পাকিস্তান - আফগানিস্তান কী যুদ্ধের মুখোমুখি?

- সংগৃহীত

  • হায়দার সাইফ
  • ২৬ এপ্রিল ২০২২, ১৬:৫২

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। তালেবানরা কাবুলের ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পাকিস্তানের ভেতরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তান বা পাকিস্তানি তালেবান। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে তাদের সন্ত্রাসী হামলায় পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ৯৭ কর্মকর্তা ও সেনা নিহত হয়েছে। জবাবে সম্প্রতি আফগানিস্তানের ভেতরে খোস্ত ও কুনার প্রদেশে বিমান হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। এই হামলায় নারী ও শিশুসহ প্রায় অর্ধশত মানুষ নিহত হয়েছে। আফগান তালেবান সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, আবার এ ধরণের হামলা হলে পাকিস্তানকে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে। মনে হচ্ছে, আগামীতে পাকিস্তান ও আফগান তালেবানের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়বে, এবং পাকিস্তানের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ সে ক্ষেত্রে আরও জটিল আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। বিস্তারিত থাকছে হায়দার সাইফের প্রতিবেদনে।


পাকিস্তান সম্প্রতি আফগানিস্তানের ভেতরে খোস্ত ও কুনার প্রদেশে বিমান অভিযান চালিয়েছে। তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপি পাকিস্তানের ভেতরে যে হামলা চালিয়েছিল, তার জবাবে এই পাল্টা অভিযান চালায় পাকিস্তান। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী আফগান তালেবান জানিয়েছে, এই বিমান হামলায় অন্তত ৪৫ জন মারা গেছে। এদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। পাকিস্তান ও তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানের মধে সীমান্তে যে উত্তেজনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে বেড়ে গেছে, এই হামলার মধ্য দিয়ে তা আবারও ফুটে উঠলো।


টিটিপি হলো বিভিন্ন জঙ্গি গ্রুপের একটা জোট। সংবাদ মাধ্যমে এদেরকে পাকিস্তানি তালেবান নামেও উল্লেখ করা হয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এই গ্রুপটি যখন পেশোয়ারে আর্মি পাবলিক স্কুলে হামলা চালায়, তখন তারা আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসে। এবং তখন থেকেই তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
টিটিপির ওই হামলা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে বড় ধরণের অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য করেছিল। এরই অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে জার্ব-ই আজব এবং ২০১৭ সালে রাদ-উল ফাসাদ অভিযান চালিয়েছিল সামরিক বাহিনী। এই অভিযানগুলোর মাধ্যমে পাকিস্তান সাময়িকভাবে হলেও দেশের সীমানার ভেতরে জঙ্গিবাদ দমন করতে সক্ষম হয়েছিল।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টিটিপি আবার তাদের বিচ্ছিন্ন জঙ্গি গ্রুপগুলোকে জোটবদ্ধ করেছে। আফগান তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে আরও জোরালো হয়েছে টিটিপির শক্তি। টিটিপি আফগান তালেবানকে নিজেদের জন্য আদর্শ মনে করে।


মার্চের শেষ দিকে টিটিপি পাকিস্তানের ফ্রন্টিয়ার কোরের একটি আউটপোস্টে হামলা করে পাকিস্তানের ছয় সেনাকে হত্যা করে। সে সময় তারা ঘোষণা দেয় যে, তাদের বসন্তকালীন অভিযান 'অপারেশান আল-বদর' রমজানের মধ্যেও চলবে। ১১ এপ্রিল দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে টিটিপি'র সাথে লড়াইয়ের সময় পাকিস্তানের স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপের একজন মেজর ও সিপাহি নিহত হয়। ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশান্স বা আইএসপিআরের অফিস থেকে জানানো হয় যে, শুধু ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসেই পাকিস্তানের ৯৭ জন কর্মকর্তা ও সেনা নিহত হয়েছে। আইএসপিআরের ঘোষণার দিনেই আবার দুটো ঘটনায় আট সেনা নিহত হয়। এর মধ্যে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে টিটিপির হামলায় সাত সেনা নিহত হয়।


পাকিস্তানের সাথে আফগান তালেবানের সম্পর্ক এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। পাকিস্তান যখন টিটিপিকে তৎপরতা চালাতে দিতে অস্বীকার করেছে, তখন থেকে সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে। টিটিপি আফগানিস্তানকে তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে। টিটিপিকে সাধারণত আফগান তালেবান থেকে আলাদা করে দেখা হয়। তবে টিটিপি নিজেদেরকে আফগান তালেবানের শাখা মনে করে, যারা পাকিস্তানের ভেতরে তৎপরতা চালাচ্ছে।
টিটিপির নেতা নূর ওয়াই মেহসুদ আফগান তালেবানের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণাও দিয়েছেন। তাদের এই অবস্থান অবশ্য নতুন নয়। ২০১৩ সালে টিটিপির মুখপাত্র এহসানুল্লাহ এহসান ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, টিটিপি আফগান তালেবান থেকে আলাদা সংগঠন। ওই মন্তব্যের পর তাকে মুখপাত্রের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
এখন আফগান তালেবান নিজ থেকেই টিটিপিকে আশ্রয় দিচ্ছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই গ্রুপের কর্মকান্ডকে তারা বাধা দেবে, এমন কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
খোস্ত ও কুনারে বিমান হামলার পর তালেবান নেতারা আফগানিস্তানে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছিল। তালেবানের রাজনৈতিক অফিসের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাইম প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন , আবারও বিমান হামলা চালানো হলে পাকিস্তানকে খারাপ পরিণতি ভোগ করতে হবে। তালেবানদের এক নেতার সোশাল মিডিয়া একাউন্ট থেকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্রের ভাড়াটে সেনা হিসেবেও মন্তব্য করা হয়েছে।
আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধ চলাকালিন পুরো সময় পাকিস্তান আফগান তালেবানদের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। দুটো বিবেচনা থেকে এই সম্পর্ক রক্ষা করা হতো। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র এক সময় নড়বড়ে আফগান রাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে চলে যাবে এবং আর সহায়তা দেবে না। দ্বিতীয়ত, যে পাকিস্তান দীর্ঘ সময় ধরে আফগান তালেবানকে সাহায্য করেছে, তাদের উপর নিশ্চয়ই তালেবানরা চড়াও হবে না। প্রথম অনুমানটি সত্য হয়েছে, কিন্তু দ্বিতীয়টি হয়নি। আফগান তালেবান টিটিপিকে শুধু অংশীদার হিসেবেই দেখে না, তাদেরকে আদর্শিক ভাই মনে করে। কিন্তু এর বোঝাটা বইতে হচ্ছে পাকিস্তানকে।


পাকিস্তান অতীতে টিটিপির সাথে সমঝোতার যে সব চেষ্টা করেছে, সেখানে কখনই দীর্ঘমেয়াদি ফল পাওয়া যায়নি। এটা হয়তো শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা মাত্র যে, টিটিপি আবার বড় ধরণের হামলা শুরু করবে। খাইবার পাখতুনখাওয়া রাজ্যের স্থিতিশীল এলাকাগুলোতে এবং পাকিস্তানের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বড় শহরগুলোতে হয়তো তারা আবার হামলা শুরু করবে। এতদিন শুধুমাত্র আইএস-কে এবং বালুচ বিদ্রোহী গোষ্ঠিগুলোকে নিয়ে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীকে মাথা ঘামাতে হয়েছে। এখন আরও শক্তিশালী টিটিপিকে নিয়েও তাদের ভাবতে হবে। ওয়াশিংটনের অনেক পর্যবেক্ষকই সম্মিলিতভাবে টিটিপির আক্রমণ হামলাকে গুরুত্বহীনভাবে ঝেড়ে ফেলেছে। তারা মনে করে টিটিপির সমস্যা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে খুবই সামান্য বিষয়। কারণ নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে তালেবানদের সম্পর্ক রয়েছে, এবং সেই সম্পর্ক তারা কখনই ছেটে ফেলেনি।


ওয়াশিংটনের সবাই প্রায় অন্ধভাবে বিশ্বাস করে যে, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে পাকিস্তান 'ডাবল গেম' খেলেছে। অন্যদিকে, ইসলামাবাদের কর্তাব্যক্তিরা মনে করেন, ওয়াশিংটনের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের শিকার হয়েছে পাকিস্তান। পাথর আর শক্ত দেয়ালের মাঝখানে পড়ে গেছে তারা। এই দুই ধারণার মধ্যেই অসম্পূর্ণতা রয়েছে।
ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে আফগান তালেবানের বিরুদ্ধে অভিযান দ্বিগুণ জোরদার করতে বলেছিল। কিন্তু পাকিস্তান সেটা তো করেই নি, বরং তালেবানদেরকে সহায়তা দিয়েছে, সাহায্য করেছে। পাকিস্তান যদি ওয়াশিংটনের তালেবান বিরোধী যুদ্ধে পুরোপুরি সহায়তা করতো, তাহলে পরিস্থিতি কি হতো, সেটি দীর্ঘ গবেষণার বিষয়।
কিন্তু ওয়াশিংটন যে আফগান রাষ্ট্র তৈরির চেষ্টা করেছে, সেই রাষ্ট্র ও এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্বলতা নিয়ে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক বার্তা দিয়েছিল। সেগুলো বিবেচনায় নেয়নি ওয়াশিংটন।
পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সমালোচকও স্বীকার করবেন যে, আফগানিস্তানের এই সব প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে পড়ার বড় কারণ হলো আভ্যন্তরীণ সমস্যা। তাছাড়া, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কৌশলের ক্ষেত্রেও পাকিস্তা আর যুক্তরাষ্ট্র কখনও এক হতে পারেনি। বরং অনেক সময় দেখা গেছে, কৌশলের দিক থেকে পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তারা।


পাকিস্তানের সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান পারভেজ আশফাক কায়ানি যখন ওয়াশিংটনকে পূর্ব আফগানিস্তানে মনোযোগ দিতে বলেছিলেন, তখন ওয়াশিংটন ঠিক উল্টোটা করেছিল এবং দক্ষিণে মনোযোগ দিয়েছিল। অথচ পূর্ব আফগানিস্তানে পাকিস্তাান সীমান্তের কাছে তখন অস্থিরতা বিরাজ করছিল। আফগানিস্তানে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বল্প মেয়াদি অগ্রাধিকারগুলো খুব কম সময়ই একে অন্যের সঙ্গে মিলেছে। আর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য বলতে গেলে ছিলই না। তারপরও তাদের মধ্যে এক ধরনের স্থিতিবস্থা ছিলো। যুক্তরাষ্ট্র আগস্টে সেনা সরিয়ে নেয়ার পর এই স্থিতাবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে।


ওয়াশিংটন শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তা যুদ্ধের চোরাবালি থেকে নিজেকে বের করে নিতে পেরেছে। কিন্তু এই অঞ্চল সেই চোরাবালি থেকে এখনও উদ্ধার পায়নি। এই বাস্তবতার কারণেই পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র আর আফগান তালেবানকে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় সাহায্য করেছে।
বিভিন্ন পক্ষের এই জুয়া খেলার কারণেই এখন আফগানিস্তানে এক ধরণের কঠোর আদর্শের বাহক একটি গোষ্ঠি ক্ষমতায় বসেছে। পাকিস্তানের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ শেষ হওয়ার এখনও অনেক বাকি। এবং আগামীতে আফগান তালেবানের সাথে তাদের সম্পর্কের আরও অবনতিই হবে। পাকিস্তান এবং আফগান তালেবান কিভাবে আগামীতে চলার সিদ্ধান্ত নেয়, তার উপর আফগান ও পাকিস্তানিদের জীবনযাত্রা নির্ভর করছে।
পাকিস্তানের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের মধ্যে সব ধরণের স্ববিরোধীতা আর জটিলতা রয়েছে। যেগুলো আফগানিস্তানে ওয়াশিংটনের যুদ্ধের মধ্যেও ছিল। কিন্তু সমস্যাটা হলো, পাকিস্তানকে এখানে নিজের দেশের মধ্যে লড়তে হচ্ছে, যেটা যুক্তরাষ্ট্রকে কখনই করতে হয়নি।