যুক্তরাষ্ট্রের গোপন ঘাটির কাছে চীনা জাহাজ নিয়ে উত্তেজনা

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনার পতাকা- সংগৃহীত

  • মেহেদী হাসান
  • ১২ মার্চ ২০২০, ১২:১৪

পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর, ভারত মহাসগর আর দক্ষিন চীন সাগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ব্যাপক রণসজ্জা চলছে চীন অস্ট্রেলিয়া আর ভারতের মধ্যে। এ অঞ্চলে অনেক আগে থেকেই ব্যাপক শক্তি নিয়ে উপস্থিত রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর বর্তমানে চীনের হুমিক মোকাবেলায় ভারত ও অস্ট্রেলিয়া সরাসরি গভীর প্রতিরক্ষা বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। অস্ট্রেলিয়া উত্তরাঞ্চলের সমস্ত বিমান ও নৌঘাটিকে আধুনিকায়নের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে । এসব বিমান বন্দরে মার্কিন ভারী বোমারু বিমান অবতনের সক্ষম করা এবং নৌঘাটিতে মার্কিন শক্তিশালী রণতরির সংখ্যা বাড়ানো। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার সামরিক উপস্থিতি আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে । এজন্য বিপুল অর্থ বরাদ্দ করেছে।

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নৌঘাটির কাছে জাহাজ পাঠিয়েছে চীন। অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে মার্কিন গুরুত্বপূর্ণ এ ঘাটিতে রয়েছে স্পেস টেলিস্কোপ কেন্দ্র । এমন একটি ঘাটির কাছে চীনা উচ্চ প্রযুক্তির নৌ জাহাজ পাঠানোকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের দেশগুলোর রণসজ্জা নতুন মাত্রা পেয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমে সমুদ্র চলাচল রুটে নজরদারি বাড়িয়েছে চীন। অষ্ট্রেলিয়া নর্দান এয়ার ডিফেন্সে বড় ধরনের পািবর্তন আনার ঘোষনা দেয়ার এক সপ্তাহের মাথায় চীন এ নজরদারি কার্যক্রম বৃদ্ধি করে। অস্ট্রেলিয়া নর্দান এয়ার ডিফেন্স শক্তিশালী করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তার ফলে প্রশান্ত মহাসাগর ও দক্ষিন চীন সাগরে মার্কিন প্রভাব আরো বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে। অষ্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা বিভাগ জানিয়েছে, গত দুই মাস ধরে সমুদ্রগামী চীনা জাহাজ চলাচল পর্যক্ষেন করেছে দেশটি । চীনা এসব জাহাজ পূর্ব চীন থেকে পশ্চিম অষ্ট্রেলিয়া উপকূল বরাবর গভীর সমুদ্রে সমীক্ষা পরিচালনা করছে। এ বানিজ্য রুটে জাভা সমুদ্র হয়ে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিস্টমাস দ্বীপ পর্যন্ত জাহাজ চলাচল করে। আর দক্ষিন চীন সগার পর্যন্ত চলাচল করে অষ্ট্রেলিয়ান সাবমেরিন।

অষ্ট্রেলিয়ার একজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কমিশনকে জানান, এ অঞ্চলের সাবমেরিন চলাচল রুট সম্পর্কে জানার জন্য বেইজিং খুবই আগ্রহী। এ ছাড়া এখানে উচ্চ প্রযুক্তির চীনা জাহাজের উপস্থিতি বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিক্রিয়া কেমন হয় সেটাও সে পরীক্ষা করতে চায়। এ কর্মকর্তা জানান, মার্কিন গোপন নৌ ঘাটি নেভল কমিউনিকেশন স্টেশন হ্যারল্ড ই হল্ট এর কাছাকাছি আন্তর্জাতিক সমুদ্র সীমায় অবস্থান নিয়েছে চীনা জাহাজ জিয়াং ইয়াং হং-০১ নোঙ্গর।

