আরববিশ্বে ইসলামি রাজনীতির অবসান ঘটছে, এরপর কী?


  • মোতালেব জামালী
  • ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:০৮

আরববিশ্বে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্দিন চলছে। মিসরের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট ও মুসলিম ব্রাদারহুড (এমবি) নেতা মোহাম্মদ মুরসির ক্ষমতাচ্যুতি ও জেলখানায় করুণ মৃত্যুর পর দেশটিতে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। ব্রাদারহুডের নেতাকর্মীরা কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। বিভিন্ন সময়ে আলজেরিয়া, সুদান ও ইরাকে গড়ে ওঠা ইসলামি আন্দোলনও কোনো সুবিধা করতে পারেনি। তিউনিসিয়ায় ইসলামপন্থী আন-নাহদা পার্টির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর দলটি প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন করতে পারেনি। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট সাইদের গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি নানাভাবে সমর্থন জানিয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর।

মরক্কোর ঘটনা অবশ্য ভিন্ন ধরনের। সাম্প্রতিক সময়ে আরববিশ্বের যেসব দেশে পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছে, মরক্কো তার মধ্যে একটি। গত ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে দেশটির ক্ষমতাসীন মধ্যপন্থী ইসলামি দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি পিজেডি-র শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। দলটি আসন পেয়েছে মাত্র ১২টি। অথচ ২০১৬ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে পিজেডি ১২৫টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করেছিল। ৫ বছরের ব্যবধানে দলটি আসন হারিয়েছে ১১৩টি।

অথচ, পরপর তিনটি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল পিজেডি। কিন্তু এবার আসন পাওয়ার দিক থেকে দলটির অবস্থান ৮ নম্বরে নেমে গেছে। পিজেডি-র প্রধান ও সদ্যসাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ উদ্দিন ওসমানী রাজধানী রাবাতে নিজের আসনে এবার জিততে পারেননি। পিজেডি-র প্রতিদ্বন্দ্বী দল ন্যাশনাল র‌্যালি অব ইন্ডিপেন্ডেন্টস (আরএনআই) ১০২টি আসন পেয়ে নতুন সরকার গঠন করেছে। এবার দলটির আসন বেড়েছে ৬৫টি।

তিউনিসিয়ায় ইসলামপন্থী দল আন-নাহদা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রায় দুই মাসের মাথায় মরক্কোর নির্বাচনে শোচনীয় অবস্থা হলো দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা ইসলামি দলটির। এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের ইসলামি দল ও সংগঠনের এমন অবস্থা আরববিশ্বে রাজনৈতিক ইসলামের অবসানেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। তারা বলছেন, আরববিশ্বে রাজতন্ত্র ও স্বৈরশাসকদের অবস্থানই আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

আরবিভাষী দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ আলজেরিয়ায় স্বাধীনতা লাভের পর থেকে পরবর্তী ৬৭ বছর সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত একদলীয় শাসন চলেছে। ইসলামি স্যালভেশন ফ্রন্টের ব্যানারে ইসলামপন্থীরা দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। সেনাবাহিনী ও তাদের সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনী এফএলএন-এর বিরুদ্ধে তারা সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। সংগঠনের নেতাকর্মীরা সরকারের সাধারণ ক্ষমার আওতায় অস্ত্র ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। ২০১১ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্তের ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ আন্দোলনের পর বয়োবৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট আব্দুল আজিজ বুতেফ্লিকাকে ২০১৯ সালের এপ্রিলে ক্ষমতা থেকে সরানো সম্ভব হয়েছে। দেশটিতে ইসলামী রাজনীতির প্রভাব এখন তেমন নেই বললেই চলে।

সুদানেও ইসলামি রাজনীতির করুণ দশা হয়েছে। দীর্ঘ ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন জেনারেল ওমর আল বশির। তিনি ইসলামি চিন্তা-চেতনার কথা বলতেন। ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্টের দাবি মেনে দেশে শরিয়া আইনও জারি করেছিলেন। কিন্তু এর ফল হয় খারাপ। খ্রিস্টান অধ্যুষিত দক্ষিণ সুদান আলাদা হয়ে যায়। আরব বসন্তের প্রভাবে শুরু হওয়া বিক্ষোভে বশির ক্ষমতাচ্যুত ও কারাবন্দি হন।

২০১১ সালে ‘আরব স্প্রিং’ বা আরব বসন্ত নামের যে আন্দোলন এই অঞ্চলের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার সূচনা হয়েছিল তিউনিসিয়া থেকেই। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোতে রাজা-বাদশাহ, আমির ও একনায়কদের দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বেকারত্ব, দুর্নীতি, গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অভাব, নির্যাতন-নিপীড়ন ও কঠোর কালা-কানুনের বেড়াজালে বন্দি হয়ে থাকা মানুষ আরব বসন্তের প্রভাবে নেমে এসেছিল রাজপথে। বিক্ষোভকারীদের টানা আন্দোলনে মিসরে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতন ঘটে। লিবিয়ার একনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন।

এই আন্দোলনের পথ ধরেই মিসর ও তিউনিশিয়ায় প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে দুটি ইসলামপন্থী দল। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড ও তিউনিসিয়ায় আন-নাহদা পার্টি সরকার গঠন করে। কিন্তু শাসক দলের নানা ভুল ও এই অঞ্চলের রাজতন্ত্রী শাসকদের ষড়যন্ত্রের কারণে দুটি দলের কোনোটিই বেশি দিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি।

ইসলামি দলগুলো একেবারে পারফেক্ট বা তাদের কোনো ভুল-ত্রুটি নেই, তা অবশ্য বলা যাবে না। আরববিশ্বের অন্যান্য দলের চেয়ে ইসলামি দলগুলো অধিকতর সুসংগঠিত হলেও তাদের নানা সীমাবদ্ধতা আছে। সরকারি দমন-পীড়নের কারণে এসব দল দীর্ঘদিন আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে ইসলামি দলগুলোর নানা ভুলত্রুটি হয়েছে। অনেক সময় কারও সঠিক পরামর্শও দলগুলো গ্রহণ করেনি। আবার এসব দলের নেতারা ভুরাজনৈতিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতির বাস্তবতাকেও অনেক সময় বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ঘটে গেছে মারাত্মক ভুল। যার মাসুল দিতে হয়েছে অনেক বেশি।

মিসরে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ২০১৩ সালে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি করেন তারই সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাপ্রধান আবদেল ফাতাহ আল সিসি। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত দ্রুতই সিসির প্রতি সমর্থন জানায়। বিচারের নামে প্রহসন চলা অবস্থায়ই মুরসি ২০১৯ সালে মারা যান। তার দল মুসলিম ব্রাদারহুডকে আইনের নানা বেড়াজালে ফেলে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত আদালতগুলো মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাকর্মীদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা অব্যাহত রেখেছে।

তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদ ইসলামপন্থী আন-নাহদা পার্টির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত ও নির্বাচিত পার্লামেন্ট বাতিল করার পর সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসরের সরকার নিয়ন্ত্রিত ও সমর্থিত মিডিয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। এসব মিডিয়ায় মন্তব্য করা হয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট সাইদের গৃহীত পদক্ষেপে আন-নাহদার বিরুদ্ধে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে, জনগণের বিজয় হয়েছে।

সৌদি আরবের আধাসরকারি পত্রিকা ওকাজ তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে- ‘ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে তিউনিসিয়া’। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংবাদ মাধ্যম ২৪ মিডিয়া তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে এভাবে- ‘তিউনিসিয়াকে রক্ষায় একটি সাহসী পদক্ষেপ’। মিসরের পত্রিকা আল আহরাম লিখেছে- ‘ব্রাদারহুড এই অঞ্চলে তার সর্বশেষ শক্ত ঘাঁটিও হারাল’।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মিডিয়ার এ ধরনের বক্তব্য ও আচরণ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, এই অঞ্চলে ইসলামি রাজনীতির প্রতি মানুষের সমর্থন কমানো ও এর অবসান ঘটানোর অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে আসছে স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলো। মিসরের পর তিউনিসিয়ায় তারা সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে। মিসরের নিরপেক্ষ মিডিয়া হিসেবে পরিচিত মাদা মাসর দেশটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সরকারি কর্মকর্তার উদ্বৃতি দিয়ে তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, মিসর এটা বিশ্বাস করে যে, আন-নাহদার রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর লক্ষ্যেই প্রেসিডেন্ট সাইদ এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তিউনিসিয়ায় আন-নাহদা সরকারের পতনকে তাদের পররাষ্ট্রনীতির বিজয় হিসেবে দেখছে।

পশ্চিমাবিশ্ব গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পক্ষে কথা বললেও তারা সব সময়ই আরববিশ্বের রাজা-বাদশাহ ও স্বৈরশাসকদের পাশে থাকে। তিউনিসিয়ায় আন-নাহদার নেতৃত্বাধীন সরকারকে বেআইনিভাবে বরখাস্ত ও পার্লামেন্ট বাতিল করা হলেও পশ্চিমা বিশ্ব এর নিন্দা জানায়নি বা সমালোচনা করেনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান এই পরিস্থিতি ও প্রবণতা দুটো বিষয়কে সামনে নিয়ে আসছে। প্রথমত, আরব বসন্তের মাধ্যমে এই অঞ্চলের ইসলামি দলগুলো নিঃশ্বাস ফেলার ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার যে সুযোগ পেয়েছিল, তার অবসান ঘটছে। মরক্কোর নির্বাচনে মধ্যপন্থী ইসলামি দল জেডিপি-র শোচনীয় পরাজয় আরববিশ্বে ইসলামপন্থী দলের ক্ষমতায় থাকার সর্বশেষ উদারহরণটিও মুছে দিল।

দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করা আরব স্বৈরশাসকরা ইসলামি রাজনীতির গলা টিপে ধরতে সর্বদা তৎপর রয়েছে। যুগ যুগ ধরে তাদের স্বৈরশাসন, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাত ও অপব্যবহারসহ নানা অপরাধ অব্যাহত রাখতে তারা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছে। স্বার্থান্বেষী বিদেশি শক্তিও তাদেরকেই সমর্থন দিচ্ছে। ফলে এসব শাসকদেরকে চ্যালেঞ্জ জানানো বা গণতান্ত্রিকভাবে অন্য কোনো শক্তির ক্ষমতায় যাওয়া খুবই কঠিন। আরব শাসকরা তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিশেষ করে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিতে শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে।

আরববিশ্ব আবারও পুরোনো চেহারায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। লিবিয়ার ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত একনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল ইসলাম গত সপ্তাহে ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। আগামী ২৪ ডিসেম্বর এই নির্বাচন হবে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ দেশটির জনগণের বিরুদ্ধে গত এক দশক ধরে যুদ্ধ করছেন। তিনি গর্বভরে ঘোষণা করেছেন যে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ৯৫.১ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, ২০২৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং তার ছেলে হাফিজের ক্ষমতায় বসার পথ প্রশস্ত করে দিয়ে যাবেন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে আরববিশ্বে ইসলামি দলগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। সরকারের নিপীড়নে আগামী দিনে আরও দুর্বল হতে পারে এসব দলের অবস্থান। ইসলামপন্থীরা আবার সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করে আরেকটি আরব বসন্তের জন্ম দিতে পারলেই কেবল আগামী দিনে পরিস্থিতি ভিন্ন রকম হতে পারে। এছাড়া ইসলামি দলগুলোকে সবসময় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতার লোভ ছাড়তে বাধ্য করতে হবে। এসব লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে আরববিশ্বে ইসলামি দলগুলোর পুনরায় ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।