মারিউপোলের পর রাশিয়ার লক্ষ্য ওডেশা দখল

-

  • মেহেদী হাসান
  • ১১ মে ২০২২, ২৩:১৭

মারিউপোল, খারসন দখলের পর রাশিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য ওডেশা। কৃষ্ণ সাগরের তীরে অবস্থিত ওডেশা ইউক্রেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর। ঐতিহাসিক একটি নগরী। রাশিয়ার লক্ষ্য ওডেশা দখলের মাধ্যমে ইউক্রেনকে কৃষ্ণ সাগর থেকে সম্পূূর্ণ আলাদা করা। ওডেসা নিয়ন্ত্রনে রাশিয়ার পরিকল্পনার নানা দিক নিয়ে থাকছে আজকের প্রতিবেদন।


ওডেশার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত মলডোভা। মলডোভার পাশে অবস্থিত ট্রান্সনিস্ট্রিয়া দখলের ঘোষনা দিয়েছে রাশিয়া। ট্রান্সনিস্ট্রিয়ার দখলের আগে রাশিয়াকে দখল করতে হবে ওডেশা। অনেক বিশ্লেষকের মতে পুতিনের লক্ষ্য ইউক্রেনের গোটা দক্ষিন ও পূর্ব অঞ্চল দখল করা। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শেষ ধাপে রয়েছে ওডেশা অভিযান।
ইউক্রেন অভিযানের পর থেকে দুই মাস পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিরাপদ নগরী ছিল ওডেশা। কিন্তু ২৩ এপ্রিল রাশিয়ার পরপর ৬টি ক্রুজ মিসাইল হামলায় কেপে ওঠে ব্যস্ত নগরী ওডেশা। এদিন রাশিয়া বিমান হামলা চালিয়ে ধ্বংস কর সেখানে মজুদকৃত বিপুল পরিমান বিদেশী অস্ত্র। ওডেশার এয়ার ফিল্ডে মিসাইল হামলায় নিহত হয় ২শতাধিক ইউক্রেন সেনা। ইউক্রেন আর্মি দাবি করেছে রাশিয়া খারসন দখলের পর দক্ষিনের ওডেশা অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।


ওডেশা মারিউপোলের চেয়েও সমৃদ্ধ আর প্রাচীন এক নগরী। সমর বিশ্লেষকদের মতে ওডেশা দখল রাশিয়ার জন্য সহজ কাজ হবে না। কারন এখানে রয়েছে ইউক্রেনের নৌ ঘাটি। অপর দিকে কৃষ্ণ সাগরে অবস্থিত রাশিয়ার নৌ বহর। রাশিয়ান নেভির সহজ নিশানায় রয়েছে ওডেশা।
অপর দিকে পশ্চিমা অস্ত্রে বলীয়ান ইউক্রেন নেভিরও সহজ নিশানায় রয়েছে রাশিয়ান নৌ বহর। ইতোমধ্যে ইউক্রেন কৃষ্ণ সাগরে রাশিয়ার ফ্ল্যাগশিপ রণতরী মস্কোভা ডুবিয়ে দেয়ায় অনেকেই শঙ্কিত ওডেশা যুদ্ধ নিয়ে। রাশিয়া কি মারিউপোলের মত ওডেশাকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের মাধ্যমে দখলে নেবে না প্রাচীন নগরী ওডেশাকে বাচিয়ে রেখে দখলে নেয় তা এখন দেখার বিষয়।


সমর বিশ্লেষকদের মতে রাশিয়া যদি ডনবাসসহ গোটা পূর্ব ইউক্রেন এবং দক্ষিনের অন্যান্য অঞ্চল দখলে নেয়ার পর ওডেশা অভিযান চালায় সে ক্ষেত্রে ওডেশা অভিযান সহজ হতে পারে। কারন ডনবাস, খারকিভ, নিপ্রো, জাপোরিজিয়া, মেলিতোপল, মারিউপোল, খারসন দখলের পর ইউক্রেন আর্মির মনোবল ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে যেতে পারে। তবে অনেকে শঙ্কিত এ যুদ্ধে পুরো মাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়া নিয়ে। ২৮ এপ্রিল বাইডেন প্রশাসন ঘোষণা দিয়েছে তারা আগামী ৫ মাসে ইউক্রেনে ২৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সহায়তাসহ মোট ৩৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে।


ইউক্রেনের তৃতীয় বৃহৎ জনবহুল শহর ওডেসা। এর জনসংখ্যা ১০ লাখের বেশি। ওডেশা ইউক্রেনের অন্যতম একটি সমুদ্র বন্দর। এখানে রয়েছে ইউক্রেনের নৌ ঘাটি এবং ফিশিং ফ্লিট।
ওডসার অবস্থান ইউক্রেনের দক্ষিন-পশ্চিমে কৃষ্ণ সাগরের তীরে। ওডেসা বহু জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির লোকজনের বসবাস। আড়াইশ বছরের অধিক উসমানীয় সা¤্রাজ্যের অধীনে থাকায় এখানে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অনেক ইসলামী স্থাপনা এবং ইসলামিক ঐতিহ্য। ওডেশা ইউক্রেনের পার্ল অব সি বা সমুদ্রের মুক্তা নামে পরিচিত। এছাড়া এখানে রয়েছে তিন হাজার বছরের পুরনো গ্রিক অনেক নিদর্শন। ওডশাকে সিরিয়ার পালমিরার সাথেও তুলনা করা হয়।
১৫২৯ সাল থেকে ওডেসা তুরস্কের উসমানীয় সা¤্রাজ্যের অধীনে ছিল। আড়াইশ বছর পর ১৭৯২ সালে রাশিয়ান সা¤্রাজ্যের দখলে আসে ওডেশা। তারও অনেক আগে ১২৪০ সালে মুসলিম তাতার জনগোষ্ঠী এখানে পশুপালন এবং বসতি স্থাপন শুরু করে।


রাশিয়ান স¤্রাজ্ঞী ক্যাথরিন দি গ্রেটের সময় ওডেশা শহরের গোড়া পত্তন করা হয়। এর আগে শহরটি খাদজিবে দুর্গ নামে পরিচিত ছিল। এ দুর্গের পাশে ১৪ শতকের তাতারদের বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে।
১৪৮০ সালে খাদজিবে দুর্গ দখল করে তুরস্কের ওসমানীয় সা¤্রাজ্য। এরপর ১৫২৯ সালে গোটা ওডেশার দখল নেয় উসমানীয়রা। ১৭৯২ সালে রাশিয়ান ও তুর্কি সা¤্রাজ্যের যুুদ্ধে রাশিয়ানরা দখলে নেয় ওডেসার। সেই থেকে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ণের ভাঙ্গনের আগ পর্যন্ত এটি সোভিয়েত রাশিয়ার অধীনে ছিল ।


উনিশ শতকে ওডেশা পরিনত হয় রাশিয়ান সা¤্রাজ্যের চতুর্থ বৃহত্তম শহরে। মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গ এবং বর্তমান পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারস’র পরে ছিল ওডেশার অবস্থান। সোভিয়েত আমলে ওডেশা ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি নৌ বন্দর ও বানিজ্য কেন্দ্র। ওডেশায় রয়েছে শত শত বছরের পুরনো অনেক স্থপত্য ও নিদর্শন।


ওডেশায় অবস্থিত রাশিয়ার কৌশলগত তেল পাইপালাইন এবং কেমিক্যাল প্রসেসিং স্থাপনা। ওডেশার তেল পাইপ লাইন ইউরোপীয়ান নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত। ওডেশায় অবস্থিত ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ তেল শোধনাগার। এ ছাড়া মেটাল ওয়ার্ক এবং ফুড প্রসেসিংয়ের জন্যও বিখ্যাত ওডেসা। ইউরোপের সবচেয়ে বড় আউটডোর মার্কেট ওডেসায়। যা সেভেনথ-কিলোমিটার মার্কেট নামে পরিচিত। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনিয়ান সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিক এর অধীনে ওডেশা স্বতন্ত্র শহর হিসেবে বিকাশ লাভ করে।
১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুুদ্ধের শুরুতে জার্মানি এবং ইতালী আক্রমন চালায় ওডেসায়। সোভিয়েত আর্মি তাদেরকে পরাজিত করে উদ্ধার করে কৌশলগত গুরুপূর্ণ শহর ওডেসা । জার্মানি ও ইতালীর হাত থেকে ওডেসা উদ্ধারে অবদানের কারনে সোভিয়েত আর্মি, নেভি এবং ওডেসার যেসব সাধারন মানুষ যুদ্ধ করেছে তাদের ৩৮ হাজার সদস্যকে মেডেল দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৪৪ সালের ১০ এপ্রিল সোভিয়েত রেড আর্মি ওডেসা পুরোপুুরি মুক্ত করে জার্মানি ও ইতালীর দখল থেকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কারনে চারটি শহরকে হিরো সিটি আখ্যায়িত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ওডেসা তার মধ্যে একটি। অপর তিনটি শহর হল লেনিনগ্রাদ, স্টালিনগ্রাদ এবং ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপোল।