উত্তর-পশ্চিম অন্তরীপের যুক্তরাষ্ট্রের এ গোপন নৌঘাটি থেকে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থানরত অষ্ট্রেলিয়া ও মার্কিন জাহাজ এবং সাবমেরিনে রেডিও বার্তা পাঠিয়ে থাকে। এখানে মহাকাশ পর্যবেক্ষন টেলিস্কোপ কেন্দ্রও রয়েছে। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল স্পেস সার্ভিলেন্স নেটওয়ার্কের অংশ। এটি মহাকাশে চলাচলরত বিভিন্ন যান ও বস্তু সনাক্ত করতে পারে। দূরে অবস্থিত কোনো বিমান ঘাটি থেকে এটি নিয়ন্ত্রন করা হয়। মার্কিন এ ঘাটির কাছে চীনা জাহাজ যখন সমীক্ষা ও নজরদারি কর্মকান্ড পরিচালনা করে তখন সেখানে নিয়মিত টহল দিচ্ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাস্ট অ্যাটাক সাবমেরিন ইউএসএস টেক্সাস। মার্কিন সাবমেরিনের এ টহল কার্যক্রম চলে অষ্ট্রেলিয়ার পার্থের কাছে অবস্থিত স্টালির্ং নৌঘাটির নিকট।

পালাউ এর সমুদ্রসীমায় ২০১৮ সালে প্রবেশ করে চীনা জাহাজ জিযাং ইয়াং হং -১। পালাউ সরকার চীনের কাছে এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানানোর পর চীন সেখান থেকে তাদের জাহাজগুলো সরিয়ে নেয়। চীনা জাহাজ জিয়াং ইয়াং হং- ০১ যখন পালাউ সমুদ্র সীমায় প্রবেশ করে তখন এ অঞ্চলে চীনের আরো দুটি জাহাজ অবস্থান করে।
এ জাহাজ দুটি পরবর্তীতে পাপুয়া নিউ গিনির মানস দ্বীপের কাছে অবস্থান নেয়। পাপুয়া নিউিগিনির মানস দ্বীপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর অস্ট্রেলিয়া নৌ ঘাটি স্থাপন করছে। যার লক্ষ্য হলো অগ্রসর একটি ঘাটি হিসেবে এখন থেকে প্রশান্ত মহাসাগর ও দক্ষিন চীন সাগরে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা। অস্ট্রেলিয়া নিশ্চিত করেছে যে, উত্তরাঞ্চলের টিনডাল বিমান ঘাটি আধুনিকায়নের জন্য ১ দশমিক ১ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার খরচ করবে। এর ফলে এ বিমান ঘাটিতে মার্কিন ভারী বোমারু বিমানসহ এরিয়েল রিফূয়েলিং অয়েল ট্যাঙ্কার ওঠা নামা করতে পারবে। এ ছাড়া এফ-৩৫ জঙ্গি বিমানও মোতায়েন করা হবে এখানে।

অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন নৌ ঘাটিও আধূনিকায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যাতে এসব ঘাটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরো বেশি রণতরী অবস্থান নিতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার কোনওয়ারা এবং ডারইউনি ঘাটির নিকট বিভিন্ন স্থানে নৌবন্দর সুবিধা রয়েছে। সেগুলোও আধুনিকায়নের জন্য ৭১৫ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার বাজেট ধরা হয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে এগুলো আধুনিকায়নের কাজ শেষ হবে। এর ফলে এখানে শক্তিশালী মার্কিন রণতরী অবস্থান করতে পারবে। এসব আয়োজনের উদ্দেশ্য হলো চীনা হুমকি মোকাবেলা। এ দিকে উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় মার্কিন সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আগামী এক দশকে প্রশিক্ষন এবং অস্ত্র পরীক্ষার জন্য এ অর্থ খরচ করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে মহড়ার জন্য ২০২১ অর্থ বছরে ৩৬৪ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ চেয়েছে। এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি বৃদ্ধির কারনে এ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডিফেন্স স্ট্রাটেজিতে এ অঞ্চলে চীনকে মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদী কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি ও কর্মকান্ড আরো জোরদার করা। পেন্টাগন বিশ্লেষকদের আশঙ্কা চীন পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে ব্যাপকভাবে সামরিক কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে। আর এটি তারা করছে চীনের থার্ড আইল্যান্ড চেইন পরিকল্পনার অংশ হিসাবে। থার্ড আইল্যান্ড চেইন হলো একটি লাইন যা উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের আলেউটিয়ান দ্বীপ থেকে শুরু করে টোঙ্গা হয়ে নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত । দক্ষিন চীন সাগর এবং পূর্ব চীন সাগরের মধ্যে চীনা বানিজ্য রুটকে বলা হয় চীনের ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন । এ বানিজ্য রুট একই সাথে তাইওয়ান, জাপান এবং দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার অনেক অঞ্চলকে সংযুক্ত করেছে মধ্যপ্রাচ্যের তেল পরিবহনের জন্য।

অপর দিকে সেকেন্ড আইল্যান্ড চেইন হলো জাপানের ওগাসাওয়ারা দ্বীপ থেকে মাইক্রোনেশিয়ার মারিয়ানা আইল্যান্ড, পালাউ এবং ইন্দোনেশিয়া নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম পাপুয়া দ্বীপ পর্যন্ত একটি লাইন বা বানিজ্য রুট। চীনের এ বানিজ্য রুটের মধ্যে রয়েছে গুয়াম দ্বীপ যেখানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত সামরিক ঘাটি। এখানে অবস্থিত শক্তিশালী বিমান ঘাটি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় বিমান হামলা পরিচালনা করেছে। বিশ্লেষকদের মতে চীনের এখন দৃষ্টি, চতুর্থ এবং পঞ্চম আইল্যান্ড চেইনের নিরাপত্তার দিকে। চীন আফ্রিকার আদেন উপসাগরের দেশ জিবুতিতে স্থাপন করেছে সামরিক ঘাটি। এ ছাড়া দক্ষিন এশিয়ায় অনেকগুলো সমুদ্র বন্দর স্থাপন করেছে। এসব ঘাটি ও নৌ বন্দরের নিরাপত্তা এবং উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য চতুর্থ ও পঞ্চম বানিজ্য রুটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় চীন।

সমুদ্রে চীনের সামরিক কার্যক্রমের ম্যাপ তৈরি করেছে পেন্টাগন। এ ম্যাপে তারা দক্ষিন চীন সাগর থেকে ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি এবং উত্তর-পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বানিজ্য রুটে চীনের ব্যাপক কার্যক্রম চিহ্নিত করেছে। তা ছাড়া পেন্টাগন এ অঞ্চলে আগামী বছরের জন্য সামরিক বাজেটও পর্যালোচনা করছে। পেন্টাগনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বর্তমানে প্রায় পুরো ইন্টারনেট এবং লাখ লাখ কোটি ডলারের বানিজ্য হচ্ছে সমুদ্র তলের তারের মাধ্যমে । আর সমদ্রতলের এ ক্যাবল নেটওয়ার্ক বির্স্তীণ অঞ্চলজুড়ে অনিরাপদ।

ইন্দো-প্যাসিফিক মার্কিন কমান্ডার অ্যাডমিরাল ফিলিপ ডেভিডসন বলেছেন, ‘চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বানিজ্য প্রবাহ, অর্থনীতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাজনীতি এবং মানুষের জীবন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রন করতে চায়।’ বেইজিং বারবার বলছে তার উদ্দেশ্য পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ। চীনের দাবি পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের সায়েন্টিফিক রিসার্চ সম্পূর্ণরুপে জাতিসংঘের সমুদ্র আইন অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। আর চীন এর মাধ্যমে মেরিটাইম সায়েন্টিফিক স্টাডিতে অবদান রাখছে।