সাংহাই ইস্তেহার লঙ্ঘন করেছে যুক্তরাষ্ট্র

কালো মেঘ জমছে এশিয়ার আকাশে - সংগৃহীত

  • মেহেদী হাসান
  • ১৫ আগস্ট ২০২২, ২২:২৫

ইউক্রেন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের কর্মকান্ডকে মস্কো অভিযোগ করেছিল ওয়াশিংটন রেড লাইন অতিক্রম হিসাবে। বিশ্লেষকদের মতে পেলোসির সফরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানেও রেড লাইন অতিক্রম করেছে। পেলোসির তাইপে সফর বারুদে অগ্নি স্ফুলিঙ্গের সাথে তুলনা করেছেন অনক বিশ্লেষক।  তারা মনে করেন,  জো বাইডেনের বেপরোয়া পদক্ষেপ মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাড় করাতে পারে।

বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার সাথে অঙ্গীকার ভঙ্গ করে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোকে রাশিয়ার সীমান্তে নিয়ে গেছে এবং ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছে।  তাইওয়ান বিষয়েও চীনের সাথে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ান নিয়ে ১৯৭২ সালে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা হয়। এ সমঝোতা সাংহাই ইশতেহার নামে পরিচিত।

এই ইশতেতার  অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে চীনের অংশ হিসেবে মেনে নেয় এবং তাইওয়ান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত সামরিক অবকাঠামো ও সেনা সরিয়ে নিতে রাজি হয়। এর অংশ হিসেবে ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র এক চীন নীতি মেনে নেয়। যুক্তরাষ্ট্র তখন স্পষ্ট ঘোষণা দেয়, তাইওয়ান চীনের অংশ । তাইওয়ান বিষয়ে চীনের অবস্থানকে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র এ অবস্থান থেকে সরে আসে এবং তাইওয়ানকে সামরিকভাবে চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী করতে থাকে।

বর্তমানে চীনের বিরুদ্ধে তাইওয়ানের স্বাধীনতার দাবির প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র। একই সাথে তাইওয়ানের সব ধরনের আধুনিক সমরাস্ত্রের যোগানদাতাও ওয়াশিংটন। কেবলমাত্র ওয়াশিংটনের প্রশ্রয়েই তাইওয়ান চীন থেকে আলাদা হওয়ার দাবির প্রতি অটল অবস্থানে রয়েছে।

তাইওয়ানে  ২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন । বেইজিং  সাই সরকারকে চীন বিরোধী একটি স্বাধীনতাপন্থী সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করে। সাই ওয়েন ক্ষমতায় আসার পর থেকে বেইজিংয়ের সাথে তাইপের সম্পর্ক অবনতি বাড়তে থাকে।

রিচার্ড নিক্্রন ১৯৭২ সালে চীন সফর করেন। এ সময় তার প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য নাম গোপন করে সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, পেলোসির তাইওয়ান সফর সুষ্পভাবে সাংহাই ইস্তেহারের লঙ্ঘন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট পর্যায়ের কারো তাইওয়ান সফর তাইওয়ানের স্বাধীনতার স্বীকৃতি বোঝায়। আর সংসদ স্পিকার হলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা। ন্যান্সি পেলোসির এ সফর প্রেসিডেনশিয়াল সফর হিসেবে গণ্য।  কারন কোন পরিস্থিতিতে  প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজের জন্য অযোগ্য বা অক্ষম হলে তিনি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তাইওয়ানে প্রেসিডেনশিয়াল সফর মানে রেড লাইন অতিক্রম করা।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন,  পেলোসির সফরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এখনো হয়ত রেড লাইন অতিক্রম করেনি।  তবে রেড লাইন ধরে জোরে নাড়া দিয়ছে। বাইডেন প্রশাসনের মনে কি আছে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে পরিকল্পিত হোক বা দুর্ঘটনাক্রমে হোক সামনে ভয়াবহ কিছুর  অপেক্ষা করছে বিশ্ব।

 

বিশ্লেষক নরম্যান সলোমনের মতে,  পেলোসির সফর ঘিরে উত্তেজনা কেবল অর্থনীতি আর কূটনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং তাইওয়ান ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সংঘাত মানব জাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাড়াতে পারে। আর এজন্য দায়ী হবে বাইডেন প্রশাসনের উদ্ধত আচরন।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশ কয়েক হাজার পারমানবিক বোমার অধিকারী। উভয় দেশ আদর্শিকভাবে একে অপরের দুশমন। এছাড়া চীনের নব উত্থান বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের প্রতি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। ফলে এ ধরনের শত্রু ভাবাপন্ন দুটি দেশ যুদ্ধে জড়ালে তা পারমানবিক যুদ্ধে গড়াতে পারে। 

কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিরোধের কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে তাইওয়ান। ওয়াশিংটন-বেইজিং এ দীর্ঘ বিরোধ এখন বিস্ফোরনের মুখে রয়েছে। যে কোন সময় আগুন জ্বলে উঠতে পারে।

ওয়াশিংটনে পেলোসির সফরের বিরোধীদের মতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এ সফর বাতিল করতে পারতেন। কিন্তু  তিনি তা করেননি। এ নিয়ে বাইডেন বিরোধী ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে তার ঘণিষ্ঠ মহলে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে,  জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলেভানসহ অন্যান্য উচ্চ পদস্থ অনেক নিরাপত্তা কর্মকর্তারা পেলোসির সফরের বিরুদ্ধে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্র দেশও পেলোসির তাইওয়ান সফরের বিরুদ্ধে। কারন তাদের মতে এ সফর ঘিরে ঘটতে পারে বড় অঘটন।

বাইডেন হলেন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি ১৯৭৮ সালের পর প্রথমবারের মত তার দায়িত্ব গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাইওয়ানের দূতকে আমন্ত্রন জানিয়েছেন। এভাবেই বাইডেন  তাইওয়ান নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বাঁশি বাজিয়েছেন। অনেক উদারবাদীদের মতে তাইওয়ানের মানুষ যদি স্বাধীনতা চায় তবে তা সমর্থনযোগ্য কিন্তু এজন্য  বিশ্বকে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়া যায় না। তাইওয়ানের স্বাধীনতার জন্য চীন-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ সমর্থন করা যায় না।

যুক্তরাষ্ট্রের নিই ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা, এক বছর আগেই বাইডেনকে চীন বিষয়ে বেপরোয়া হিসেবে সমালোচনা  করেছে।  ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে পেলোসির সফর নিয়ে শিরোনাম করেছে ‘পেলোসির তাইওয়ান সফর ওয়াশিংটন-বেইজিং অস্থিতিশীল সম্পর্ককে পুরোপুরি ডুৃবিয়ে দেবে।’ যুক্তরাষ্ট্র মুখে বলছে, আমরা এক চীন নীতি সমর্থন করি কিন্তু বাস্তবে তারা যা করছে সম্পূর্ণ বিপরীত।

জার্মানির গুরুত্বপূর্ণ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জার্মান মার্শাল ফান্ড এবং আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত যৌথ প্রবন্ধে  লিখেছে,  যে কোন একটি স্ফুলিঙ্গ  থেকে বড় ধরনের অগ্নিকান্ড তথা সামরিক সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। আর পেলোসির তাইওয়ান সফর ভূমিকা পালন করতে পারে এ স্ফুলিঙ্গ হিসেবে। নরম্যান সলোমনের মতে,  বাইডেন সবাইকে মেরে ফেলার আয়োজন করছেন।

তাইওয়ান ঘিরে সম্ভাব্য যুদ্ধের দিক নিয়ে  এর আগে যুক্তরাষ্ট্র আর্মি জানিয়েছে,  চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে  দুই ফ্রন্টে যুদ্ধের পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে তাদের। অনেক বিশ্লেষকের মতে,  চীন ও রাশিয়াকে দুই ফ্রন্টে আলাদাভাবে ব্যস্ত রাখতে এবং ইউক্রেনে রাশিয়াকে দুর্বল করতে যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংকে তাইওয়ান অভিযানে বাধ্য করতে পারে। কারন ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পাশে শক্তভাবে অবস্থান নিয়েছে চীন।

ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ডলার কেন্দ্রিক অর্থ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে গড়ে উঠতে যাচ্ছে নতুন বিশ্ব ও অর্থ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা নস্যাত করতে চীনকে তাইওয়ানে যুদ্ধে লিপ্ত করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। আর এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি তাইওয়ানের পক্ষে অংশ না নিয়ে ইউক্রেন নীতি অবলম্বন করতে পারে। তবে ইউক্রেন আর তাইওয়ানের ভৌগোলিক অবস্থান এক নয়। এ ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।

তাইওয়ানকে রক্ষা করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হতে পারে । তাইওয়ান ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ধ্বংস করতে পারে উদীয়মান চীনের শক্তি। ভেস্তে যাবে চীনের ট্রিলিয়ন ডলারের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ।  অনেক বিশ্লেষকের  মতে,  সব ইতিবাচক সম্ভাবনা উড়ে গিয়ে যে কোন সময়  শুরু হয়ে যেতে পারে চীন-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ।

 

চীন অনেক আগে প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাইওয়ান  চীনের সাথে যোগ না দিলে বল প্রয়োগে তাইওয়ানকে মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত করবে। তাইয়ানের স্বাধীনতা কোন অবস্থাতেই মেনে নেবে না বেইজিং।

প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বলেছেন, যারা চীনের সার্বভৌমত্বে আঘাত করবে তিনি তাদের মাথা দেয়ালে ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে দেবেন। শি জিন পিং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে একাধিকবার বলেছেন, আপনি যদি আগুন নিয়ে খেলতে চান তাহলে সে আগুনে আপনার হাত পুড়বে। তাইওয়ান ঘিরে চীনা শাসক দল কমিউনিস্ট পার্টির এ অবস্থান জানার পরও  যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি উসকানি দিয়ে চলছে ওয়াশিংটন।

 অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাইওয়ান ঘিরে যুদ্ধের বাঁশি বাজাচ্ছেন সামনের নির্বাচনের কারনে। রিপাবলিকানরা চীনের বিরুদ্ধে  কঠোর নীতির পক্ষে। রিপাবলিকানরা ডেমোক্রেটদের ব্যঙ্গ করে মেইড ইন চায়না আখ্যায়িত করে। এখন বাইডেন হয়ত নিজেকে চীনের বিরুদ্ধে দুর্বল নয় বরং  কঠোর হিসেবে প্রমান করতে চাইছেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে।