শতাব্দীর ব্যতিক্রমী নির্বাচনের মুখোমুখি তুরস্ক


  • হায়দার সাইফ
  • ১৩ নভেম্বর ২০২১, ১৭:১১

আধুনিক তুরস্কের শতবর্ষ পূরণ হতে যাচ্ছে। সেই সাথে এগিয়ে আসছে দেশটির পরবর্তী নির্বাচন। এটি হবে দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী নির্বাচন। সময়ের দিক থেকে শতবর্ষের সাথে মিলে গেছে ব্যতিক্রমী এই নির্বাচন। এটাকে শুধু গুরুত্বপূর্ণ বললে যথেষ্ট হবে না। কারণ, এক হিসেবে সব নির্বাচনই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এবারের নির্বাচন আগের ভোটগুলোর থেকে আলাদা।

তুরস্কের জনগণের কাছে ২০২৩ সালের একটা প্রতীকি গুরুত্ব রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, একশ বছরে তুরস্ক কতদূর পৌঁছাল। আর পরের শতকে কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। নির্বাচনের প্রচারণায় এসব ইস্যুই সামনে আসবে।

দেশের নেতৃত্ব, সরকার ব্যবস্থা- সব নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের বিতর্ক থাকবে। নতুন তুরস্কের শ্লোগান উঠবে। তুরস্কের জনগণ থেকে নিয়ে মিডিয়া- সবাই আলোচনা করবে নতুন তুরস্কের কোন ধারণাটা টিকে থাকবে। জাতীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি কুর্দিদের ইস্যু সামনে আসবে। পশ্চিমের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক কী হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুরস্কের অবস্থান কোথায় থাকবে- এই সবই থাকবে আলোচনায়।

দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকবে। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের প্রতিপক্ষ আশা করবে, তার ২০ বছরের শাসনের ইতি ঘটুক। অন্যদিকে, পিপলস অ্যালায়েন্স চাইবে তুরস্কের বৈশ্বিক আর আঞ্চলিক উচ্চাকাক্সক্ষা বজায় থাকুক। স্বাভাবিকভাবেই দুই পক্ষের মধ্যে একটা উত্তেজনা থাকবে।

গত দুই দশক ধরে ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা একে পার্টি তুরস্কের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে। নির্বাচনে জেতাটা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলোর প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে একে পার্টিকে যেভাবেই হোক ক্ষমতা থেকে সরানো।

এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রাজনৈতিক জোট করার চেষ্টা করেছে প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি বা সিএইচপি। এদিকে, একে পার্টি আর ন্যাশনাটিস্ট মুভমেন্ট পার্টি বা এমএইচপি-র মধ্যে আগে থেকেই জোট রয়েছে।

বিরোধী জোট করা হলে সেখানে নেতৃত্ব কে দেবে, এটা নিয়ে সমস্যায় আছে সিএইচপি। কারণ দলগুলোর রাজনৈতিক মানসিকতা ঠিক এক নয়। ধর্ম আর তুরস্কের অটোম্যান ঐতিহ্যের ব্যাপারে নাক সিটকানো মনোভাব রয়েছে সিএইচপি-র। পশ্চিমা মূল্যবোধের যে প্রাচীন ও সেকেলে ধারণা তারা পোষণ করে, সেটার কারণেই তাদের এই মনোভাব।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইস্যুগত ভিন্নতা, পরস্পরকে চ্যালেঞ্জ করার মানসিকতা থেকে যাতে চরম মেরুকরণ না হয়, রাজনৈতিক নেতাদেরকে সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে। যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সংবেদনশীলতা বুঝতে হবে। তবে, তুরস্কের জনগণ যে একটা চরম প্রতিযোগিতার নির্বাচন দেখতে যাচ্ছে, তার বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

আগাম নির্বাচন আর পেসিডেন্ট প্রার্থী নিয়ে বিতর্কটা ২০১৯ সালে শুরু হয়েছে। বিরোধী পক্ষ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড আর যুদ্ধপ্রিয় মনোভাবের অভিযোগ তুলেছে। এরদোয়ানের বিরুদ্ধে বিরোধী ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের বেশির ভাগ সদস্য কড়া বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতির ভাষা যথেষ্ট কঠোর।

কিছু বিশ্লেষক অবশ্য বলছেন, নতুন নীতি গ্রহণে ব্যর্থতার জন্য সিএইচপির নির্বাচনী কৌশল ব্যর্থ হবে। সিএইচপির প্রধান এর আগে যে সব পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেখানে বিরোধী দলের মানসিকতাটা বোঝা গেছে। তুরস্কের আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধেও সরকারকে অবৈধভাবে সহায়তা করার অভিযোগ তুলেছেন তিনি।

সিএইচপির সামনে অবশ্য বেশ কিছু বড় ধরণের সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, প্রান্তিক বামপন্থী গ্রুপগুলো আগের চেয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। সিএইচপির নীতি নির্ধারণে তাদের ভূমিকা বাড়ছে। সিএইচপি প্রধানের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে। সে কারণে দলটির ইস্তান্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলু নিজেকে দলের পরবর্তী প্রধান ও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ঘোষণা করেছেন।

সিএইচপির জোট গঠনের ঝক্কিটা তো আছেই। তারা গুড পার্টি বা আইপি, ফেলিসিটি পার্টি বা এসপি, এবং পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বা এইচডিপির সাথে জোট করার চেষ্টা করছে। আইপি নিজেকে তুর্কি জাতীয়তাবাদী দাবি করে। তবু তারা কুর্দি জাতীয়তাবাদী এইচডিপির সাথে জুটেছে। অন্যদিকে, সিএইচপির নেতারা এসপির সাথে ভিড়ে তাদের ধর্মবিদ্বেষী চেহারা ঢাকতে চাচ্ছে।

অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাইরে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তুরস্কের অবস্থানটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। প্রথমে দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে সিএইচপি-র। অন্যদের উপরও এর প্রভাব পড়তে পারে। সেখান থেকেই জাতীয় অস্তিত্বের ইস্যুটি উঠে এসেছে। পশ্চিমারাও তুরস্কের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ইস্যুতে নাক গলানোর চেষ্টা করেছে। ভবিষ্যৎ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সেটা আরো বাড়তে পারে।

সম্প্রতি ১০টি দেশের রাষ্ট্রদূতরা একটি বিচারাধীন ইস্যুতে বিবৃতি দিয়ে বিতর্ক উসকে দিয়েছিলেন। একইভাবে, তুরস্কও বাইরের চাপের মুখে পড়তে পারে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বৈঠক থেকে সহযোগিতার উপায় কতটা ফলপ্রসূ হয় তা দেখার বিষয়। দুই দেশের সম্পর্ক মেরামত না হলে জটিলতা আরো বাড়বে। এফ-১৬ বিমানের বিষয়ে একটা সমাধানে আসতে হবে। যদি তা না হয়, তাহলে গণতন্ত্র আর মানবাধিকার ইস্যুতে তুরস্ককে চাপ দেবে মার্কিন কংগ্রেস।

নভেম্বরের শেষের দিকে কাউন্সিল অব ইউরোপের সাথে তুরস্কের সমস্যা হতে পারে। কারণ ফরাসী প্রেসিডেন্ট এম্যানুয়েল ম্যাক্রো এরই মধ্যে তুরস্কের বিরুদ্ধে লেগেছেন। এরদোয়ানের পুননির্বাচন নিয়েও মন্তব্য করেছেন তিনি। এই বিরোধীতার মাত্রাটা দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে।

গ্রিসও ম্যাক্রোকে দেখে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তুরস্কের সাথে তাদের সমস্যাটা নতুন করে চাঙ্গা হবে। সবশেষে সিরিয়ার ইদলিবে ওয়াইপিজিকে ঘিরে নতুন করে সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। ওয়াইপিজি পিকেকে-র পক্ষে সেখানে তৎপর রয়েছে।

আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে তুরস্ককে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। সিরিয়ায় শরনার্থীদের বোঝা নিয়েও একটা নিরাপদ এলাকা গড়ে তুলেছেন। কুর্দি বিরোধীদের বেশ কোনঠাসা করেছেন। লিবিয়া ও আজারবাইজানে সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাথে সর্ম্পক ঝুকিতে পড়েছে। একই সাথে তুরস্কের অর্থনীতি স্বস্তিতে নেই। এ নিয়ে সাধারন মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে। আগামি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলকে এগুলো সামাল দিতে হবে।

তুরস্কের রাজনৈতিক নেতাদের এসব ঝুঁকি মোকাবেলা করা সহজ নয়। এটা সত্য যে, তুরস্ক প্রজাতন্ত্র রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিকভাবে অনেক পরিপক্ক হয়েছে। এই সব ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য গত একশ বছরে তারা অনেক এগিয়েছে। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, ২০২৩ এর নির্বাচন হতে যাচ্ছে ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী প্রেক্ষাপটে।

তুর্কি জাতির ভবিষ্যতের জন্য আগামি নির্বাচন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তুরস্কের শক্তিকে সুসংহত করতে হলে আগামীর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে। কথার ফুলঝুরি না এনে, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য বিকল্প ভিশন নিয়ে আসলে সেটা তুরস্কের গণতন্ত্রের জন্য ভালো হবে। এর পরও প্রতিযোগিতাটা যে তীব্র হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর যিনি এই নির্বাচনে জিতবেন, তার হাতেই আগামী শতকের পথচলা শুরু হবে।

সিএইচপি দলের প্রধান কেমাল কিসিচদারোগলু আর গুড পার্টি বা আইপি-র নেতা মেরাল আকসেনেরের মধ্যে এখন একটা দ্বন্দ্ব লেগে আছে। সেটা হলো বিরোধী দলের পক্ষ থেকে তারা যৌথ প্রেসিডেন্সিয়াল প্রচারে নামবেন কি না। সিএইচপি চেয়ারপার্সন তার দলকে এইচডিপি দলের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন। এর মাধ্যমে আন্দোলনকে তিনি নিজের পক্ষে রাখতে চান। আর রিপাবলিকান মেয়র প্রার্থীদের প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে তিনি বিরত রাখতে চান। অন্যদিকে আকসেনের এইচডিপি দল থেকে দূরত্ব বজায় রাখছেন।

তিনি সমর্থন দিচ্ছেন ইস্তান্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলুকে। তার ব্যাপারে এইচডিপি-র ভোটারদের আবার সমবেদনা রয়েছে। ভবিষ্যতে পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তনের সাথে সাথে এইচডিপি আরও কট্টর হয়ে উঠতে পারে। আর এইচডিপি-র অবস্থা দিয়েই নির্ধারিত হবে, কিলিচদারোগলু আর আকসেনেরের বিবাদের সুরাহা কিভাবে হবে।

প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী পদ্ধতির কথা বলে সমালোচনার মুখে পড়েছেন আকসেনের। তবে সম্প্রতি তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বলতে তিনি নির্বাহী ক্ষমতাসম্পন্ন ভাইস-প্রেসিডেন্টের পদকে বুঝিয়েছেন।

তুরস্কের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে ২০২৩ সালে। কিন্তু নির্বাচনকে ঘিরে অদ্ভুত রাজনৈতিক সমীকরণ জন্ম নিচ্ছে। এর সাথে যোগ হচ্ছে আর্ন্তজাতিক মহলের নানা ধরনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা।