পুতিনের পরের টার্গেট কী সুইডেন ও ফিনল্যান্ড?


  • শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
  • ১৯ এপ্রিল ২০২২, ২২:২৩

নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে বাল্টিক দেশ সুইডেন ও ফিনল্যান্ড । আবার সীমান্তবর্তী এই দুই দেশ নিয়ে নতুন সঙ্কটে পড়েছে রাশিয়া। সীমান্তে ন্যাটোর তৎপরতা রুখতে ইউক্রেন আক্রমণ করে দেশটি। কিন্তু এই আক্রমণ সুইডেন ও ফিনল্যান্ডকে ঠেলে দিয়েছে ন্যাটোর দিকে। অভিযান শুরুর পর সামরিক হিসাব-নিকাশ বদলে ফেলেছে দেশ দু’টি। সরে আসছে জোটনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে। এরা ইতোমধ্যে ঝুঁকে গেছে ন্যাটোর দিকে। ছেড়ে কথা বলছে না রাশিয়াও। টিআরটি ওয়ার্ল্ড অবলম্বনে দেখুন শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ এর প্রতিবেদন।



ইউক্রেনের মতোই রাশিয়ার সাথে সরাসরি সীমান্ত আছে ফিনল্যান্ডের। আবার সীমান্ত না থাকলেও রাশিয়ার সঙ্গে কখনো ঝামেলায় জড়ানোর ঝুঁকি নেয়নি আরেক বাল্টিক দেশ সুইডেন। তবে দুই দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ। কিন্তু রাজনীতিতে ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার বিরোধ পুরনো। এই বিরোধে কখনো প্রকাশ্যে আসেনি ফিনল্যান্ড ও সুইডেন। কিন্তু এখন দেশ দু’টি ন্যাটোতে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অথচ এ বছর জানুয়ারিতেও ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা নেই বলে জানিয়েছিলেন ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন।এক মাসের মধ্যে এই দুই দেশের মত বদলে গেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের বাস্তবতা এর পেছনে কাজ করেছে। রাশিয়ার সঙ্গে ফিনল্যান্ডের ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে ইউক্রেনেরও। যুদ্ধ শুরুর পর দেশটিকে নানাভাবে সহায়তা করেছে ন্যাটো। তবে ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত দেশ নয়। এ কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপ নিতে পারেনি ন্যাটো।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই যুদ্ধের পর ন্যাটো জোটের বাইরে থাকার সমস্যাগুলো সামনে চলে এসেছে। এ কারণে ভবিষ্যৎ রুশ হুমকি আন্দাজ করে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে এসেছে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন।বলা যায় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধই দেশ দু’টিকে পশ্চিমা জোটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এতে আরো বেড়ে গেছে রাশিয়ার নিরাপত্তা ঝুঁকি।

 

ন্যাটোতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ না দিলেও অনেক আগে থেকেই জোটটির সঙ্গে কাজ করছে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সেনাবাহিনী। আফগানিস্তানের ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন অভিযানে অংশ নিয়েছিলো দেশ দু’টি। দুই দেশই সামরিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে ২০১৫ সাল থেকে আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। বিষয়টিকে চরম হুমকি হিসেবে দেখছে রাশিয়া। এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে দেশটি। তবে রাশিয়ার হুমকিকে পরোয়া করে না বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে দেশদু’টির পক্ষ থেকে।

 

অন্যদিকে নতুন সদস্যদের বরণ করে নিতে ন্যাটোর মোড়ল দেশগুলোর আপত্তি নেই বলেও জানানো হয়েছে। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে এই জোটে টেনে নিতে পারলে রাশিয়ার সীমান্ত ছুঁয়ে যাবে ন্যাটো। তবে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বাল্টিক ছিটমহল কালিনিনগ্রাদে পারমানবিক অস্ত্র মোতায়েন করা হবে বলে সতর্ক করেছে রাশিয়া। পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিপরীতে কালিনিনগ্রাদ অঞ্চল রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, ‘এ ক্ষেত্রে বাল্টিকে পরমাণুর ভাষায় কথা বলা ছাড়া বিকল্প থাকবে না। যে কোনোভাবে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে।’

ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছিলেন, ‘ন্যাটোতে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের যোগদানের পরিণতি গুরুতর হবে। আমরা কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য হবো।’ গত দুই মাস আগেও মস্কো ও কিয়েভের দ্বন্দ্বে মধ্যম অবস্থানে ছিলো সুইডেন ও ফিনল্যান্ড।

রাশিয়ার সাথে এই দুই দেশের জটিল ইতিহাস রয়েছে। নবম শতাব্দীতে একজন সুইডিশ শাসক ‘কিভান রুশ’ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে ওই রাজ্যের উত্তরসুরিরা মস্কোভিত্তিক জার শাসন প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ১২ শতক থেকে ১৯ শতকের গোড়ার দিকে সুইডিশদের সাথে রুশদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। ১৭ শতকে মস্কোর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের বিদ্রোহ সমর্থন করেছিলো সুইডেন। তখন সুইডিশ সেনাবাহিনী মস্কোর দিকে অগ্রসর হয়েছিলো। তবে বাল্টিক এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিলো রাশিয়া।

 

পরের শতাব্দীতে সুইডিশদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে রশিয়া। ফরাসি নেতা নেপোলিয়নের আক্রমণ থেকে সুইডেনকে রক্ষা করেছিলো মস্কো। এর পর থেকে দেশদু’টির মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে উঠে। একই সময় সুইডেন ও রাশিয়ার মধ্যবর্তী দেশ ফিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ হারায় সুইডেন। ১৮১২ সালে এক সামরিক নীতি গ্রহণ করে সুইডেন। এতে ঠিক করা হয় সুইডেন কোনো দেশের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে জড়াবে না। মূলত রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ধরে রাখতেই এ নীতি নেয় দেশটি।

 

ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ই সুইডেন নিরপেক্ষতা ধরে রাখতে পেরেছিল। ১৯৯৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার পরও জোটনিরপেক্ষ হিসেবে থাকতে পেরেছে। কিন্তু রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ দেশটির পুরনো নিরপেক্ষ অবস্থানে আঘাত হেনেছে।

এখন দেশটির রাজনৈতিক নেতারা ঝুঁকে আছে ন্যাটোর দিকে। অধিকাংশ জনগণ বিশ্বাস করে ন্যাটোই কেবল পারে মস্কোর হুমকি থেকে স্টকহোমকে রক্ষা করতে।

সুইডেনের মতো ফিনল্যান্ডেরও রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্ক রয়েছে। রাশিয়ান রাজ্য কিভান রুশ গঠনে সুইডিশদের মতো ফিনিক উপজাতিদের ভূমিকা ছিলো। তবে ফিনল্যান্ডের অবস্থান সরাসরি রাশিয়ার সীমান্তে। এই ভূখন্ডটি দীর্ঘদিন রাশিয়া ও সুইডেনের মধ্যে সীমান্ত এলাকা হিসেবেই ছিলো। ৭০০ বছর সুইডেনের শাসনে থাকার পর ১৮০৯ সালে এটি রুশদের দখলে যায়।

১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লব পর্যন্ত রাশিয়ান শাসনে ছিলো। ১৯১৭ সালে দেশটি স্বাধীন হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক লড়াইয়ে মস্কোর কাছে ১০ শতাংশের বেশি সীমান্ত অঞ্চল হারিয়েছে দেশটি।

১৯৪৮ সালে ফিনল্যান্ড এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের চুক্তি করে। এতে ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কোনো সমরিক জোটে যোগ না দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো ফিনল্যান্ড। এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার জন্য অন্য কোনো দেশকে তার এলাকা ব্যবহার করতে দেবে না বলেও প্রতিশ্রুতি ছিলো দেশটির। একই ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নও ফিনল্যান্ড আক্রমণ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেয়।

লিংক-৪
এরপর থেকে ফিনল্যান্ড নিরপেক্ষ থেকেছে। পশ্চিমা ও রুশদের সাথে শক্তিশালী যোগাযোগ রেখেছে। ফিনিশ জনমতও ছিলো এই নিরপেক্ষতার পক্ষে। তবে ১৯৯১ সালের পর দেশটি ইউরোপের দিকে একটু বেশিই ঝুঁকতে থাকে। তারপরও জোটনিরপেক্ষতা টিকিয়ে রেখেছিলো ফিনল্যান্ড। কিন্তু রাশিয়ার ইউক্রেন হামলা সুইডেনের মতো ফিনল্যান্ডের হিসাব-নিকাশও বদলে দিয়েছে।

 

রুশ আক্রমণ পাল্টে দিয়েছে দেশদু’টির জনমত। এর আগে ২০ শতাংশ মানুষ ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পক্ষে ছিলো। এখন দেখা যাচ্ছে সেই হার ৬০ শতাংশে উঠে এসেছে। ফিনল্যান্ডের রাজনৈতিক দলগুলোও এখন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার পক্ষে।

ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন বলেছেন, ‘রাশিয়া থেকে সব ধরনের হুমকির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের। ন্যাটোর প্রতিরক্ষা নিশ্চয়তা ছাড়া আমাদের জন্য অন্য কোনো পথ খোলা নেই।’

ন্যাটোর অনুচ্ছেদ পাঁচে বলা আছে, যদি কোনো সদস্য দেশ আক্রমণের শিকার হয়, ন্যাটো এটিকে সবার উপর আক্রমণ বলে বিবেচনা করবে।

নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা দেশ দুটি যদি ন্যাটোতে যোগ দেয় তা হবে রাশিয়ার জন্য বড় ধরনের হুমকি। এই দেশ দুটি ন্যটোতে যোগ দিকে তা কোনো ভাবেই মেনে নেবে না। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের অন্যতম কারন ছিলো দেশটিতে ন্যাটোতে যোগ দেয়ার আকাঙ্খা। এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ন্যাটোর প্রতিশ্রুতি ছিলো রাশিয়ার সীমান্তের আর কোনো দেশকে ন্যাটোর সদস্য করা হবে না। সে প্রতিশ্রুতির লঙ্ঘন হবে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ যেনো আরো নতুন যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে।