কাশ্মীর সংকটেও কাতারের মধ্যস্থতা?


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৭ নভেম্বর ২০২১, ১৭:২৬

আফগানিস্তানসহ বহু সংকট নিরসনে ‘অনেস্ট মিডিয়েটর’ বা সৎ মধ্যস্ততাকারী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছে মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ কাতার। এবার বিশ্বের অন্যতম রাজনৈতিক ও মানবিক সংকট কাশ্মীর ইস্যুতেও দোহা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তারা বলছেন, কাতারের মধ্যস্ততা মেনে নিলে ভারতও অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে। কারণ, ভারতের অর্থনীতির কৃষ্ণগহ্বর হচ্ছে কাশ্মীর।

আফগানিস্তানের পর কাশ্মীর সংকট নিরসনেও কাতার অগ্রণী ভূমিকা রাখুক, এ প্রত্যাশা এখন বহু মানুষের। কাতার ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফারহান চাকের মতে, কাশ্মীরে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়ে ভারতকে তার নীতি পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহিত করতে পারে দোহা।

কয়েক বছর আগে দোহার ওপর সৌদি জোটের অন্যায় অবরোধের পরপরই কাতারের তরুণ আমির শেখ তামিম সিবিএস টেলিভিশনের আলোচিত সিক্সটি মিনিট অনুষ্ঠানে হাজির হন। কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি জোটের অভিযোগ ছিল সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়ার। কাতারে তালেবান এবং হামাসের উপস্থিতি সম্পর্কে উপস্থাপক চার্লি রোজ জানতে চাইলে আমির স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, আমেরিকাই এটা করতে অনুরোধ করেছিল। এতে উপস্থাপকসহ সবাই কিছুক্ষণের জন্য সবাই স্তব্ধ হয়ে যান।

সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের শাসকরা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিব্রত করার সাহস দেখান না। তারা হোঁচট খাবে, অনুনয়-বিনয় করবে। এমনকি বেহায়াভাবে হাসবে। কিন্তু সঠিক কথা বলবেন না। কিন্তু শেখ তামিম দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, আফগানিস্তান ও হামাস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দোহার সমর্থন চেয়েছিল এবং কাতার ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। তার এ কথায় আমেরিকাদের ভুল ভাঙে।

কাতার সৎ মধ্যস্ততাকারী হিসেবে সবার আস্থা অর্জন করেছে। তাই তালেবানকে সৌদি আরব মধ্যস্থততার প্রস্তাব দিলেও তারা রাজি হয়নি। কিন্তু কাতারের প্রস্তাব লুফে নিয়েছে। কাতারের মধস্থতাতায় দুই দশকের রক্তাক্ত যুদ্ধের অবসান ঘটেছে আফগানিস্তানে। মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া এবং আফ্রিকার অনেক দেশের সংকটে কাতার সৎ মধ্যস্থততাকারীর ভূমিকা পালন করেছে। দোহার দূতিয়ালিতে বিবদমান পক্ষের মধ্যে বহু ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি হয়েছে।

সম্প্রতি সুদানে সংকট নিরসনে কাতার মধ্যস্থতা করেছে। লেবাননে এবং ইয়েমেনেও কাতার এ ধরনের ভূমিকা রাখছে। এবার আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে পরমাণু চুক্তি এবং সৌদি আরবের সঙ্গে ইরান ও তুরস্কের সমঝোতার জন্যও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে কাতার।

নিরপেক্ষ শান্তি স্থাপনকারী হিসেবে কাতার এর আগে লেবানন, সুদান ও ইয়েমেনে বিবদমান পক্ষকে চুক্তিতে আসতে সহায়তা করেছে। মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর দোহায় এসব পক্ষের বৈঠক আয়োজনে কাতার বিপুল অর্থ খরচ করছে। শান্তি স্থাপনকারী দেশগুলোতে কাতার অর্থ সহায়তাও দিয়েও পাশে দাঁড়াচ্ছে। কাতার দারফুরে শান্তিচুক্তি, লেবাননে গৃহযুদ্ধের অবসান ও জিবুতি-ইরিত্রিয়ার সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রেখেছে। শান্তিচুক্তির পর এসব দেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক উন্নতি ও শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে কাতার।

কাতার এখন সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় প্রতিবেশীদের খোলাখুলি পরামর্শ দিচ্ছে তারা যেন ইরানের সঙ্গে বিবাদ জিইয়ে না রেখে আপোস মীমাংসার উদ্যোগ নেয়। প্রয়োজনে সেই মীমাংসায় মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবও দিচ্ছে দোহা। সম্প্রতি লেবানন সংকট নিরসনেও কাতার উদ্যোগী হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক মেহরান কামরাভার মতে উপসাগরীয় ক্ষুদ্র এই দেশটি ক্রমে বিশ্বের অন্যতম একটি মধ্যস্থতাকারী দেশ হয়ে উঠেছে।তিনি মনে করেন, নিরপেক্ষ একটি ভাবমূর্তি কাতারের তৈরি হয়েছে। প্রচুর সম্পদ থাকায় সহজে তারা এ ধরণের সুবিধা তৈরি করে দিতে পারে। বিপুল সম্পদ থাকায় শান্তির প্রতিদান হিসাবে প্রয়োজনে আর্থিক সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেওয়াও কাতারের পক্ষে সম্ভব।

ফারহান চাকের মতে , এসব কারণে কাতারকে কাশ্মীর নিয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।

জম্মু ও কাশ্মীরের বিতর্কিত অঞ্চলটি জাতিসংঘের এজেন্ডায় দীর্ঘতম অমীমাংসিত বিরোধ রয়ে গেছে। ভূস্বার্গখ্যাত কাশ্মীরকে সবচেয়ে সামরিকায়িত স্থানে পরিণত করেছে ভারত। ৫ লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করে রেখেছে সেখানে। যাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

এই সংঘাতের সঙ্গে আফগানিস্তান, পাকিস্তান , ভারত এবং চীন জড়িত। এটি যে কোনো সময় পারমাণবিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। বিখ্যাত এনজিও জেনোসাইড ওয়াচ কাশ্মীরের জন্য দুটি ‘জেনোসাইড অ্যালার্ট’ জারি করেছে।

নিঃসন্দেহে, কাশ্মীর বিশ্বের সবচেয়ে সংঘাতময় অঞ্চলগুলির একটি। এটি আফগানিস্তানের খুব কাছে। আবার আফগানিস্তানে কাতার অনেক বিনিয়োগ করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে কাতারের নিরাপত্তা ও সামরিক সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের সঙ্গেও রয়েছে দোহার শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক। ফিলিস্তিনসহ মুসলিম বিশ্বের সংকটে কাতার যেভাবে এগিয়ে আসছে তাতে কাশ্মীরের নিপীড়িত মুসলিমরা কাতারের মধ্যস্থতা আশা করছেন।

ফারহান চাকের মতে, কাশ্মীর সংকট নিরসনের মধ্যস্থতা করার ক্ষেত্রে কাতারকে পাঁচটি বিষয় বিবেচনা করে একটি সুচিন্তিত নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এগুলো হলো ভারত-ইসরাইল জোট; ভারতের ইসলামফোবিয়া; চীনের বৈরিতায় ইন্দো-মার্কিন সখ্য, চীনের ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং কাতারের কৌশলগত অবস্থা।

ইসরাইলের সঙ্গে ভারতের দহরম মহরম ফিলিস্তিনকে সমর্থনকারী সব দেশের সঙ্গে জন্য একটি জটিল সমস্যা তৈরি করেছে। ভারতে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ ইসরাইলের মতই একই ধারায় বইছে। ঐতিহাসিকভাবে, ভারত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অন্তত লিপ সার্ভিস দিতো। সেই দিন চলে গেছে। ভারতের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর উদ্বেগজনক মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক গভীর হচ্ছে। ভারত-ইসরাইল-আমিরাত জোট কাতারের জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাতারের ভয় হচ্ছে, ভারতকে কাশ্মীরের সংকটে চাপ দিলে দেশটি আমিরাতের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে যেটা দোহার ভূরাজনৈতিক স্বার্থের অনুকুলে নয়।

২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইসলামফোবিয়া ভারতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এর চরম প্রকাশ ঘটেছে কাশ্মীরে। ভারতে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য, লাখ লাখ মুসলিমের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা, প্রকাশ্য মুসলমানদের পিটিয়ে মারা এবং কাশ্মীরের জনবিন্যাস পরিবর্তন করে সেখানে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ সবই ভারতে ইসলামোফোবিয়ার উদহারন। ফারহান চাক মনে করেন, কাতার ভারতে চলমান ইসলামোফোবিয়াকে এড়িয়ে যেতে পারে না।

কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান, তুরস্ক, চীন ও কাতারের দৃষ্টিভঙ্গী প্রায় অভিন্ন। তুরস্ক ও পাকিস্তানের পাশাপাশি চীনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে কাতারের। কাতার চীনের সঙ্গে একটি ২২ বছরের এলএনজি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গেও কাতারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। করোনভাইরাস মহামারী সত্ত্বেও গত বছর দোহা এবং নয়াদিল্লির দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল সাড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।

ফারহান চাক সতর্ক করে দিয়েছেন ভারতের সঙ্গে কাতারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত থাকতে পারে। তবে সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিপীড়ন এবং ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন অব্যাহত থাকায় দিল্লির সঙ্গে দোহার রাজনৈতিক সম্পর্ক আগামিতে খারাপ হতে পারে।

কাশ্মীর প্রায় ৭৪ বছর ধরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিবাদে সব ধরনের মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাবও মানেনি ভারত। অন্যদিকে পাকিস্তন সবসময় মধ্যস্ততাকে স্বাগত জানিয়েছে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরিদের ভাগ্য নির্ধারণের প্রস্তাব পাস করে। ভারত ও পাকিস্তান তখন এ প্রস্তাব মেনে নেয়। কিন্তু পরে ভারত বেঁকে বসে।

১৯৪৯ সালের মার্চ জাতিসংঘ ভারত ও পাকিস্তানকে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য রাজি করায় এবং দুদেশের প্রত্যাহারের পরিকল্পনা জমা দিতে বলে। পাকিস্তান পরিকল্পনা জমা দেয় কিন্তু ভারত তা প্রত্যাখান করে। তারপর ১৯৪৯ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিলে পাকিস্তান তা গ্রহণ করে। কিন্তু ভারত আবার তা প্রত্যাখ্যান করে।

১৯৫১ সালের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি প্রস্তাব দেয় যে কাশ্মীরে ভারতীয় ও পাকিস্তানি সৈন্যদের পরিবর্তে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের নিরপেক্ষ সৈন্য পাঠানো উচিত। পাকিস্তান এতে সম্মত হয় কিন্তু ভারত তা মানেনি।

১৯৫৮ সালের প্রথম দিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ড. ফ্রাঙ্ক গ্রাহামকে বিরোধের সমাধানের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যস্থতার মিশনে নিযুক্ত করে। ফ্রাঙ্ক গ্রাহাম পাঁচটি সুপারিশ করেছিলেন যার সবগুলোই পাকিস্তান গ্রহণ করেছিল কিন্তু ভারত তা প্রত্যাখ্যান করে।

এভাবে জাতিসংঘ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য বেশ কয়েকটি প্রস্তাব পাস করেছে। তবে ভারতের চরমপন্থী নীতি কাশ্মীর সংঘাতের সমাধানে মধ্যস্থতার উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার একটি বড় কারণ।

এ প্রেক্ষাপটে কাতার চাইলেও ভারত মধ্যস্থতার প্রস্তাব মানবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত এখন অনেক দুর্বল শক্তি। অর্থনীতি দিন দিনই সংকুচিত হচ্ছে। ফলে কাশ্মীরে বিপুল সামরিক ব্যয় ভারতের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে।

এদিকে পাকিস্তানের পাশাপাশি চীনের সঙ্গেও ভারতের বৈরিতা বাড়ছে। আফগানিস্তান হঠাৎ করেই ভারতের রাডারের বাইরে চলে গেছে। তাই কাশ্মীর নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এটাই কাশ্মীর নিয়ে কাতারের সামনের মধ্যস্থতার সুযোগ এনে দিতে পারে।