ভারত হয়ে উঠছে হিন্দুত্ববাদি জঙ্গি রাষ্ট্র

- সংগৃহীত

  • হায়দার সাইফ
  • ১৭ এপ্রিল ২০২২, ১৮:২০

ভারতের উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে জয় পেয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতা যোগি আদিত্যনাথ। কট্টর এই হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতার জয় ভারতীয় রাজনীতির জন্য, এবং বিশেষ করে মুসলিমদের জন্য অশুভ বার্তা নিয়ে এসেছে। যোগি আদিত্যনাথ এবং বিজেপি দেখালো যে, ভারতে নির্বাচনের জন্য মুসলিমদের ভোট ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। শুধু তাই নয়, কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী মনোভাব যে ভারতের মূলধারার রাজনৈতিক আদর্শ হয়ে উঠেছে, সেটারও প্রমাণ দিলো বিজেপি। যোগি আদিত্যনাথকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পরে বিজেপির পরবর্তী কেন্দ্রীয় নেতা মনে করা হয়। বিশ্লেষকরা বলেছেন, আদিত্যনাথ কখনও ভারতের ক্ষমতায় আসলে মুসলিম বিদ্বেষের প্রশ্নে তিনি হবেন মোদির চেয়েও অনেক বেশি কঠোর। সেই মুহূর্তটি ভারতের মুসলিমদের জন্য মোটেই ইতিবাচক হবে না। টিআরটি অবলম্বনে হায়দার সাইফের প্রতিবেদনে থাকছে বিস্তাারিত।


ভারতের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগি আদিত্যনাথ কট্টর হিন্দু ধর্মগুরু। ভবিষ্যতে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ ভারত শাসন করার সম্ভাবনা তার আছে। সেখানে তার কট্টর মানসিকতার প্রকাশ ঘটবে আরও ব্যাপক পরিসরে।
ভারতের উত্তর প্রদেশে সম্প্রতি যে রাজ্য নির্বাচন শেষ হলো, সেখানে প্রায় ৯০ মিলিয়ন মানুষ অংশ নিয়েছে। সেই হিসেবে এটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাদেশিক নির্বাচন। কিন্তু নির্বাচনের আকারের দিক থেকে এটা বিশাল গণতান্ত্রিক চর্চা হলেও, নির্বাচনের ফলাফলে গভীর অশুভ ইঙ্গিত প্রকাশ পেয়েছে।

উত্তর প্রদেশের জনসংখ্যা এত বেশি যে, এই প্রদেশটি স্বাধীন হলে, সেটা হতো বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ। কর্তৃত্ববাদী, এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী রাষ্ট্র হওয়ার পথে এই নির্বাচন ছিল ভারতের আরেকটি বড় ধাপ।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতায় রয়েছে। এর বাইরে ১৭টি রাজ্যেও ক্ষমতায় রয়েছে তারা। উত্তর প্রদেশের প্রাদেশিক নির্বাচনে তারা টানা দ্বিতীয়বারের মতো জিতলো। বিগত কয়েক দশক ধরে যে ক্ষমতাসীন-বিরোধী মনোভাব এখানকার নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে, সেই প্রবণতাকে ভেঙ্গে দিয়ে রাজ্যের ক্ষমতায় টিকে থাকলো বিজেপি।

বিজেপির বিজয়ে শুধু দলের প্রতিই যে আস্থা প্রকাশ পেলো তা নয়, বরং যোগি আদিত্যনাথের প্রতিও আস্থা প্রকাশ পেলো। এই উগ্র হিন্দু ধর্মগুরু গত পাঁচ বছর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এই নির্বাচনের মাধ্যমে আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী পদে টিকে থাকলেন এবং তার জাতীয় তারকা খ্যাতি আরও বাড়ানোর সুযোগ পেলেন। অনেক বিশ্লেষকই তাকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য পরবর্তী উত্তরসূরী মনে করছেন।