আজকের ইউক্রেন রাষ্ট্রের সীমান মূলত গড়ে ওঠে সোভিয়েত আমলে। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর রাশিয়া দখল করে ইউক্রেন। ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিকের প্রথম সদস্য হয় ইউক্রেন।
ইউক্রেনের বর্তমান পূর্ব ও গোটা দক্ষিন অংশ ভøাদিমির লেনিন ১৯২২ সালে ইউক্রেনের সাথে যুক্ত করেন । লেনিনের আমলে ইউক্রেনের সাথে যুক্ত করা এসব অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে ডনবাস রাজ্যের লুহানস্ক, ডোনেটস্ক, মারিওপোল, মেলিতোপোল, খারসন, ওডেসা ।


১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্বেভ ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের সাথে যুক্ত করেন। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালে লভিভকে ইউক্রেনের সাথে যুক্ত করেন অপর সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিন। এভাবে ইউক্রেন রাশিয়ার পরে আজকে ইউরোপের সবচেয় বড় রাষ্ট্রে পরিণত হয় । কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের সময় সোভিয়েত আমলে যুক্ত এসব এলাকা নিয়েই স্বাধীনতা লাভ করে ইউক্রেন। রাশিয়া কখনো মন থেকে মেনে নিতে পারেনি ইউক্রেনের সাথে এসব অঞ্চল আলাদা হয়ে যাওয়া।


ইউক্রেন অভিযানের শুরুতে পুতিন বলেছেন, আজকের আধুনিক ইউক্রেন মূলত সোভিয়েত রাশিয়ার অবদান। ইউক্রেনের আজকের সীমানা মূলত গঠন করেছেন ভøাদিমির লেনিন। আজকের ইউক্রেন রাষ্ট্র কখনোই এভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র ছিল না আগে থেকে।
ইউক্রেন অভিযানকে পশ্চিমারা আখ্যায়িত করে থাকেন পুতিনের ব্যক্তিগত আকাঙ্খা পূরন হিসেবে। তাদের অভিযোগ পুতিন তার ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা পূরনের লক্ষ্যে রাশিয়াকে যুদ্ধে জড়িয়েছেন। পুতিনের এ উচ্চাকাঙ্খা হল পুরনো রাশিয়ান সা¤্রাজ্যের সীমানা উদ্ধার করা। আর পুরনো এ রাশিয়ান সীমানার একটি এলাকা হল বর্তমান ইউক্রেনের গোটা দক্ষিনা ও পূর্বাঞ্চল। পুতিনের লক্ষ্য ইউক্রেনের এ অঞ্চলকে পুনরায় রাশিয়ার সাথে যুক্ত করা।


ওডেশার প্রতীক পটেমকিন স্টেয়ারস বা পটেমকিন সিড়ি। এটি সমুদ্র থেকে ওডেশা প্রবেশ দ্বার। ২০০ ধাপে নির্মিত বিশালাকায় পটেমকিন সিড়ি মিলিত হয়েছে কৃষ্ণ সাগরের নীল জলরাশির সাথে। ১৮৩৭ থেকে ১৯৪১ সালে নির্মিত হয় এ সিড়ি বা সাগর পাড়ের ঘাট। যা ইতিহাসের বহু ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে আছে ।