আরেকটি হিরোশিমা হতে পারে চীন

চীন রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের অচলাবন্থা  দ্রুত পারামানবিক যুদ্ধে ঝুকি তৈরি করছে - সংগৃহীত

  • মেহেদী হাসান
  • ২৮ আগস্ট ২০২২, ০৭:০১

 

ইউক্রেন  নয় বিশ্বে পরবর্তী হিরোশিমা হতে পারে চীনের কোন শহর। ইউক্রেন যুদ্ধের দুই বছর আগে এ আশঙ্কা করেছেন যুদ্ধ বিষয়ক খ্যাতিমান বৃটিশ সাংবাদিক জন পিলজার। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরে চীনের সাথে যুদ্ধের  প্রস্ততি নিচ্ছে এবং এ যুদ্ধ পারমানবিক হামলায় রুপ নিতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে বিশ্বে পারমানবিক যুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে আলোচনা চলছে জোরে শোরে। অনেকে বলেছেন,  রাশিয়া ইউক্রেনে পারমানবিক হামলা চালাতে পারে এবং ইউক্রেন যুদ্ধ রুপ নিতে পারে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধে। তবে ইউক্রেনের আগেই তাইওয়ান ঘিরে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঘটে যেতে পারে বড় কোন অঘটন।

অনেক বিশ্লেষকের  মতে ওয়াশিংটন পরিকল্পনা নিয়েই পেলোসিকে তাইওয়ানে পাঠিয়েছে। বৃটেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্টিফেন লাভগ্রভ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীন ও রাশিয়ার পারমানবিক যুদ্ধের ঝুকি বাড়ছে। আর এ ঝুকি রাশিয়ার তুলনায় চীনের সাথে বেশি। অনেকে মনে করেন,  তাইওয়ানে চীনের অভিযানের দিন গণনা শুরু হয়েছে ২ আগস্ট ন্যান্সি পেলোসির তাইপে সফরের মধ্য দিয়ে। চীন যে তাইওয়ানে অভিযান চালাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

জাপানে পারমানবিক বোমা হামলা চালিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র। এই হামলাকে বৈধতা দেয়ার জন্য গত ৭৫ বছর ধরে অনেক প্রচারনা চালিয়েছে  যুক্তরাষ্ট্র। হামলার ১ মাস পরে ১৯৪৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি হেড লাইন ছিল ‘নো রেডিও একটিভিটি ইন হিরোশিমা রুইন।’ হিরোশিমা ধ্বংস্তুপে কোন তেজস্ক্রিয়তা নেই।

অস্ট্রেলিয়ান-বৃটিশ সাংবাদিক জন পিলজার মনে করেন,  হিরোশিমা নিয়ে গত ৭৫ বছর ধরে সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার হল ‘যুদ্ধ বন্ধ করা এবং জীবন রক্ষায় পারমানবিক বোমা হামলা চালানো হয়েছিল’ বলে  যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ।

জন পিলজারের মতে, জাপানে পারমানবিক বোমা হামলা ছিল একটি পরিকল্পিত গণহত্যা। যুক্তরাষ্ট্র মিথ্যা দ্বারা এ যুদ্ধের বৈধতা তৈরি করেছে এবং তাদের নতুন যুদ্ধ প্রচারণার এখন নতুন লক্ষ্য চীন। এখনই সতর্ক না হলে আরেকটি হিরোশিমার ঘটনা ঘটতে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে পারমানকি বোমা হামলার পর ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপে ৬৭টি পারমানবিক বোমা পরীক্ষা চালিয়েছে। এসব পরীক্ষার সময় আশপাশের দ্বীপ থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেয়ার কোন উদ্যোগ নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। ফলে  মার্শাল আইল্যান্ডের অধিবাসীরা  হিরোশিমা নাগাসাকির মত ক্যান্সারসহ দীর্ঘ মেয়াদে বিভিন্ন ধরনের জটিল শারীরিক সমস্যার শিকার হয়েছে। এর প্রভাব চলছে এখনো।

জন পিলজারের মতে, বর্তমানে যেভাবে চীন ও রাশিয়া বিরোধী প্রচারণার জোয়ার চলছে এবং  যুদ্ধ উন্মাদনা সৃষ্টি করা হচ্ছে তাতে গোটা বিশ্ববাসী যেন  নির্বাক খরগোস। ট্রাম্প নয় ওবামা প্রশাসনের সময় থেকে শুরু হয়েছে এ অপপ্রচার।

বারাক ওবামা ২০১১ সালে অস্ট্রেলিয়ায় যান এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে  যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী নৌ উপস্থিতি ঘোষণা উপলক্ষে।  এসময় তিনি হঠাৎ করে চীনকে হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ওবামা পারমাবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বললেও বাস্তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার সময়ে এ অস্ত্রের পেছনে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।

জন পিলজারের মতে , যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান লক্ষ্য চীন। মিসাইল, বোমারু বিমান, রনতরী এবং পারমানবিক বোমসহ যুক্তরাষ্ট্রের ৪শ সামরিক ঘাটি বর্তমানে ঘিরে রেখেছে চীনকে। উত্তর অস্ট্রেলিয়া থেকে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া, জাপান,  কোরিয়া এবং ইউরেশিয়া থেকে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত যুক্তরাষ্ট্রের এ সামরিক উপস্থিতি।

 

