সুয়েজ খাল সংকট : বিশ্বের জন্য বার্তা


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০১ এপ্রিল ২০২১, ১৩:০৯

বালুঝড়ের কারণে ৪০০ মিটারের একটি কন্টেইনার খালের তীরে আটকে সুয়েজ খাল দিয়ে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে কন্টেইনারবাহী জাহাজের জট লেগে যায়। অথচ, মিসর প্রশাসন ও সরকারের তরফ থেকে শুরুতে সংকট সমাধানের কোনো উদ্যোগ ছিল না। সুয়েজ খাল বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্যদিয়ে মিসরের সিসি সরকারের অদক্ষতার আরেকটি নজির দুনিয়াজুড়ে আলোচিত হচ্ছে।

৬ বছর আগে যখন সুয়েজ খালে ৩৫ কিলোমিটারের বর্ধিত একটি অংশ উন্মুক্ত করা হয়, তখন মিসরের রাজধানী কায়রোর পথে পথে নানা রকমের ব্যানার শোভা পাচ্ছিল। ব্যানারে লেখা ছিল, সুয়েজ খালের এ বর্ধিতাংশ মিসরের পক্ষ থেকে গোটা পৃথিবীর জন্য একটি উপহার। উদ্বোধনের পরপর মিসরের সেনাশাসক আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসি বিশ্বনেতাদেরকে স্বাগত জানান। হেলিকপ্টার ও জেট বিমানের মহড়ায় প্রকম্পিত হয় গোটা সুয়েজ এলাকা। সুয়েজ খালের নতুন বর্ধিতাংশ চালু করাকে সিসি মিসরের জাতীয় অর্জন এবং দেশটির স্থিতিশীলতা হিসেবেও দাবি করেছিলেন। অথচ, এবার সুয়েজ খাল যখন বন্ধ হলো, তখন সরকার ও প্রশাসন এমনকি মিডিয়াগুলো ছিল চুপচাপ।

খাল দিয়ে যাতায়াত বন্ধ হওয়ার প্রায় দুদিন পর খাল কর্তৃপক্ষ যাতায়াতটি পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেয়। দীর্ঘদিন ধরেই সুয়েজ খাল দিয়ে যাতায়াত করা জাহাজগুলো নাব্যতা নিয়ে অভিযোগ তুললেও খাল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কখনোই কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তারা গতানুগতিকভাবেই নব্যতা বৃদ্ধির কাজ চালিয়ে গেছে।

মিডিয়ার এ রহস্যজনক নীরবতার নেপথ্য কারণ নিয়ে অনুসন্ধানে জানা যায় মিসরীয় প্রশাসন সাংবাদিকদেরকে ডেকে হুমকি দিয়েছে যাতে তারা খালের ওপর দিয়ে যাতায়াত বন্ধ হওয়ার কোনো সংবাদ বা গুজব প্রচার না করে। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর এবারই প্রথম সুয়েজ দিয়ে নৌ জাহাজগুলোর যাতায়াত সম্পূর্ণ বন্ধ হয়। জাহাজ চলাচল বন্ধ হওয়ার পরও মিসরের মিডিয়া সুয়েজ খালে জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক আছে বলে মিডিয়া দাবি করেছে।

দুদিন এ ধরনের লুকোচুরি খেলার পর অবশেষে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছে যে, খালের নাব্যতার সংকটের কারনে নৌ যানের যাতায়াত সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। মিসরের বর্তমান প্রশাসন রাজনীতি বা অর্থনীতি যেকোনো বিষয়েই অপপ্রচার চালাতে এবং তথ্য গোপন করতে সিদ্ধহস্ত। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, সরকারী কর্মকর্তারাও এখন দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে ক্ষমতাসীন সেনাশাসকের কথামতো মিথ্যা কথা বলতে আর দ্বিধা করেন না।

এই ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। ২০১৫ সালে মিসরের শার্ম আল শেইখ থেকে রাশিয়ার একটি যাত্রীবাহী বিমান উড্ডয়নের মাত্র ২৩ মিনিট পরই আইএস সেনারা গুলি করে সেই বিমানকে ভূপাতিত করে। বিমানটি রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গে যাওয়ার ঘটনা ছিল। এই ঘটনার পর রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য লোহিত সাগরের এই অবকাশ যাপন কেন্দ্রমুখী সকল বিমানের শিডিউল বাতিল করে দেয়।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মিসরের বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষ তখনও একটি বার্তায় এ ঘটনাকে বেমালুম অস্বীকার করে। তারা বিমানটির ভূপাতিত হওয়ার জন্য কারিগরি ত্রুটিকে দায়ী করে। মূলত মিসরের পর্যটন খাত যেন কোনো ধরনের ঝুঁকির মুখে না পড়ে সেজন্য সবাই লুকোচুরিটি খেলে। যদিও তিন মাস পর মিসরীয় কর্তৃপক্ষ ঠিকই ঘটনাটি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। কারণ উইলায়াত সিনাই নামক একটি আই-এস অনুগত মিলিশিয়া আবারও গুলি করে আরেকটি বিমান ভূপাতিত করার পর মিসরীয় কর্তৃপক্ষ আর ঘটনাটি আড়াল করে রাখতে পারেনি।

সুয়েজ খাল দিয়ে যাতায়াতের সংকট কেটে গেছে। তবে, এ ঘটনাটি বিশ্বকে দুটো গুরুত্বপূর্ন বার্তা দিয়েছে। সবাই বুঝেছে যে, সুয়েজ খাল এবং মিসর এখনও বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর আন্তর্জাতিক রুটে জাহাজ চলাচলের স্বার্থে কতটা গুরুত্বপূর্ন। মিসর বা সুয়েজ খাল নিয়ে কোনো ধরনের স্থবিরতা আসলে তার প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতির ওপর পড়ে।

দ্বিতীয় বিষয়টি সবাই অনুধাবন করছেন , রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সিসির অযোগ্যতা ও অদক্ষতা। সিসি শুধুমাত্র মিসরের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ও আইনের শাসনের সংকট তৈরি করেননি। বরং তার দুরদর্শী সিদ্ধান্তের অভাবের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপর্ণ নৌপথটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এবার সুয়েজ খালটি যেভাবে অবরুদ্ধ হলো, ভবিষ্যতে তা আবার হবে না- তা বলা যাচ্ছে না। সুয়েজ খাল যদি এভাবে অনিশ্চিত হয়ে যায়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলো হয়তো সুয়েজ খালের বিকল্প হিসেবে ইসরাইলকেই বেছে নিতে বাধ্য হবে। ইতোমধ্যে আরব আমীরাতসহ বেশ কয়েকটি আরব দেশ ইসরাইলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় মিসর ও সুয়েজখালের একচেটিয়া নৌ বানিজ্য যে আশংকার মুখে পড়েছে।

সিসির দীর্ঘ স্বৈরশাসন এবং তার অদক্ষতার প্রভাব এখন মিসরের প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সিসির আরেকটি বড়ো ভুল হলো, তিনি প্রতিবেশি দেশ লিবিয়ায় ভুল ব্যক্তিকে সমর্থন দিয়েছেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের ভয় থেকে বাঁচতে সিসি সেখানকার বিদ্রোহীদেরকে সমর্থন করে বিশ্ব রাজনীতির দাবায় ভুল চাল খেলেছেন। এখন সবচেয়ে আর্ন্তজাতিক বানিজ্যরুটটি অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার কারনে হুমকির মুখে পড়েছে।

সুয়েজ খাল ও নীল নদে নব্যতা নিয়মিত না করায় দুটো নৌ স্থাপনাতেই সংকট দেখা দিয়েছে। ২০১২ সালে মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট যখন ইথিওপিয়ায় নতুন ড্যাম প্রতিষ্ঠা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন, তখন সিসি তার সমালোচনা করেছিলেন। সিসি পরবর্তীতে দাবি করেন যে, মুরসির চিন্তাধারা সঠিক ছিল না। সিসি ইথিওপিয়াকে এবং সুদানকে এই ড্যাম নির্মাণে সবুজ বার্তা দিয়ে দেন।

কিন্তু এই ঘটনার প্রায় এক দশক পর এসে মুরসিরর অবস্থানই যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখন সিসি তার প্রতিবেশি দেশের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের কথাও ভাবছেন। অথচ এরই মধ্যে ইথিওপিয়া ড্যামটি নির্মাণও করে ফেলেছে। মূলত নিজ দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলার কাজে খুব বেশি মনোনিবেশ করায় জাতীয় এবং আঞ্চলিক ইস্যুগুলোতে সিসি বারবার ভুল করে বসছেন।

২০১৩ সালের মিসরের রাবা স্কয়ারে পরিচালিত গণহত্যা এবং ক্ষমতার মসনদ দখল করার পর সিসির পক্ষ থেকে ওয়াশিংটনে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছিল যারা মার্কিণ প্রশাসনের সাথে দেন-দরবার করে ২৬০ মিলিয়ন ডলার আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল। সব মিলিয়ে সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে সিসি সরকারকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের বিশাল প্যাকেজ প্রদান করা হয়েছিল। মার্কিন কংগ্রেসে যেসব সদস্য সিসির বিরুদ্ধে ছিলেন, তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্যও সিসি লবিস্ট ফার্ম গ্লোভার পার্ক গ্রুপকে নিয়োগ করেন। কাজটি করার জন্য এই লবিস্ট ফার্মটিকে তখন প্রতিমাসে আড়াই লাখ ডলার প্রদান করা হতো। সিসির পোষা লবিস্টরা সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম ও জন ম্যাককেইনের মতো লোকদেরকে সিসির পক্ষে নিয়ে আসার জন্য জোর প্রয়াস চালান।

গ্লোভার পার্কের নিরন্তর প্রচেষ্টায় সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম সিসির বিষয়ে নমনীয় হন। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মার্কিন লবিস্টদেরকে সিসি সরকার ১৩ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার প্রদান করে। অথচ এ বিশাল পরিমান অর্থ সুয়েজ খাল ও নীলনদের উন্নয়ন করা যেতো। দেশজুড়ে মিসরীয় সভ্যতার নানা নিদর্শন, ট্যুরিস্ট স্পট এবং যুবকদের কর্মসংস্থানের পেছনে ব্যয় করা হলে হয়তো মিসরের চেহারাই পালটে যেতো।

সিসির নেতৃত্বে মিসর ক্রমাগতভাবে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। মিসর এখন এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে গণতন্ত্র নেই। বিরোধীদের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। জনগনের কথা বলার স্বাধীনতা নেই। দেশটিতে অসংখ্য মুল্যবান সম্পদ থাকার পরও দেশটির নাগরিকেরা নিতান্তই অসহায় জীবন যাপন করছেন। মিসরের অর্থনীতির এই নাজুক অবস্থার প্রভাব পড়েছে দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর। আর সাধারন মানুষেরও দুর্ভোগের কোনো শেষ নেই। বেকারত্ব, জিনিসপত্রের দামের উর্ধ্বগতি আর মুল্যস্ফীতির কারণে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। আরেকটা তাহরির স্কয়ার করার মতো সাহস বা সক্ষমতা হয়তো এখন মিসরীয়দের নেই। হয়তো আরো কিছুটা সময় লাগবে।