সুয়েজ খালের বিকল্প রুট নিয়ে মিসর-ইরান প্রতিযোগিতা


  • মোতালেব জামালী
  • ০৭ এপ্রিল ২০২১, ১২:২৮

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ মিসরের সুয়েজ খাল। এ নৌপথ দিয়ে বছরে শত শত পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করে। সম্প্রতি এ খালে বিশাল একটি জাহাজ আটকে পড়ায় প্রতিদিন ক্ষতি হয় শত শত কোটি ডলার। এমন পরিস্থিতিতে সুয়েজ খালের বদলে একটি বিকল্প রুট ব্যবহারের প্রস্তাব দেয় ইরান। এরমধ্যে চীনের সাথে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের এক চুক্তি করে দেশটি। যা পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যত কৌশলগত সর্ম্পকের গতিপ্রকৃতি বদলে দিয়েছে। ইরানের প্রস্তাব নিয়ে শুরু হয়েছে নানামুখী আলোচনা।

সুয়েজ খাল মিসরের সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত একটি কৃত্রিম সামুদ্রিক খাল। এটি ভূমধ্যসাগরকে লোহিত সাগরের সাথে যুক্ত করেছে। ফরাসি প্রকৌশলী ফার্দিনান্দ দ্য লেসেপ্স এই খাল খননের উদ্যোক্তা। ১৯৫৯ সালের ২৫ এপ্রিল খালটি খননের কাজ শুরু হয়। দশ বছর ধরে খননের পর ১৮৬৯ সালের ২৫ এপ্রিল কাজ শেষ হয়। এর পর সবার জন্য খুলে দেওয়া হয় খালটি।

উত্তরে ইউরোপ থেকে দক্ষিণে এশিয়া, উভয় প্রান্তে পণ্যপরিবহনে সুয়েজ খাল একটি জলপথ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এতে করে কোন জহাজকে এখন আর সম্পূর্ণ আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে আসতে হয় না। এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সংক্ষিপ্ততম জলপথ হচ্ছে এই সুয়েজ খাল।

মিসরের মালিকানাধীন ১৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ জলপথটিতে তিনটি প্রাকৃতিক হ্রদ রয়েছে। শুরুতে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১৬৪ কিলোমিটার এবং গভীরতা ছিল ৮ মিটার। বেশ কিছু সংস্কার ও সম্প্রসারণের পর ২০১০ সালের হিসাব মতে, এর দৈর্ঘ্য ১৯০ দশমিক ৩ কিলোমিটার , গভীরতা ২৪ মিটার এবং সর্বনিম্ন সরু স্থানে এর প্রস্থ ২০৫ মিটার। এর মধ্যে উত্তর প্রবেশ চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ২২ কিলোমিটার। মূল খালের দৈর্ঘ্য ১৬২দশমিক ২৫ কিলোমিটার এবং দক্ষিণ প্রবেশ চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ৯ কিলোমিটার।

খালটি উন্মুক্ত হবার আগে কখনো কখনো পণ্য জাহাজ থেকে নামিয়ে মিসরের স্থলপথ অতিক্রম করে, ভূমধ্যসাগর হতে লোহিত সাগরে এবং লোহিত সাগর হতে ভূমধ্যসাগরে অপেক্ষমাণ জাহাজে পারাপার করা হত। এর ব্যপ্তি ভূমধ্যসাগরের পোর্ট আবু সাঈদ হতে লোহিত সাগরের সুয়েজ পর্যন্ত।

এটি একটি এক লেন বিশিষ্ট খাল যাতে দুটি বাই-পাসের জায়গা আছে, এগুলো হল বাল্লাহ বাইপাস এবং গ্রেট বিটার লেক। সুয়েজ খালে কোন লক বা ভিন্ন উচ্চতার নৌপথে জলযান নেবার জন্য ব্যবহৃত বিশেষ গেট নেই। তাই সমুদ্রের পানি অবাধে এই খালের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

সাধারণত, বিটার লেকের উত্তরদিকের খালে শীত কালে উত্তরমুখী স্রোত প্রবাহিত হয়। গ্রীষ্মে দক্ষিণমুখী স্্েরাত প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে লেকের দক্ষিণ দিকের খালে স্রোত সুয়েজের জোয়ার-ভাটার সাথে পরিবর্তিত হয়।

সুয়েজ খালের মালিকানা ও পরিচালনা মিসরের সুয়েজ ক্যানেল কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যাস্ত। আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী সুয়েজ খাল সব সময়ই যে কোন দেশের পতাকাবাহী বাণিজ্যিক বা যুদ্ধ জাহাজের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

সম্প্রতি সুয়েজ খালে জাহাজ আটকে পড়ার পর আর্ন্তজাতিক বানিজ্যে বিরুপ প্রভাব পড়ে। কয়েক বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব হারায় মিসর। একই সাথে ভবিষ্যতে এমন বিপর্যয় এড়াতে বিকল্প রুট নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়।