মোদির অধীনে গণতন্ত্র, নাগরিক স্বাধীনতা, সেক্যুলারিজম - সবকিছুর অবনতি হয়েছে। এতে অবশ্য বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ২০০২ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে মোদির তত্ত্বাবধানে ভয়াবহ মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গা সঙ্ঘটিত হয়েছিল। অনেকেই মোদিকে একজন শক্তিশালী হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা মনে করেন। তার সমর্থকদের বিশ্বাস মোদি দেশের সেক্যুলার ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিতে পারবেন, এবং এ কারণেই তাকে তারা ভোট দিয়েছেন।


মোদি ভারতের সেক্যুলারিজমের জন্য এবং খ্রিস্টান ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের জন্য যতটা ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছেন, আদিত্যনাথ হবেন তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ। তিনি ভারতে চরম উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শ - হিন্দুত্ববাদের প্রতীক হিসেবে পরিচিত।

ক্ষমতায় আসার আগে আদিত্যনাথ একটা সহিংস, মুসলিম-বিরোধী বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন, যেটার নাম হিন্দু যুব বাহিনী। এই গ্রুপের জঙ্গিরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বহু সহিংসতায় অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যা, এবং দাঙ্গা বাঁধানোর মতো মারাত্মক সব অপরাধ রয়েছে।
মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা উসকে দেয়ার অপরাধে একবার আদিত্যনাথের কারাদন্ডও হয়েছিল। তিনি মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের ডাক দিয়েছেন, এবং মুসলিম পুরুষ কর্তৃক হিন্দু নারীদের বিয়ের প্রতিশোধ নিতে মুসলিম নারীদের অপহরণের ডাক দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালেই তিনি একটা মিথ্যা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়ান যে, মুসলিম পুরুষরা হিন্দু নারীদের লোভ দেখিয়ে তাদেরকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করছে।

ভারতে মুসলিম সংস্কৃতির যে প্রভাব রয়েছে, সেটাও মুছে ফেলতে চান আদিত্যনাথ। ভারতের বেশ কিছু শহরের মুসলিম বা ইসলামী নাম বদলে হিন্দু সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত নাম দিয়েছেন তিনি। আদিত্যনাথ এটাও দাবি করেছেন যে, ভারতের সবচেয়ে বড় পর্যটন আকর্ষণ তাজ মহলে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতিফলন নেই।
আদিত্যনাথ ভারতের নেতৃত্ব পেলে তার বিপদ দেশের সীমানার বাইরেও ছড়িয়ে পড়বে। ধর্মীয় জঙ্গি আদিত্যনাথ মধ্যযুগের বড় বড় যুদ্ধগুলোর কথা বারবার বলে থাকেন। এই যুদ্ধগুলোকে তিনি হিন্দু আর মুসলিমদের যুদ্ধ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেন।


আদিত্যনাথের মতো ব্যক্তি যদি ভবিষ্যতে ভারতকে নেতৃত্ব দেয়, তাহলে তাদের পারমানবিক অস্ত্র হুমকিতে পড়বে। বিশেষ করে নয়াদিল্লী যখন তাদের পারমানবিক নীতিকে শিথিল করে তুলছে। এমনকি প্রথম অস্ত্র ব্যবহার না করার যে নীতি তাদের ছিলো, সেখান থেকেও তারা সরে আসছে। এখন জাতীয় পর্যায়ে শেষ পর্যন্ত আদিত্যনাথের উত্থান যদি থেমেও যায়, তবু ভারতে মুসলিমদের ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার।


উত্তর প্রদেশে বিজেপি তাদের রাজনৈতিক কৌশল ঢেলে সাজিয়েছে। মুসলিম বিদ্বেষী অবস্থান এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী মনোভাব যথারীতি বজায় আছে। অর্থনীতি রক্ষায় ও কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় তাদের যে ব্যর্থতা, সেটার ক্ষতিপূরণের জন্য গরিবদেরকে মধ্যে তারা এখন নগদ অর্থ বিলি করছে।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের পাশাপাশি সাংবাদিক আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জেলে পাঠানো হচ্ছে। জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে এগুলো করা হচ্ছে, এবং মুসলিমদেরকে বিশেষ ভাবে টার্গেট করা হচ্ছে। এগুলো করে আদিত্যনাথ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপারেও একটা কঠোর ধারণা তৈরি করেছেন।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেছিলেন, অর্থনীতি এবং করোনাভাইরাস মহামারীর অব্যবস্থাপনার কারণে বিজেপির পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন হবে। কিন্তু একদিকে মুসলিম-বিদ্বেষী প্রচারণা, অন্যদিকে ভর্তুকি দিয়ে বিজেপি এমন একটা মডেল দাঁড় করিয়েছে, যেটা নির্বাচনের সময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঘাটতি ও অন্যান্য দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে দলকে সাহায্য করবে।

মুসলিম ভোটকে বিজেপি ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক করে তুলছে। দেশের মুসলিমদেরকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতাদের যে স্বপ্ন, সেটা তারা মোটেই গোপন রাখেন না। উত্তর প্রদেশে বিজেপি এটা প্রমাণ করেছে যে, মুসলিম ভোট ছাড়াই তারা জিততে পারে। শুধু তাই নয়, তারা এটাও প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে, যে সব বিরোধী দল মুসলিমদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল, তাদেরকে পরাজয় বরণ করতে হবে। ভারতে মুসলিমদের ভোটের অধিকার হয়তো এখনও আছে, কিন্তু দেশের রাজনীতিতে তারা এখন নমশূদ্র হয়ে পড়েছে।

উত্তর প্রদেশের নির্বাচনকে ভারতের জাতীয় নির্বাচনের সূচক হিসেবে দেখা হয়। এই রাজ্যে বিজেপির সুস্পষ্ট বিজয় থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য জারি থাকবে। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অবস্থান যেখান নড়বড়ে হয়ে আছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিজেপিকে হারানোর একমাত্র উপায় হতে পারে, যদি ভারতের বিরোধী দলগুলো একজোট হয়ে যৌথভাবে নির্বাচন করে।


কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদ এখন ভারতে মূলধারার রাজনৈতিক আদর্শ হয়ে গেছে। ভারত শিগগিরই এমন জায়গায় চলে যাবে, যেখান থেকে ফেরার কোন পথ থাকবে না। কারো কারো মতে, ইতোমধ্যে দেশটি সেখানে চলে গেছে । এখন দেখার বিষয়, খুব বেশি দেরি হওয়ার আগেই আমেরিকা এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো তাদের গতি বদলে ভারতের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের বিষয়ে কোন শক্ত অবস্থান নেয় কি না। ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন করলেও মার্কিন প্রশাসন ভারতের বিরুদ্ধে প্রতীকিভাবে হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

ইউএস কমিশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম সুপারিশ করেছে যাতে ভারতকে ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে 'উদ্বেগজনক দেশের' তালিকায় রাখা হয়। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর সেটা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন শক্তির দিক থেকে খ্রিস্টান ও মুসলিমরা বড় ধরণের হুমকির মধ্যে আছে। কথিত মিত্র দেশ ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জ এখন ওয়াশিংটনের সামনে। সেটা হতে পারে, ভারতকে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনকারী আখ্যা দেয়া, অথবা ভারতের ক্ষমতাসীন দলের যে সব সদস্য ধর্মীয় সহিংসতা সৃষ্টি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও দেয়া। এই সব সহিংসতার মধ্যে ২০২০ সালে তৎকালিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরকালে সঙ্ঘটিত মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গাও রয়েছে। এটা করা না হলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠির দেশ ভারত সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী স্বৈরাচারি দেশে পরিণত হবে, এবং যুক্তরাষ্ট্রকে সেটা বসে বসে দেখতে হবে।

বাইডেন প্রশাসন দাবি করে থাকে, মানবাধিকার তাদের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু ভারতের অনাচার থেকে তারা যদি মুখ ফিরিয়ে রাখে, তাহলে তাদের এই দাবি অন্তসারহীন প্রমাণিত হবে। এতে শুধু যে ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাই হুমকি পড়বে, তা নয়, বরং গণতন্ত্র আর স্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে আমেরিকার প্রহণযোগ্যতাও হুমকিতে পড়বে।