যুদ্ধে ফুরিয়ে আসছে ট্যাঙ্কের ভূমিকা

- সংগৃহীত

  • মেহেদী হাসান
  • ১৭ এপ্রিল ২০২২, ১৮:২১

নগর্ণো-কারাবাখ থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ। দুই যুদ্ধ ক্ষেত্রে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে ভারী ট্যাঙ্ক বহর। ইউক্রেন যুদ্ধের পর ভবিষ্যতে আর কোন দেশ যুদ্ধ ক্ষেত্রে ট্যাঙ্ক ব্যবহার করতে চাইবে না। নগর্ণো-কারাবাখে আর্মেনিয়ার ট্যাঙ্ক ট্রাজেডি থেকে কোন শিক্ষা নেয়নি রাশিয়া। ফলে এর চরম মূল্য দিতে হয়েছে তাদের। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের বিভিন্ন উপশহর থেকে রাশিয়ান আর্মি চলে যাওয়ার পর সামনে আসতে শুরু করেছে তাদের ট্যাঙ্কসহ বিভিন্ন মূল্যবান সামরিক যান ধ্বংসের চিত্র। ইউক্রেন আর্মির ড্রোন আর এন্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল হামলায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছে রাশিয়ার ট্যাঙ্ক আর লজিস্টিক সাপ্লাই লাইনের বিশাল বহর। ইরপিন, বুচা শহরের রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে সারি সারি ট্যাঙ্ক। ৪০ মাইল দীর্ঘ সেনা বহর নিয়েও রাশিয়ান আর্মি দখলে নিতে ব্যর্থ হয়েছে রাজধানী কিয়েভ। ব্যাপক ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে শেষ পর্যন্ত তারা বাধ্য হয়েছে ফিরে যেতে। আগামি দিনের যুদ্ধে ট্যাংক কি অকার্যকর সমরাস্ত্র হতে যাচ্ছে?


নগর্ণো-কারাবাখ এবং ইউক্রেনে যুদ্ধে ড্রোন বিমানের ব্যবহার ও ট্যাঙ্ক ধ্বংসের ট্রাজেডি ভবিষ্যতে দুনিয়াজুড়ে সমরনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। ড্রোন বিমান আর প্রযুক্তির কারনে দ্রুত বদলে যাচ্ছ সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। সামরিক শক্তিতে রাশিয়ার অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয় আর উক্রেনের অবস্থান ২২ তম। কিন্তু ভুল সমর কৌশল আর প্রচলিত অস্ত্র ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতার কারনে রাশিয়া ধরাশায়ী হল ইউক্রেনের মত দুর্বল দেশের কাছে।

কয়েক ডলারের মিসাইলের আঘাতে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ভারী ট্যাঙ্ক। তবে ইউক্রেনে পশ্চিমা অস্ত্রের বন্যা আর প্রশিক্ষন এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু সমর বিশেষজ্ঞদের মতে সঠিক সমর কৌশল আর আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে রাশিয়া মূলত হেরে গেছে ইউক্রেনের কাছে। ইউক্রেনের মত দেশের কাছে রাশিয়ার সাতজন জেনারেল নিহত হওয়ার ঘটনায় বিস্মিত সামরিক বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন ইউক্রেনকে যেসব এন্টি-এয়ারক্রাফট ও এন্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল সরবরাহ করেছে সেগুলো লক্ষ্যবস্ততে নিখুঁতভাবে আঘাত করতে সক্ষম। আর লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত আঘাত করার ক্ষমতা দ্রুত যুদ্ধের চিত্র পাল্টে দেয়। ভিডিওতে দেখা গেছে ইউক্রেন আর্মি কত সহজে কাধ থেকে মিসাইল নিক্ষেপ করে রাশিয়ান হেলিকপ্টার ধ্বংস করে দিচ্ছে। বস্তুত বর্তমানে প্রিসিশন গাইডেড মিসাইল ও বোমা যুদ্ধ ক্ষেত্রে গেম চেঞ্জারের ভূমিকা পালন করছে।

গত কয়েক বছরে মিসাইল ও বোমার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গাইডেড সিস্টেম যুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ওয়াইর- গাইডেড, ইনফ্রেয়ার্ড- গাউডেড, লেজার- গাইডেড, স্যাটেলাইট- গাইডেড মিসাইল ও বোমা।
আবার ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ান ড্রোন প্রযুক্তির কোন ব্যবহার দেখা যায়নি। ড্রোন ও গাইডেড মিসাইলে পিছিয়ে থাকলে প্রচলিত ব্যবস্থায় যত বড় শক্তিশালী আর্মিই হোক না কেন বিপর্যয় অনিবার্য।


