বাইডেন কেন ইউক্রেন সফরে যাচ্ছেন না


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৬ মে ২০২২, ০৮:০০

রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় পৃষ্টপোষক যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র তার অস্ত্র ও অর্থের ভা-ার খুলে দিয়েছে ইউক্রেনের জন্য। সারা বিশ^কে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াতেও বড় ভূমিকা রেখেছে ওয়াশিংটন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্পষ্ট করেই বলেছেন, তিনি এখনই কিয়েভ সফরে যাচ্ছেন না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বারবার তাকে সফরের অনুরোধ করলেও তাতে সাড়া দেননি বাইডেন।

গত মার্চে পোল্যান্ডে বাইডেনের সফরের সময় তার ইউক্রেন সীমান্ত অতিক্রম করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেছিল হোয়াইট হাউস। মনে করা হয়েছিল, ইউক্রেনের মাটিতে বাইডেনের পা রাখা সমর্থনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পাঠাবে রাশিয়াকে এবং সারা বিশ^কে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও টেলিফোনে বারবার বাইডেনকে বারবার কিয়েভ পরিদর্শনে উৎসাহিত করেন। তবে এক পর্যায়ে বাইডেনই তা নাকচ করে দেন।

হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা জানান, বাইডেনের ইউক্রেন সফরের জন্য দেশটিতে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির প্রয়োজন হতো। এতে সামরিক ও সিক্রেট সার্ভিস, গণমাধ্যম এবং ইউক্রেনী সংস্থার ব্যাপক তৎপরতার প্রয়োজন।
আমেরিকান রাষ্ট্রপতির সফর একটি এলাহি কা-। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে এ ধরনের আয়োজন খুব কঠিন। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার বিষয়টি আমেরিকার কাছে খুবই গুরুত্বপূূর্ণ। তাছাড়া বাইডেনের সফরকে রাশিয়া উসকানি হিসেবে নেবে। এটাও যুক্তরাষ্ট্র চায় না।

এর পরিবর্তে বাইডেন ইউক্রেন সীমান্তের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব পোল্যান্ডের একটি শহরে গিয়েছিলেন। তার ৫০ মাইল দূরেই ছিল ইউক্রেন। তিনি ইউক্রেনে যেতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন কর্মকর্তারা তাকে বোধগম্য কারণেই সীমান্ত অতিক্রম করতে দেবে না।

এর আগে সিনেটর এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বাইডেন আমেরিকান যুদ্ধ অঞ্চলগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করেছেন। এর মধ্যে গোপনে ও অন্ধকার রাত্রে অনেক ভ্রমণও করেছেন তিনি। পোল্যান্ডের একটি স্টেডিয়ামের ভিতরে সৈন্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বাইডেন বলেন, তিনি প্রায় ৪০ বার ইরাক এবং আফগানিস্তানে গিয়েছেন।

তবে ইউক্রেন পরিস্থিতির সঙ্গে ইরাক বা আফগানিস্তানের সাদৃশ্য নেই। ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ছিল। সেখানে আকাশসীমাকে সুরক্ষিত করতে সক্ষম ছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ইউক্রেন আমেরিকান যুদ্ধ অঞ্চল নয়। সেখানে তার নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেওয়া কঠিন। বাইডেন ইউক্রেনের অভ্যন্তরে মার্কিন সেনা পাঠাতে অস্বীকার করেছেন।

বাইডেন না গেলেও একের পর এক পশ্চিমা নেতা দেশটি সফরে যান । প্রথমে গিয়েছিলেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন। পরে সফরে যান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি কিয়েভের রাস্তায় হেঁটে বেড়ান।

বাইডেন সফরে না গেলেও জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক করতে প্রভাবশালী দুই মন্ত্রীকে পাঠান। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কিয়েভে বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর দুই মাসের মাথায় প্রথমবারের মত যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কোনো প্রতিনিধিদল কিয়েভ সফর করল।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে বাইডেন বিপুল কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে বাইডেন একই সঙ্গে এটাও পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন যে, আমেরিকানদের যুদ্ধে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। এমনকি ইউক্রেন থেকে মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করতেও কোনো মার্কিন সেনা পাঠানো হয়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনের ঘটনাপ্রবাহ প্রেসিডেন্ট বাইডেনের শাসনামলের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে গুরুতর সংকট। কিন্তু তিনি কোন অবস্থাতেই মার্কিন সেনাদের যুদ্ধ করতে পাঠাবেন না বলে একটা 'রেড লাইন' বা চরম সীমারেখা টেনে দিয়েছেন।

এর পেছনে একাধিক কারণও রয়েছে। প্রথমত, ইউক্রেন আমেরিকার ধারে-কাছের কোন দেশ নয়। ইউক্রেনে আমেরিকার কোনো সামরিক ঘাঁটিও নেই। ইউক্রেনের এরকম বিশাল তেলের মওজুদ নেই, যেখানে তাদের কোনো কৌশলগত স্বার্থ থাকতে পারে। ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের বড় কোনো বাণিজ্যিক অংশীদারও নয়। তবে ইউক্রেনে ছায়াযুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়াকে পরাজিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে বাইডেন প্রশাসন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা অনেক যুদ্ধে জড়িয়েছেন। সেখানে তারা অন্যদেশের পক্ষে অনেক রক্ত এবং সম্পদ ক্ষয় করেছেন। ইয়োগোশ্লাভিয়া ভেঙ্গে যাওয়ার পর যুদ্ধ শুরু হলে ১৯৯৫ সালে তাতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন। ২০১১ সালে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে একই কাজ করেছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।

১৯৯০ সালে ইরাক কুয়েত দখল করে নিলে সেখানে যুদ্ধে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে নানা কারণে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এখন আর সামরিক হস্তক্ষেপের নীতিতে বিশ্বাসী নন।

অবশ্য বাইডেন এরকম একটা অবস্থানে উপনীত হয়েছেন অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার পর। ১৯৯০ এর দশকে বলকান অঞ্চলে জাতিগত যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ তিনি সমর্থন করেছিলেন। আমেরিকার জন্য দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি নিয়ে এসেছিল ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ২০০৩ সালের সেই যুদ্ধেও তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে বেশ অনাগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

প্রেসিডেন্ট ওবামা যখন লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন। আফগানিস্তানের যুদ্ধে বিপুল সংখ্যায় মার্কিন সেনা পাঠানোর নীতির বিরুদ্ধেও তিনি অবস্থান নেন। গত বছর তিনি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সেখানে চরম বিশৃঙ্খলা এবং মানবিক বিপর্যয় দেখা দেওয়ার পরও তিনি নিজের অবস্থানের অটল ছিলেন।

বাইডেন প্রশাসনের শীর্ষ কূটনীতিক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিংকেন গত বিশ বছর ধরে জো বাইডেনের সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি প্রেসিডেন্টের খুবই ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন। বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি তার হাতেই তৈরি। ব্লিংকেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বলতে এখন বেশি গুরুত্ব দেন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, বিশ্বে রোগ-ব্যাধি-মহামারির সঙ্গে লড়াই করা এবং চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতাকে। সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে এখন ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না।

তাছাড়া আমেরিকানরাও আর যুদ্ধে যেতে চাইছে না।

সাম্প্রতিক এক জরিপে বলা হচ্ছে, ৭২ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন, রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের এই সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের কোন ভূমিকাই নেয়া উচিৎ নয়, বা নিলেও সেটা হওয়া উচিৎ খুব গৌণ।

মার্কিনিরা এখন তাদের নিজেদের পকেটের অবস্থা নিয়েই বেশি চিন্তিত। বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়েই তাদের উদ্বেগ বেশি। প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে এটাই বেশি মাথায় রাখতে হচ্ছে। কারণ সামনে দেশটিতে মধ্যবর্তী নির্বাচন।

তবে ওয়াশিংটনে কংগ্রেসের দুই দলের আইন-প্রণেতারাই এখন এই সংকট নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু পররাষ্ট্রনীতিতে কট্টরপন্থী বলে পরিচিত রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজের মত নেতারাও চান না আমেরিকা যুদ্ধ করতে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠাক বা 'পুতিনের সঙ্গে গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়–ক।'

আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী আরেকজন রিপাবলিকান সিনেটর মার্কো রুবিও একই অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিশ্বের দুটি পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধ কারও জন্যই ভালো হবে না।

প্রেসিডেন্ট বাইডেনও্য খোলাখুলি বলেছেন, ইউক্রেনে রুশ আর মার্কিন সেনারা পরস্পরের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জড়ালে একটি বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হবে। সেটা তিনি চান না।

তিনি বলেছেন, রাশিয়ার রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বড় সেনাবাহিনী। এটি খুবই কঠিন এক পরিস্থিতি এবং পরিস্থিতি কিন্তু যে কোন সময় বিপদজনক মোড় নিতে পারে।

আর ইউক্রেনের সঙ্গে আমেরিকার এমন কোন চুক্তিও নেই যে, তাদের এরকম একটা লড়াই করার ঝুঁকি নিতে হবে। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়। তাই তাদেরকে রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কোন দায় নেই।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যেসব নীতি এবং মূল্যবোধের কথা জোর গলায় বলে তা রক্ষায় যুদ্ধ করতে চায় না। তবে এখানে একটা পরিহাস আছে। ইউক্রেনকে ঘিরে এই সংঘাতের মূলে রয়েছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের একটা দাবি-ইউক্রেন যেন ন্যাটো সামরিক জোটে যোগ দিতে না পারে, সেই নিশ্চয়তা। অথচ ন্যাটো সেই নিশ্চয়তা দিতে চাইছে না।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন অবশ্য ইউরোপে মার্কিন সেনাদল পাঠিয়েছেন এবং ন্যাটো জোটভুক্ত বিভিন্ন দেশে মোতায়েন করছেন। বিশেষ করে ইউক্রেন এবং রাশিয়া সীমান্তের দেশগুলোতে এসব সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।

অন্যদিকে রাশিয়ার নিরাপত্তা ঝুঁকি ও ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড শিগগিরই ন্যাটোতে যোগ দিতে যাচ্ছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণই থেকে যাবে।