ওড়াকান্দির এত কদর কেন?


  • আলতাফ পারভেজ
  • ০৩ এপ্রিল ২০২১, ০৯:১৪

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে হঠাৎ ক্ষণিকের ঝড় তুলল ওড়াকান্দি। প্রায় পরাশক্তি হয়ে উঠতে চাওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে কেন বাংলাদেশের ওড়াকান্দি পর্যন্ত আসতে হলো? ইতিহাস কেন রাজনীতিকে বারবার এভাবে সমাজশক্তির মুখোমুখি হতে বাধ্য করে? ওড়াকান্দির শক্তির জায়গাটা কোথায়?

ওড়াকান্দি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে- এটা সকলেরই জানা। তবে দেশ-বিদেশের সবাই হয়তো এটা জানেন না- এত বিখ্যাত হয়েও এটা সাধারণ এক গ্রাম মাত্র। এখানেই জন্ম দুই ‘ঠাকুর’ হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদের। হিন্দু নমশূদ্রদের সামাজিক জাগরণের সংগঠক তাঁরা। হরিনামে মাতোয়ারা হওয়ার সংস্কৃতি থেকে এই সম্প্রদায় নিজেদের চিহ্নিত করে মতুয়া হিসেবে।

হরিচাঁদের জন্ম মার্চে। আরেক মার্চে সেখানে ঘুরে গেলেন নরেন্দ্র মোদি। তাঁর সফরসঙ্গীদের কষ্ট কমাতে নিভৃত ঐ পল্লীর রাস্তা-ঘাটে উন্নয়নের ধুম পড়েছিল কয়েকদিন।

মসৃণ রাস্তা-ঘাট ছাড়াই যুগের পর যুগ হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদের জন্মভিটা মতুয়াদের কাছে সর্বোচ্চ আবেগের জায়গা হয়ে আছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সেখানে আসাকে বিশ্ব মতুয়া সমাজ ঐ আবেগের স্বীকৃতি হিসেবেই দেখছিল।

শ্রী চৈতন্যই হরি হয়ে এসেছিলেন- বিশ্বাস করে হরিচাঁদের অনেক ভক্ত। বৈঞ্চব সংস্কৃতির ভেতরই মতুয়াবাদের বিকাশ। বর্ণ বঞ্চনা থেকে উঠে দাঁড়াতে শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিতেন হরি ও তাঁর পুত্র। হরিচাঁদ যে দর্শন গড়েন গুরুচাঁদ তাকেই প্রচার করেন। এদের মুক্তির-ধর্মতত্ত্বে শিক্ষার গুরুত্ব বিপুল। উচ্চবর্ণের বাধা পেরোতে হরিচাঁদ পুত্রকে শেষপর্যন্ত মুসলমানদের মক্তবে পাঠিয়েছিলেন।

বার্তাটি ছিল স্পষ্ট: সকলকে শিক্ষিত হতে হবে। এভাবেই নমোদের উঠে দাঁড়ানোর পালা। বঙ্গে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কলকাতাকেন্দ্রীক রামমোহনদের সংগ্রাম গ্রামে সামান্যই প্রভাব ফেলেছিল তখন। পূর্ববঙ্গের বিশাল কৃষিসমাজে জাতপাতবিরোধী সেই সংস্কার আন্দোলন তৈরি করেন বিশেষভাবে এই বাবা-ছেলে। শিক্ষার বাইরে কৃষির বাস্তব সমস্যা এবং গৃহকর্মকে গুরুত্ব দিয়ে বঙ্গের নিম্নবর্গকে জীবনবাদী করে তুলেছিলেন এই দুই লোকশিক্ষক। এভাবেই খুলনা-যশোর-বাকেরগঞ্জ-ফরিদপুর-ঢাকা মিলে অতিসংঘবদ্ধ বিশাল এক নমশূদ্র বলয় গড়ে ওঠে একদা। অবহেলিত ঐ রেঁনেসার কথা বনেদি সমাজবিদদের বিশেষ মনযোগ পায়নি আজও। কিন্তু রাজনীতির অঙ্কে দক্ষ আরএসএস পরিবারকে তা না জানলে চলবে কেন।

বাংলায় নমশূদ্রদের একটা বড় সামাজিক বৈশিষ্ট্য সম্প্রদায়গত যৌথতা। এই বলয়ে প্রথম ফাটল ধরে ভারত ভাগের আগে-আগে। ওড়াকান্দিতে তখন মূল ‘ঠাকুর’ গুরুচাঁদের নাতি প্রমথ রঞ্জন। তিনি ও বাকেরগঞ্জের যোগেন মন্ডল তখন বাংলার নমোদের প্রধান রাজনৈতিক স্তম্ভ। বয়সে মাত্র দু’ বছরের ব্যবধান উভয়ে। সুভাষ বসুর অনুসারী তাঁরা। দু’জনই ১৯৩৭-এর নির্বাচনে জিতেছেন তখন। চাইছেন ‘বঙ্গ’ এক থাকুক। কিন্তু ক্রমে যোগেন মুসলিম লিগের দিকে মৈত্রীর হাত বাড়ান। পি আর ঠাকুর এগোন কংগ্রেসের দিক। ‘দেশ’ভাগ ঠেকানো গেল না। পি আর ঠাকুর ওড়াকান্দি ছেড়ে কলকাতা গেলেন। যোগেন পাকিস্তানে। এভাবেই বাংলার তফসিলী ফেডারেশন ভাঙ্গে সেদিন।

দেশভাগের পর পি আর ঠাকুর প্রথমে কলকাতায় উঠলেও একসময় বনগাঁয়ে চিকনপাড়ায় কিছু জমি যোগাড় করে বেসরকারি একটা উদ্বাস্তু কলোনি বানান। এটাই আজকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির বিখ্যাত ‘ঠাকুরনগর’। তখনও পূর্ববঙ্গের নমোশূদ্ররা সামান্যই হঠাৎ সৃষ্ট সীমান্ত পেরিয়েছে। সেই ধারা ভাঙ্গে ১৯৫০ ও ১৯৬৪-এর দাঙ্গার ধাক্কায়। হতাশ যোগেনও একসময় পাকিস্তান ছাড়লেন। তফসিলীদের বড় কোন নেতাকে মুসলিম লিগ আর কাছে টেনে নিল না। আস্তে আস্তে নমোদের সংখ্যা বাড়লো নদীয়া, ২৪ পরগণায়...আশেপাশে।

ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের নেতৃত্ব জানতো শিক্ষায় এগিয়ে থাকা এই জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। তাই জোর দেয়া হলো পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তাদের পুনর্বাসনে। আন্দামান ও দন্ডকারণ্য পর্যন্ত ১৬৪টি ক্যাম্প হলো। এভাবেই ওড়কান্দির ভরকেন্দ্র থেকে দূর-দূরান্ত থেকে ছিটকে পড়লো বাংলার ‘তফসিলী’রা। কালে কালে তাদের নতুন আধ্যাত্মিক আশ্রয় হলো ‘ঠাকুরনগর’। আর এদিকে হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদের কাশিয়ানীর পুরানো ঠিকানা আঁকড়ে থাকলেন শেষের জনের পুত্র সুধন্যচাঁদের ছেলে শ্রীপতি চাঁদ। তারও পরে শ্রীপতির পুত্রবধূ সীমাদেবী ঠাকুর এবং এখন নাতি সুব্রত ঠাকুর।

সুব্রত ঠাকুর কাশিয়ানী উপজেলার চেয়ারম্যান হলেন গত নির্বাচনে। এই পরিবারের আর কোন বাড়তি রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে সেটা ব্যাপক।

পি আর ঠাকুরের মৃত্যুর পর বনগাঁয়ে ঠাকুরনগরে নেতৃত্ব যায় স্ত্রী বিণাপানি দেবীর কাছে। মতুয়া সংস্কৃতিতে নারীর নেতৃত্ব গ্রহণের সাবলীল ঐতিহ্য আছে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের রাজত্বে তারা মতুয়াদের রাজনৈতিক গুরুত্বকে তেমন আমলে নেয়নি। বর্ণ বঞ্চনার চেয়েও শ্রেণী বঞ্চনাকে মুখ্য ভাবতেন তাঁরা। মতুয়ারা তাতে সন্তুষ্ট ছিল না। মমতা সেই ফাঁকটি পূরণ করেন। বিণাপানি দেবীর কাছে যেতেন তিনি। সেই সুবাধে মতুয়া সম্প্রদায় তৃণমূলের দিকে ঝোঁকে। তবে সমর্থন হাসিল করলেও তৃণমূল শুরুতে রাজনৈতিক উচ্চপদে মতুয়া কাউকে ঠাঁই দেয়নি। বিজেপি সেই শূন্যতা পূরণ করে।

রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক হস্তক্ষেপে এভাবে ঠাকুরদের পারিবারিক ভরকেন্দ্রে ধীরলয়ে ফাটলও ধরে। একটা উপদল তৈরি হয় পি আর ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র মঞ্জুলকৃঞ্চ ঠাকুরকে সামনে রেখে। আরেক অংশ যায় প্রথম পুত্র কপিল কৃষ্ণ ঠাকুরের স্ত্রী মমতা ঠাকুরের দিকে। প্রথম কেন্দ্রটি বিজেপিপন্থী; দ্বিতীয়টি তৃণমূলের সঙ্গে আছে। এর বাইরে বামপন্থীদের সঙ্গেও আছে ঠাকুরবাড়ির কেউ কেউ। যোগেন মন্ডল কখনো নির্বাচনে না জিতলেও সেই সংগ্রামী ধারাও কিছু অবশিষ্ট আছে বৃহত্তর মতুয়া সমাজে। এভাবে ওড়াকান্দির বাইরে মতুয়াদের কয়েকটি রাজনৈতিক ধারা তৈরি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।

পশ্চিমবঙ্গের ভোটাভুটিতে এই সম্প্রদায়ের নির্ধারক ভূমিকা বাড়ছেই। বনগাঁ ও বসিরহাটে এই প্রভাব সরাসরি। এই দুই অঞ্চলে ১৪টি বিধানসভা আসন আছে। এর বাইরে নদীয়া ও ২৪ পরগণার আরও সমসংখ্যক আসনে মতুয়ারা ভোটের বড় হিস্যা।

বাংলাদেশে মতুয়াদের সংখ্যা অনুমান করা হয় ৬০-৭০ লাখ। ভারতে সংখ্যাটা দ্বিগুণেরও বেশি। এই সম্প্রদায়ের ভোটারদের বড় অংশই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সঙ্গে আছে। ভোটের অংক তাই বলে। বিজেপি অকৃতজ্ঞ নয়। পি আর ঠাকুরের নাতি শান্তনু ঠাকুরকে লোকসভায় সদস্য হওয়ার সুযোগ দিয়ে ঠাকুরনগরের গুরুত্বকে সম্মান দেখিয়েছে। তাতে অবশ্য মতুয়াদের সব ভোট সবসময় তারা পাবে এমন গ্যারান্টি তৈরি হয়নি।

তবে মন্ত্রি হওয়া-না-হওয়ার বাইরে ভারতে মতুয়াদের প্রধান দাবির সুরাহা হয়নি আজও। সেটা হলো পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্ব পাওয়া। মতুয়াদের বড় দাবি এটা। বিজেপির অবস্থান এ প্রশ্নে নেতিবাচক নয়। তারা নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ‘শরণার্থী’ হিন্দুদের স্থায়ী করে নিতে ইচ্ছুক। কিন্তু এই আইন নিয়ে রাজনীতিও করেছে তারা। প্রতিশ্রুতি দিলেও আইন অনুযায়ী বিধি হয়নি। আবার এই আইন নিয়ে আসামসহ বিভিন্ন স্থানে প্রবল বিরোধিতাও আছে। বিজেপিকে সেটাও বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। এক আইনের সঙ্গে লেপটে আছে অনেক রাজ্যের ভোটের অংক। পশ্চিমবঙ্গ যা ভোট বাড়ায়- সেটা আপার আসামকে অগ্নিগর্ভ করে তোলে।

এর মাঝেই পশ্চিমবঙ্গে ভোটের হাওয়া রীতিমতো ঝড়ে রূপ নিয়েছে এবার। চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে এই ভোটযুদ্ধ। মতুয়া ও মুসলমানরা এমন দুই জনগোষ্ঠী যাদের ভোট প্রায় এক শ’ আসনে জয়-পরাজয় ঠিক করবে। মুসলমানদের ভোট বিজেপি সামান্যই পাবে। ফলে মতুয়া ভোটের বড় অংশ বিজেপির পাওয়া চাই। সেই সূত্রেই পশ্চিমবঙ্গ দখলের যুদ্ধে মতুয়াদের মহা-গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। কিন্তু বনগাঁয়ের ঠাকুরনগরে এমন কোন নেতা বা উপদল নেই- যাকে বশ করে পুরো মতুয়াদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তৈরি সম্ভব। এ অবস্থাই পরোক্ষে বাংলাদেশের ওড়াকান্দির গুরুত্ব সামনে এনেছে।

পশ্চিমবঙ্গের ভোটের হিসাবের বাইরেও সমগ্র মতুয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়া সম্ভব কেবল ওড়াকান্দির মাধ্যমে। এটা বুঝতে পারা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচায়ক। কোন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি শেকড়ে মনযোগ দেয়ার সেই মুন্সিয়ানা দেখালে তাকে নেতিবাচকভাবে নেয়ার সুযোগ কম। মতুয়ারা তাই মোদির সফর উদ্দীপনার সঙ্গে নিয়েছিল।

হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদের সামাজিক আন্দোলনের একটা বড় দিক ছিল শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া। সেই সূত্রে মতুয়ারা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ দু জায়গাতেই শিক্ষায় এগিয়েছে এবং এগোচ্ছে। শিক্ষার সূত্রে আসছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে এই সম্প্রদায় এখনও সকল সামাজিক বঞ্চনার অভিজ্ঞতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সামাজিক ন্যায়বিচার কায়েমই মতুয়াবাদের গোড়ার কথা।

উপমহাদেশে জাতপাতের বিরোধিতা এবং বর্ণবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে এই সম্প্রদায়ের একটা স্পষ্ট অবস্থান ছিল অতীতে। সেই পটভূমিতেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ- উভয় অঞ্চলে এই ঘরণা থেকে বহু পরিবর্তনবাদী রাজনীতিবিদ ও সংস্কৃতিকর্মীর জন্ম হয়েছে। তবে নাগরিকত্বের বিনিময়ে মতুয়া-সম্প্রদায় পুরোপুরি বিজেপির আশ্রয়ে গেলে বাংলার রাজনীতি বিপজ্জনক মোড় নিতেও সময় লাগবে না। সেই বিপদের কথাও উঠছে।

ওড়াকান্দিতে মোদির সফরে কতটুকু রাজনীতি আর কতটুকু ধর্মতত্ত্বের মিশেল ঘটেছে এ নিয়ে বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানের শেষ হয়নি এখনও। সেসব লেখালেখির ভেতরে লুকিয়া থাকা শঙ্কার খবর এদেশের মতুয়াদের রাজনৈতিক সচেতন অংশও ভালোভাবেই রাখেন। কিন্তু ওড়াকান্দি আপাতত অতিথিসেবা ও ভোটের অংককে আলাদা রাখলো। নিম্নবর্গের নিজস্ব এক ধর্মতত্ত্বের কাছে পরাক্রমশালী রাজনীতির চলতি সমর্পণকে মতুয়ারা উপভোগ করতে চাইছে।

অছ্যুত প্রথার বিরুদ্ধে এই সম্প্রদায়ের দেড় শ বছরের সংগ্রামে নতুন এক বিজয় পালক লাগলো বটে। যদিও তৃণমূল কংগ্রেস এই পুরো অধ্যায়ে নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত ভেবেছে। ভোটের কারণে আপাতত ক্ষোভের কথা জোরেশোরে বলছে না তারা। কিন্তু ভোটে হার-জিত যাই হোক, মমতা এ নিয়ে ঘরে-বাইরে মোটাদাগে প্রশ্ন তুলবেন। তাঁকে যারা বোঝেন- তাদের এ বিষয়ে সন্দেহের কারণ নেই।