গুজবের কারখান ভারতীয় গণমাধ্যম

ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে ভারতীয় মিডিয়া - সংগৃহীত

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৬:৩৪

আপনি যদি গুগল নিউজে চায়না ক্যু লিখে সার্চ দেন, দেখবেন একের পর এক ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন চলে আসছে। এতে বলা হয়েছে, সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট জিনপিংকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থান না বলে নিউজে কিছুটা ধোয়াশা রাখা হয়েছে।
ভারতের দ্বিতীয় সারির , তৃতীয় সারির কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ড গণমাধ্যম এ খবর দিয়েছে ভাবলে ভুল হবে। হিন্দুস্তান টাইমস, ইকোনমিক টাইম, জি টিভির মত প্রভাবশালী গণমাধ্যমও প্রচার করেছে এ খবর।


তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে বিজেপিপন্থী রিপাবলিক টিভি। তারা ব্রেকিং নিউজ হিসেবে এ খবর দিয়েছে যে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গৃহবন্দী অবস্থায় আছেন। এর সপক্ষে ৮০ কিলোমিটার সেনা কনভয়ের ভিডিও ফুটেজও দেখিয়েছে বিতর্কিত চ্যানেলটি। কি অকল্পনীয় ব্যাপার ভাবুন তো!

আনন্দবাজার গোষ্ঠীর টিভি চ্যানেল এবিপি লাইভের অনলাইন সংস্করণের একটি শিরোনাম এরকম : গণহারে ফ্লাইট বাতিল চীনে, গৃহবন্দি জিনপিং! সেনা-অভ্যুত্থানের জল্পনা। খবরে বলা হয়, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কার পর ভারতের আর এক পড়শি দেশে অশান্তির আশঙ্কা। এ বার চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি উথালপাথাল হওয়ার মুখে বলে খবর উঠে আসছে। শোনা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট জিনপিংকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। চীনের সেনাবাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মি তাঁকে গৃহবন্দি করে রেখে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র।


এবিপির দাবি, এ খবর নিয়ে উত্তাল ট্যুইটারসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। এ নিয়ে বেইজিংয়ের তরফে কোনও বিবৃতি না দেওয়ায় আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। তার পর থেকেই ট্যুইটারসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে জোর চর্চা জিনপিংকে নিয়ে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের মানবাধিকার কর্মী জেনিফার জেং সর্বপ্রথম সেনা অভ্যুত্থান ঘটছে বলে দাবি করেন। সেই মর্মে ট্যুইটারে একটি ভিডিও তুলে ধরেন তিনি। তাতে রাস্তা দিয়ে সেনার কনভয় ছুটতে দেখা গিয়েছে। প্রায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ সেনার কনভয় বেইজিংয়ের রাস্তায় বলে জানান তিনি। জিনপিংকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। এমনকি সরকারের তিন কর্মকর্তাকে হত্যাও করা হয়েছে বলে দাবি তাঁর। বলা হয়েছে, জিনপিংকে ইতিমধ্যেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, শুধু ঘোষণা বাকি।

পাগলের প্রলাপের মত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, পড়শি দেশে কিছু যে ঘটছে, তার ইঙ্গিত তিন দিন আগে থেকেই মিলতে শুরু করেছিল। তাঁদের দাবি, অজ্ঞাত কারণে চীনের সর্বত্র গণহারে বিমান বাতিল হচ্ছে বলে বুধবার খবর সামনে আসে। দেশের একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম চায়না ডটকম জানায়, ২১ সেপ্টেম্বর রাত ১০টা বেজে ৩৫ মিনিট পর্যন্ত ৯ হাজার ৫৮৩টি ফ্লাইট বাতিল হয়। দেশের সর্বত্র ওইদিন ৫৬ শতাংশ ফ্লাইটই বাতিল হয় বলে জানানো হয়।

পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়, বেইজিংয়ের ক্যাপিটাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৬২২টি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। সেখানে বিমান বাতিলের হার ৬০ শতাংশ। সাংহাই পুদং বিমানবন্দর ৬৫২টি বিমান বাতিল করেছে। শেনঝেং বাওয়াং বিমানবন্দর উড়ান বাতিল করেছে ৫৪২টি বিমানের। এ ছাড়াও, দেশের পশ্চিমের গুইয়াং লংদোংবাও বিমানবন্দর ৫৩৯টি, লাহ্সা গোংগা বিমানবন্দর ১৫৭টি, চেংদু তিয়াংফু বিমানবন্দর ৭৫২টি বিমান বাতিল করে বলে জানা যায়।প্রতিবেদনে বলা হয়, এ নিয়ে দিল্লির তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া না মিললেও মোদি সরকারের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুব্রামনিয়ম স্বামী বিষয়টি নিয়ে ট্যুইট করেছেন। একটি ভিডিও পোস্ট করে চীনের পরিস্থিতি যে টালমাটাল, সেই দাবিকে সমর্থন করতে দেখা গেছে তাঁকে।


এ খবর ছড়ানোর বেশ পরেও বেজিংয়ের তরফে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি। দেশের একটি রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম শুক্রবার জানায়, করোনার বাড়-বাড়ন্তের জেরেই অনেক বিমান বাতিল করতে হয়েছে। তবে সন্দেহ দানা বাধছে সর্বত্রই। চীনের সাবেক সাংবাদিক ঝাও লানজিয়ান জানিয়েছেন, বিমান পরিবহণের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন তিনি। এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট ভাবে কিছু জানা যাচ্ছে না। আগে কখনও এমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি বলে জানান তিনি।

প্রতিবদনে বলা হয়, কূটনৈতিক মহলের একাংশ সেনা অভ্যুত্থানের জল্পনা খারিজ করে দিয়েছেন। তাঁদের দাবি, সম্প্রতি সাংহাই সম্মেলন থেকে ফিরেছেন জিনপিং। তাই নিয়ম অনুযায়ী, এই মুহূর্তে কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা তাঁর। সেই কারণেই হয়ত জনসমক্ষে সে ভাবে দেখা যাচ্ছে না তাঁকে।

ভারতীয় গণমাধ্যমে এ খবরের উৎস জানলে আপনি আরও অবাক হবেন। আসল ঘটনা হলো জার্মান নিউজ ওয়েবসাইট ডের স্পিগেলের বেইজিং সংবাদদাতা জর্জ ফাহরিয়ান মজা করে অভ্যুত্থানের টুইট করেছিলেন।


রিপাবলিক টিভি সেটা এক্সক্লুসিভ নিউজ হিসাবে চীন অভ্যুত্থান' বিষয়ক নিউজ করা করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন জর্জ ফাহরিয়ান। পরে তিনি নিশ্চিত করেছেন তিনি অভ্যুত্থান নিয়ে ঠাট্টা করছেন। সেটাকে নিউজ আকারে প্রচার করে রিপাবলিক টিভি বোকামি করেছে বলে জানান জর্জ ফাহরিয়ান।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতীয় গণমাধ্যম উগ্র জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণা দ্বারা পরিচালিত। তারা পেশাদারিত্বের চেয়ে চীন, পাকিস্তান এমনকি বাংলাদেশ বিরোধী প্রপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবেই বেশি ব্যবহৃত হয়। এরই সর্বশেষ নমুনা দেখা গেল তথাকথিত চীনা সামরিক অভ্যুত্থানে।


এমন সময় জিনপিংয়ের 'গৃহবন্দী' হওয়ার গুজব ছড়ালো যখন কিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসে তিনি তার শাসনকালের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অক্টোবরের মাঝামাঝি এ সম্মেলনে জিনপিংয়ের ক্ষমতার মেয়াদ আরও পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। এ নিয়ে দৃশ্যত কোনো অনিশ্চয়তাও নেই। তিনি হতে যাচ্ছেন আধুনিককালের চীনের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী শাসক।


তাকে গৃহবন্দী করার খবরের ৩-৪ দিন পরই জিনপিং বেইজিংয়ে একটি প্রদর্শনী পরিদর্শন করেছেন। এটা ছিল মধ্য এশিয়ায় সরকারী সফর থেকে চীনে ফিরে আসার পর তার প্রথম প্রকাশ্য উপস্থিতি। ফলে তাকে গৃহবন্দী করার গুজব ভেস্তে গেছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তাহব্যাপী সম্মেলনটি ১৬ অক্টোবর থেকে শুরু হবে। এ সম্মেলন জিনপিংয়ের গৌরব প্রদর্শনের জন্য কাজেও ব্যবহার করা হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের ক্ষমতাসীন কিমউনিস্ট পার্টি এবং সেনাবাহিনীতে জিনপিংয়ের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ৬৯ বছর বয়সী জিনপিং সম্ভবত ২০৩২ সালের ২২তম পার্টি কংগ্রেস পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন। জিনপিং চীনে প্রশাসনিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক সবকিছুর উপরই কর্তৃত্ব স্থাপন করেছেন। ফলে অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চীনা সেনা সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের অধীন। কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক জিনপিং সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের প্রধান। চীনের সেনাবাহিনী সরকার নয়, পার্টির অধীনস্থ। তাই জিনপিং সরকারকে উৎখাত করতে অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছে কূটনৈতিক মহল।
বিশ্লেষরা বলছেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশটির সামরিক বাহিনীর উপর দলীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টি খুব মনোযোগ দিয়েছে।

১৯২৭ সালেই পার্টির চেয়রম্যান মাও সেতুং বলেছিলেন, বন্দুকের নল রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস। চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ ১৯৪৯ সালে চীনের গৃহযুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর কমিউনিস্ট পার্টিকেই ক্ষমতায় এনেছিল।


মাও এবং দেং জিয়াওপিংয়ের মতো সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে আরও অনেক জুনিয়র নেতার সামরিক অভিজ্ঞতা ছিল। বিশ্বের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের তুলনায় কমিউনিস্ট পার্টির সামরিক বাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।


সেনাবাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জনের জন্য মাও সেতুংয়ের কৌশলের অংশ ছিল প্রতিটি তৃণমূল সামরিক ইউনিটে কমিউনিস্ট পার্টির সেল প্রতিষ্ঠা করা। যাতে সর্বত্র পার্টির সিদ্ধান্ত এবং আদর্শের প্রতি আনুগত্য নিশ্চিত করা যায়।


২০১২ সালে ক্ষমতায় আসার পর জিনপিং সামরিক বাহিনীতে দুর্নীতিবিরোধী ব্যাপক অভিযান শুরু করেন এবং সেনাবাহিনীর অনেক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর শক্ত ঘাঁটি ভেঙে দেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের আদলে তাকেও ২০১৬ সালে "কমান্ডার-ইন-চীফ" নাম দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চার্টার সংশোধন করে সামরিক বাহিনীকে দলের চেয়ারম্যানের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা হয়।