অস্ট্রেলিয়ার প্রধান বানিজ্য অংশীদার হল চীন। কিন্তু স্কট মরিসন সরকার ঘোষণা দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। চীনের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমর প্রস্তুতি গ্রহণ করে মরিসান সরকার।  চীনকে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শত্রু আখ্যায়িত করে মরিসন সরকার শত শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মিসাইল ও অস্ত্র সংগ্রহের পেছনে। গত জুলাই মাসে অস্ট্রেলিয়ার কাছে জয়েন্ট এয়ার-টু-সারফেস স্ট্যান্ড অপ মিসাইল-একসেনডেট রেঞ্জ মিসাইল বিক্রির অনুমোদন দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর আওতা সাড়ে নয়শ কিলোমিটার।

জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক প্রসেফর আমিতাই এতজিওনি মওন করেন,  চীনের ওপর একটি অন্ধ আক্রমনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ আক্রমন এমনভাবে করা হবে যাতে চীন তাদের পারমানবিক অস্ত্র বের করে আনতে বাধ্য হয়।  হয় তাদের এটা ব্যবহার করতে হবে অথবা এসব অস্ত্র হারাতে হবে। এমন একটি অবস্থানে ঠেলে দেয়া হবে চীনকে। এভাবে শুরু হয়ে যেতে পারে পারমানবিক যুদ্ধ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়ার আয়োজন করে। এর লক্ষ্য ছিল চীনের বিরুদ্ধে হামলার প্রস্তুতি। এ মহড়ায় চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় মালাক্কা প্রণালী বন্ধের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে চীনে  জ্বালানিসহ সমস্ত আমদানি বন্ধের মহড়া চালানো হয়। এ মহড়ার অনেক কিছুই তখন গোপন রাখা হয়।

‘ইউনাইটেড স্টেটস স্ট্রাটেজিক বম্বিং সার্ভে অব ১৯৪৬’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পারমানবিক বোমা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করতে পারত। এমনকি রাশিয়া জাপানে প্রবেশ না করলেও জাপান বিনা শর্তে আত্মসর্পন করত। জাপানের ওপর এ ধরনের চাপ সৃষ্টির পূর্ণ ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র এয়ার ফোর্সের তখন ছিল।

১৯৪৫ সালের মে মাসে জাপানে পাঠানো জার্মানির একটি তার বার্তা উদ্ধার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাতে স্পষ্ট ছিল যে, জাপান একটি শান্তি চুক্তিতে পৌছতে চায়। এমনকি তারা আত্মসমর্পন করতেও প্রস্তুত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ  মন্ত্রী ছিলেন হেনরি স্টিমসন । তিনি স্বীকার করেছেন, পারমানবিক বোমা হামলা ছাড়া জাপানকে আত্মসমর্পন করার বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ বিষয়টি তখন কেউ গুরুত্বের সাথে নেয়নি। স্টিমসন আরো স্বীকার করেন পারমানবিক বোমা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র এয়ার ফোর্স জাপানকে সম্পূর্ণরুপে কাবু করতে সক্ষম ছিল।

অপর দিকে রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান বিষয়ে এখন এটি প্রকাশ হয়ে গেছে ,  ওয়াশিংটন কূটনৈতিকভাবে এ সমস্যার সামাধান হোক তা চায়নি। বরং রাশিয়াকে ইউক্রেন অভিযানের সমস্ত ধরনের উসকানির আয়োজন করেছে।  ইউক্রেনের মত ওয়াশিংটন তাইওয়ানকেও ব্যবহার করছে চীনের বিরুদ্ধে উসকানীর জন্য। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের পেছনে এখন প্রকাশ্যেই পশ্চিমাদের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করছে। আর তাইওয়ানে ন্যান্সি পেলোসির সফরের বিরুদ্ধে স্বংয় যুক্তরাষ্ট্র থেকেই প্রকাশ্য আপত্তি জানানো হয়েছে।

বৃটেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্টিফেন লাভগ্রোভ বলেছেন, চীন ও রাশিয়ার সাথে পারমানবিক যুদ্ধের ঝুকি ক্রমে বাড়ছে। দেশ দুটির সাথে পশ্চিমাদের ব্যাকডোর চ্যানেলে আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনাক্রমে ঘটে যেতে পারে পারমানবিক যুদ্ধ। স্টিফেন লাভগ্রভ অভিযোগ করেছেন পশ্চিমারা চীন ও রাশিয়ার সাথে পারমানবিক যুদ্ধ শুরুর ঝুকি তৈরি করছে।

ওয়াশিংটনে ২৭ জুলাই সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে দেয়া বক্তব্যে এ আশঙ্কা প্রকাশ করেন স্টিফেন লাভগ্রোভ।

লাভগ্রোভ বলেন, চীন রাশিয়ার সাথে পশ্চিমাদের অচলাবন্থা  দ্রুত পারামানবিক যুদ্ধে ঝুকি তৈরি করছে। স্নায়ু যুদ্ধের সময় ব্যাকডোর আলোচনার ফলে পারমানবিক যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়েছে। পারমানবিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে স্টিফেন লাভগ্রোভ চীনকে  রাশিয়ার তুলনায় বেশি ঝুকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

স্টিফেন লাভগ্রভ বলেন, চীন রাশিয়ার সাথেই যদি পশ্চিমাদের এমন অচলাবস্থা তৈরি হয় তাহলে ইরান ও  উত্তর কোরিয়ার সাথে আরো খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হবে।