ইউক্রেন যুদ্ধ প্রমান করেছে ড্রোন বিমান, উন্নত প্রযুক্তি আর সঠিক সমর কৌশলের কারনে সামরিক শক্তির দিক দিয়ে অনেক পেছনের দেশও দ্রুত সামনের সারিতে চলে আসতে পারে। আমূল পাল্টে দিতে পারে যুদ্ধ ক্ষেত্রের চিত্র। এজন্য বিশাল সামরিক বাজেট আর ভারী অস্ত্রের দরকার হবে না। ট্যাঙ্কের মত ব্যয়বহুল প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্র ভবিষ্যতে বোঝায় পরিণত হতে যাচ্ছে। নগর্ণো-কারাবাখ আর ইউক্রেন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা প্রমান করে ড্রোন আর উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটতে না পারলে বিশাল সামরিক শক্তির দেশও নাস্তানুবাদ হতে পারে। সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হওয়ার জন্য বিশাল সামরিক ব্যয়ের দরকার হবে না । দরকার হবে সঠিক পরিকল্পনা এবং মনুষ্যবিহীন আধুনিক প্রযুক্তির সমরাস্ত্র।


ইউক্রেনের কাছে আগে থেকেই ছিল তুরস্কের শক্তিশালী ড্রোন বিমান। এ ছাড়া সম্ভাব্য যুদ্ধ ঘিরে ইউক্রেনের কাছে যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন স্বল্প পাল্লার এন্টি-এয়ারক্রাফট ও এন্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইলসহ ক্ষুদ্রাস্ত্র পাঠাতে থাকে। এসব মিসাইল ভেহিক্যাল ও স্ট্যান্ড ছাড়াও কাধ থেকে নিক্ষেপ করা যায়। কিন্তু এসব অস্ত্রের ব্যবহারকে আমলে নেয়নি রাশিয়ান আর্মি। পুরনো স্টাইলে ৪০ মাইল দীর্ঘ সেনা বহর নিয়েও প্রবেশ করতে পারেনি রাজধানী কিয়েভে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিসহ প্রায় সব দেশের ট্যাঙ্ক ব্যাপক ধ্বংসের মুখে পড়ে। কিন্তু শত বছর পরও আজো অনেক দেশ পুরনো ব্যয়বহুল এ ভারী অস্ত্রের ধারনা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।

২০২০ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে নগর্নো কারাবাখের যুদ্ধে এভাবে রাস্তার পাশে, পাহাড়ি সমস্ত সেনা অবস্থানে আর্মেনিয়ার ট্যাঙ্ক আর সাজোয়া যান ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয়। উন্নত প্রযুক্তির শক্তিশালী ড্রোনের কাছে প্রচলিত শক্তিশালী সমরাস্ত্র ট্যাঙ্ক ছিলো অসহায়।
যে কোন যুদ্ধে প্রতিপক্ষের হামলায় ব্যয়বহুল ট্যাঙ্ক ধ্বংস হলে সহজে মনোবল ভেঙ্গে যায়। বিপুল ট্যাঙ্ক ধ্বংসের দৃশ্য জনমনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। সমর বিশ্লেষকদের মতে ভবিষ্যতে ট্যাঙ্ক যতই আধুনিক করা হোক না কেন তাতে যতই ইনকামিং হামলা প্রতিহতের ব্যবস্থা থাকুক না কেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে তা প্রতিপক্ষের উন্নত প্রযুক্তির আক্রমন থেকে রক্ষা পাবে না । অবশ্য ড্রোনসহ আর্টিফিসিয়াল সমরাস্ত্রের আক্রমন থেকে ট্যাঙ্ক রক্ষায় উন্নত প্রযুক্তির ট্যাঙ্ক উদ্ভাবন নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ করছে অনেক সংস্থা ও দেশ। কিন্তু তা কতটা সফল হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।


নগর্ণো- কারাবাখ যুদ্ধে ব্যবহৃত ড্রোন আজারবাইজান সংগ্রহ করে তুরস্কের কাছ থেকে। তুরস্কের যেসব ড্রোন নগর্ণো-কারাবাখে সবচেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক ভূমিকা পালন করেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো বাযরাক্তার টিবি২ কমব্যাট ড্রোন। বায়রাক্তার টিবি টু ৪টি মিসাইল নিয়ে ২৬ হাজার ফিট উচুতে উড়তে পারে আর টানা ২৭ ঘন্টা অপারেশন পরিচালনায় সক্ষম। অনেক উচুতে অবস্থান করতে পারায় দুর্বল প্রতিপক্ষের জন্য এটি সনাক্ত করা কঠিন।


রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেন যুদ্ধে বায়রাক্তার ড্রোন বিমানের ভূমিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রশসংসামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেন আর্মি বায়রাক্তার নিয়ে প্রচার করেছে একটি উদ্দীপনা সঙ্গীত। ইউক্রেন আর্মি দাবি করেছে তারা ড্রোন হামলার মাধ্যমে রাশিয়ার কয়েকশ সামরিক যান ধ্বংস করেছে। নগর্ণো কারাবাখের আগেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে ড্রোন। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন মিশন পরিচালনা করে আসছে।

সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন এই দুটি যুদ্ধের পর আগামী দিনে যেকোনো যুদ্ধে নতুন মাত্রা আনতে যাচ্ছে ড্রোন প্রযুক্তি। বিভিন্ন দেশ বাধ্য হবে সমরনীতি ও সমর কৌশলে পরিবর্তন আনতে । নৌ, বিমান আর স্থল বাহিনীর সাথে সমন্বিত বা অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে যাচ্ছে ড্রোন প্রযুক্তি। ড্রোন প্রযুক্তির কারনে প্রচলিত অনেক শক্তিশালী সমরাস্ত্র, বিপুল বিনিয়োগ আর প্রশিক্ষন অকেজো হয়ে যেতে পারে।
শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও অনেক দেশ ঠেকাতে পারছেনা ড্রোন হামলা। শক্তিশালী ও কম শক্তিশালী দেশের মধ্যে দ্রুত ব্যবধান কমিয়ে আনতে যাচ্ছে ড্রোন আর আধুনিক প্রযুক্তি। আগামীর যুদ্ধ ক্ষেত্রে ড্রোন আর উন্নত প্রযুক্তি সৃষ্টি করতে যাচ্ছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড।
রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের বাইরে বিভিন্ন শক্তি বা নন স্টেট গ্রুপ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে সামরিক ও বানিজ্যিক ড্রোন। নন স্টেট অ্যাক্টরের সামরিক ড্রোনের ব্যবহার ও সহজলভ্যতা বড় ধরনের উদ্বেগের কারন হয়ে দাড়িয়েছে অনেক শক্তিশালী দেশের জন্য।


পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে ড্রোন প্রযুক্তি ছাড়া সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী দেশের পক্ষেও যুদ্ধে সাফল্য লাভ অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে। কারণ প্রতিপক্ষের ড্রোন আক্রমন প্রতিহত করতে না পারলে বিপর্যয় অনিবার্য। অনেক দেশের কাছে উন্নত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বা আকাশ প্রতিরক্ষা থাকলেও ড্রোন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তা অকার্যকর। কারন এসব শক্তিশালী মিসাইল সিস্টেম অতি উচুতে এবং বড় লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। নিচ দিয়ে ওড়া ড্রোনের মত ছোট লক্ষ্যবস্তুর আক্রমন ঠেকাতে পারে না শক্তিশালী মিসাইল সিস্টেম। আবার অনেক সময় অনেক ড্রোন ধরা পড়ে না প্রতিপক্ষের রাডার ব্যবস্থায়।


সৌদি আরবে তেল ক্ষেত্রে হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয় যুক্তরাষ্ট্রের মিসাইল সিস্টেম । হুথি বিদ্রোহীরা ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর এই হামলা চালিয়েছিলো। এছাড়া সিরিয়ায় রাশিয়ার বিমান ঘাটিতে শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম থাকার পরও সেখানে ড্রোন হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে।
অনেক দেশ এখন ব্যাপক মাত্রায় বিনিয়োগ করছে কাউন্টার ড্রোন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে। ড্রোনকে এখন আর শুধুমাত্র পরিদর্শন, গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং নির্দিষ্ট হত্যা মিশন পরিচালনায় সীমাবদ্ধ রাখতে পারছে না। আর্টিলারি, ট্যাঙ্ক এবং ইনফ্যান্ট্রির সাথে ড্রোনকে সমন্বিত অংশে পরিণত করা হচ্ছে ।
কমদামী ড্রোনের সাহায্যে সামরিক বেসামরিক স্থাপনায় বড় ধরনের হামলা পরিচালনা করা যায়। ফলে সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিশ্বব্যাপী এখন চিন্তার কারন হয়ে দাড়িয়েছে ড্রোন। মাত্র একশ ডলারেও কম দামের এ ড্রোন নিয়ে চিন্তিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত সুপার পাওয়ার।

ড্রোন প্রযুক্তিতে বর্তমানে বিশ্বে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিচ্ছেন প্রচলিত অস্ত্র ব্যবস্থায় অগাধ বিনিয়োগ বন্ধ করে ড্রোন আর হাইপারসনিক মিসাইলের ওপর গুরুত্ব দিতে।