সুয়েজ খালের বিকল্প হিসাবে চাবাহার বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দেয় তেহরান। ইরানের চাবাহার বন্দরভিত্তিক রুটটির নাম ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ করিডোর বা আইএনএসটিসি। তেহরান বলেছে, এশিয়া থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহণের জন্য সুয়েজ খালের তুলনায় এই রুটটির ব্যবহারে একদিকে ঝুঁকি অনেক কম, অন্যদিকে অনেক বেশি লাভজনক।

এ ধরনের সংকট মোকাবেলার সহজ সমাধান হিসাবে বিশ্বের সামনে বিকল্প রুটের প্রস্তাব দেয় তেহরান। ইরানি কূটনীতিক কাজেম জালালি বলেন, সুয়েজ খালের বিকল্প হিসাবে ভারত, রাশিয়া ও ইরানের মধ্যকার সাত হাজার ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নৌরুট সুয়েজ খালের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।

রুশ সংবাদমাধ্যম স্পুটনিক জানিয়েছে, এ ধরনের বিকল্প নৌরুটের প্রতি আগ্রহ রয়েছে তুরস্কের। দেশটির সঙ্গে ইতোমধ্যে বিকল্প কৌশলগত বাণিজ্যিক জোট গঠনে অনেকদূর এগিয়ে গেছে চীন, রাশিয়া, ইরান। এ পরিস্থিতিতে ইরান স্বাভাবিকভাবেই বিকল্প উৎস হিসাবে চাবাহার বন্দরের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। ইরানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুয়েজ খালের চেয়ে আইএনএসটিসি ব্যবহার করা কম ঝুঁকিপূর্ণ। সুয়েজ খালের চেয়ে আরো বেশি লাভজনক হয়ে উঠতে পারে এ নতুন রুট।

এনএসটিসির মধ্যদিয়ে ভারত থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহণে সময় লাগবে মাত্র ২০ দিন এবং খরচ কমবে শতকরা অন্তত ৩০ ভাগ। বর্তমানে সুয়েজ খাল দিয়ে পণ্য পরিবহণে ৪০ দিন সময় লাগে। ফলে খরচও বেশি হয়। ইরানের পাশাপাশি ভারত ও রাশিয়ার পক্ষ থেকে নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর বা এনএসটিসি রুটের পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। ২০০০ সালে দীর্ঘ বহুমুখী এই রুটের প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তীতে মধ্য এশিয়ার ১০টি দেশ এই পরিকল্পনায় যুক্ত হয়। ইরান সড়ক ও রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ওঠার পরিকল্পনা বিবেচনা করছে এবং তা সম্ভব হলে ভারত থেকে ইউরোপে মালামাল পরিবহণে খরচ কমবে।

চীনের সহায়তায় রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে তুরস্ক যৌথ বাণিজ্যি করিডোর প্রতিষ্টায় আগ্রহী। এতে তুরস্কের ওপর ইউরোপের দেশগুলোর নির্ভরশীলতা আরও বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের একচেটিয়া বাণিজ্যিক শক্তি খর্ব করার ক্ষেত্রে বিকল্প চবাহার বন্দর ব্যবহারকে এসব দেশ বড় এক উৎস হিসাবে বিবেচনা করছে। পাকিস্তানও যাতে চবাহার বন্দর ব্যবহার করে সেজন্য ইরানের তরফ থেকে ইসলামাবাদকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

ইরান সম্প্রতি চীনের সঙ্গে ২৫ বছরের একটি কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বছর পাঁচেক ধরে আলোচনার পর এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। চীন ও ইরানের মধ্যে এ ধরনের চুক্তিতে প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, বাণিজ্য, আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন দিক অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এ চুক্তির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে বর্তমানে দু’দেশের বাণিজ্য আগামী এক দশকে বৃদ্ধি করে বছরে তা ৬ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করা। তেল, গ্যাস, পেট্রোকেমিক্যাল, রিনিউয়েবল ও নিউক্লিয়ার জ্বালানি ছাড়াও অবকাঠামো খাতে ইরানে ব্যাপক বিনিয়োগ করবে চীন। এ চুক্তির ফলে দুটি দেশ বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ স্কিমে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত হবে। এক ট্রিলিয়ন ডলারের এ স্কিমের লক্ষ্য হচ্ছে চীনের সঙ্গে ইউরোপ ও আফ্রিকার সড়ক ও জলপথে যোগযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এর ফলে ডজনেরও বেশি দেশ বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবে।

সুয়েজ খালের বিকল্প নৌরুট হিসেবে চবাহার বন্দর ব্যবহারের যে প্রস্তাব ইরান দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা কিভাবে গ্রহণ করবে তা একটি বড় প্রশ্ন। কারণ ইরানের পরমানু কর্মসূচি নিয়ে দেশটির সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। এ পরিস্থিতিতে ইরানের প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের গ্রহণ করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে ।

এদিকে মিসরও চেষ্টা করবে সুয়েজ খাল ব্যবহারে সব দেশকে উদ্বুদ্ধ করতে। অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের সাথে ভালো সম্পর্ক আছে এমন দেশগুলো ইরানের বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হতে পারে। ফলে বন্দর ব্যবহার নিয়ে ইরান ও মিসরের মধ্যে একটি অঘেঅষিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন।