যুক্তরাষ্ট্র কি পতনের মুখে?


  • মেহেদী হাসান
  • ০৭ এপ্রিল ২০২১, ১২:৩৯

মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য হলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। ১৯২১ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। এর মাত্র তিন থেকে চার দশকের মধ্যে পুরোপুরি অবসান ঘটে মহাপ্রতাপশালী এ সাম্রাজ্যের। একইভাবে পতন ঘটে আরেক বড় ফরাসি সাম্রাজ্যের। ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যের এত দ্রুত পতন ঘটবে, সে সময় তা কেউ ভাবতে পারেনি। আজকের নতুন আঙ্গিকে যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যেরও একদিন এভাবে পতন হতে পারে, তা অনেকের পক্ষে ভাবা অসম্ভব। কিন্তু অনেকের মতে, এটাই হতে যাচ্ছে প্রকৃত বাস্তবতা।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বেশ আগে থেকেই বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের ক্ষয় শুরু হয়েছে। বিপুল অর্থব্যয়ে বিশ্বব্যাপী সামরিক আধিপত্য এখনও বেশ জোরালোভাবে ধরে রাখতে পারলেও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে শীঘ্রই তাদের পতন ঘটতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য পতনের আরেকটি দিক হলো অনেক বছর ধরে দেশটি যোগ্য নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে।

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক বিচারক মাইকেল পামব্রুক তার নতুন বইয়ে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বের ক্রমান্বয়ে পতনের দিক তুলে ধরেছেন। বইটির নাম- আমেরিকা ইন রিট্রিট : দি ডেকলাইন অব ইউএস লিডারশিপ ফ্রম ওয়ার্ল্ড ওয়ার সেকেন্ড টু কোভিড-১৯।

পামব্রুক তার বইয়ে ‘আমরাই শ্রেষ্ঠ’ যুক্তরাষ্ট্রকে ধ্বংসাত্মক এ ‘ব্যতিক্রমবাদ’ নীতি পরিহার করে প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ারের নীতিতে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

পামব্রুক তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি নতুন বৈশ্বিক অর্ডার প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র একটি দুর্বৃত্ত সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। ইরান, ইরাক, মধ্য আমেরিকা, ইন্দোচীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একের পর এক সামরিক অভিযান এবং এসব অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কোনো আইন কানুনের তোয়াক্কা করেনি।

বিশ্লেষকদের মতে জন্ম থেকেই সম্প্রসারণবাদ আর বিশ্বব্যাপী আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে নিয়তি এবং দায়িত্ব হিসেবে দেখে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়করা।

১৯৪৫ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান আদেশ দিয়েছিলেন হিরোশিমা নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা আক্রমনের। ট্রুম্যানের সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একই সাথে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে স্থান পায় বিশ্বের অন্যান্য রাজনৈতিক সিস্টেম ও মতবাদ অগ্রাহ্য করার নীতি।

ট্রুম্যানের পর ১৯৫৩ সালে প্রেসিডেন্ট হন আইজেন হাওয়ার। আইজেন হাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আধিপত্যবাদ এবং পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছিলেন। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন আইজেন হাওয়ার। ক্ষমতার শেষ প্রান্তে এসে আইজেন হাওয়ার বলেছিলেন আমাদের নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে মৃত্যুর বনিকরা যাতে ফিরে না আসে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

জো বাইনে আইজেন হাওয়ার নন। বাইডেন এখনো ইরান আর গুয়েতেমালায় সরকার উৎখাতের পক্ষে। ট্রাম্পের মত তিনিও শর্তহীনভাবে ইসরাইলের সম্প্রসারণনীতির সমর্থক। মিশরের স্বৈর শাসক জেনারেল আবদেল ফাতাহ আল সিসির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা এখনো বহাল রয়েছে। যদিও তার বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যপক মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ।

অনেকের মতে ট্রাম্প ও বাইডেন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি তিনিও মেনে চলবেন। তেমন কিছু পরিবর্তন হবে না। বাইডেনের জয়লাভের মাধ্যমে আশা করা হয়েছিল হোয়াইট হাউজ দুর্বৃত্ত মুক্ত হয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই জো বাইডেন হলেন পূর্বের প্রশসানের নীতির অনুসরণকারী। তাকে কেউ কেউ অভিহিত করে থাকেন মি. কন্টিউনিটি হিসেবে।

হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব গ্রহনের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি সিরিয়া আক্রমনের আদেশ দেন। এক সপ্তাহ পর ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস প্রকাশ্যে বিরোধীতা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একটি ঘোষণার। এ ঘোষনায় ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের কথা বলা হয়।

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মিত্র এবং বন্ধু দেশকে অতিশয় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন। এ সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ব্যাপক অবণতি ঘটে । ইরানের সাথে করা আন্তর্জাতিক চুক্তি তিনি ছিড়ে ফেলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এমন সাম্রাজ্যবাদী আচরণ থেকে বাইডেন ফিরে আসবে এ ধরনের আশা করাটা হবে ইতিহাসের চরম ভুল পাঠ। বাইডেন প্রশাসনের অধীনেও যুক্তরাষ্ট্র একই নীতি মেনে চলবে । তবে কেবল পরিবর্তন হবে ভাষার।

চীনের ক্ষেত্রেও ট্রাম্প প্রশাসনেরই নীতি মেনে চলতে যাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের কঠোর পদক্ষেপ সঠিক ছিল। বাণিজ্যমন্ত্রী গিনা রাইমন্ডো বলেছেন, চীনা আগ্রাসন থেকে আমেরিকান নেটওয়ার্ক রক্ষায় তিনি ট্রাম্প নীতি মেনে চলবেন।

জো বাইডেন হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব নেয়ার পর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিকদের বৈঠক বসে আলাস্কায়। কিন্তু বৈঠকের সমাপ্তি ভালভাবে হয়নি। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল তা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্ব থামছে না। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র-চীন বড় ধরনের নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য শুভ হবে না বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

আলাস্কায় অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র-চীন উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেন পরিষ্কার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। তিনি বলেন, জিনজিয়াং, হংকং, তাইওয়ানে চীনের পদক্ষেপ, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাইবার আক্রমন, মিত্র দেশগুলোর বিরুদ্ধে চীনের অর্থনৈতিক চাপ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এসব ক্ষেত্রে চীনা প্রতিটি পদক্ষেপ আইনের শাসনের বিরোধী।

জবাবে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক এবং অর্থনৈতিক আধিপত্যের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ দমন করে। বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করতে তথাকথিক জাতীয় নিরাপত্তার ধারণসমূহের অবমাননা করে আর চীনের বিরুদ্ধে আক্রমনে বিভিন্ন দেশকে উসকানি দিচ্ছে।

ইরান, ভেনিজুয়েলা, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন, উত্তর কোরিয়া, কিউবায় বছরের পর বছর যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবরোধ আরোপ করায় অবর্ণনীয় দুর্দশার শিকার হয়েছে এসব দেশ।

মাইকেল পামব্রুক তার নতুন বইয়ে ক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাহীন হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
সামরিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এখনো আধিপত্য ধরে রাখতে পারলেও অর্থনীতির ক্ষেত্রে চীনা আধিপত্যের বিরুদ্ধে ধরাশায়ী যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রকে টপকিয়ে ইউরোপের এখন সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। দক্ষিন ও দক্ষিনপূর্ব এশিয়া, মধ্য প্রাচ্য, আফ্রিকা সর্বত্র যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে চীনা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

সামরিক ক্ষেত্রে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য অন্য কারো সাথে তুলনার কোনো সুযোগ নেই এখনো এটা সত্য। কিন্তু এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের গুনতে হচ্ছে অগনিত ডলার। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আট শতাধিক সামরিক ঘাটি। এর পেছনে বছরে ব্যয় হচ্ছে ১০০ থেকে দুইশ বিলিয়ন ডলার।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্স ইনস্টিটিউট এর ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৯ সালে সারা বিশ্বের সব দেশের মোট সামরিক বাজেট ছিল ১ হাজার ৯১৭ বিলিয়ন ডলার। আর ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাজেট ছিল ৭৩২ বিলিয়ন ডলার। দি ব্যালেন্স ডট কমে বলা হয়েছে ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সামরিক বাজেট ৯৩৪ বিলিয়ন ডলার। সামরিক দিক দিয়ে এখনও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শীর্ষে।

যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি বড় সুবিধার দিক হলো এখনো বিশ্বের প্রায় সব দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষন করা হয় ডলারে। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অস্ত্রের মত ডলারও একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।

তবে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির কারণে এ সিস্টেমে লাভবান হচ্ছে চীন। ট্রাম্প চেয়েছিলেন চীনা পন্যের ওপর অধিকতর শুল্ক আরোপ। কিন্তু তারও পরিণতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভাল হয়নি।

বিভিন্ন দেশের ওপর অবরোধ আরোপের কারণে এসব দেশ বিকল্প পথ খুজে নিতে বাধ্য হচ্ছে। চীন এবং রাশিয়া ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে ক্রস বর্ডার ইন্টার ব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম প্রতিষ্ঠার। আর তারা কমিয়ে আনছে ডলার রিজার্ভের পরিমান। সাংহাই করপোরেশন অর্গানাইজেশন ক্রমে বাড়িয়ে চলছে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন এবং কমিয়ে আনছে ডলার নির্ভরতা।

যুক্তরাষ্ট্র এখন এশিয়ায় সর্বশক্তি নিয়োগ করতে যাচ্ছে চীনের উত্থান মোকাবেলায়। তবে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এ হাতুড়ি যথেষ্ট মজবুত নয়। চীন একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র কিন্তু সেটি সোভিয়েত ইউনিয়নের মত নয়। ১৯৮০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন কেবলমাত্র সামরিকভাবে বিশ্বে সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল না। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লড়াইয়ের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বসে পড়ে । কিন্তু আজকের চীনের উত্থান কেবল সামরিক দিক দিয়ে নয়। বরং চীন প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টেক্কা দিচ্ছে অর্থনীতি ও বাণিজ্যের মাধ্যমে। আর যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে চীনের মোকাবেলায়। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান দুরবস্থা চার দিক থেকে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র করোনা মোকাবেলায় ব্যর্থতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশটিতে মারা গেছে সাড়ে ৫ লাখের বেশি।