য পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। সে বছর ডোকলামে টানা ৭৩ দিন দু’দেশের বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। পরে কূটনৈতিক পথে সমস্যার সমাধান হয়। তবে অরুণাচল প্রদেশকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে বা সিকিম এবং লাদাখের নানা অংশে এলএসি লঙ্ঘন করেছে চীনা সেনারা।

ফলে ডোকলামের ঘটনার বছর তিনেকের মধ্যেই আবার বড়সড় উত্তেজনা তৈরি হয়েছে ভারত-চীন সীমান্তে লাদাখের এই সামরিক উত্তেজনা খুব সহজে মিটবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন না।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে