এবার সমুদ্রে গুপ্ত হামলায় ইরান-ইসরাইল


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ৩০ মার্চ ২০২১, ০৯:০৭

মধ্যপ্রাচ্যে চিরবৈরী ইরান ও ইসরাইল দীর্ঘদিন আকাশ ও স্থলপথে ছায়াযুদ্ধ চালিয়েছে। এখন তাদের সঙ্ঘাত গড়িয়েছে সমুদ্রে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এক দেশ অপর দেশের রফতানিমুখী পণ্যবাহী জাহাজে হামলা চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা পরস্পরকে চাপে রাখতে চাইছে।

সবে সকাল হয়েছে। ভূমধ্যসাগরের আকাশে সূর্য উঠতে শুরু করেছে। ঠিক সেই সময়টাতেই ইরানি একটি কার্গো জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটে। ‘শাহর ই কর্দ’ নামের জাহাজটি তখন ছিল ইসরাইল উপকূল থেকে ৫০ মাইল দূরে। নাবিকরা দেখতে পান যে ডেকে রাখা শত শত কন্টেইনারের একটি থেকে ধোয়ার কুণ্ডলি বেরুচ্ছে।

ইরানের রাষ্ট্রীয় জাহাজ কোম্পানি জানায় সেটি স্পেনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। ওই বিস্ফোরণকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে আখ্যা দেয় ইরান।

তবে শাহর ই কর্দ জাহাজে মার্চের ওই হামলার ঘটনাটি ছিল ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী গোপন সংঘাতের একটি। ইসরাইলের একজন কর্মকর্তা জানান, ওই হামলা ছিল আগের মাসে তাদের একটি জাহাজে হামলার প্রতিশোধ।

ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগর হয়ে চলাচলরত ইরানি তেল ও অস্ত্রের জাহাজে ২০১৯ সাল থেকেই হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। এর মাধ্যমে আঞ্চলিক ছায়াযুদ্ধে এবার সমুদ্রে আরেকটি ফ্রন্ট খুলে গেছে। আগে এই যুদ্ধ হতো আকাশ ও স্থলে।

ইরানও গুপ্ত হামলার মাধ্যমে এর জবাব দিচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। সর্বশেষ গত ২৫ মার্চ দুপুরে আরব সাগরে ইসরাইলি কন্টেইনার জাহাজ দ্য লরিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। একজন ইসরাইলি কর্মকর্তা হামলার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, হামলায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

আমেরিকা, ইসরাইল ও ইরানের কর্মকর্তারা জানান, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে লাগাম টানার জন্য ইসরাইল এসব হামলা চালাচ্ছে। ইরানের তেল শিল্পের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সুযোগ নিচ্ছে ইহুদিবাদী দেশটি।

এখন পর্যন্ত এসব হামলা ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয় ধরনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এই সংঘাত আরও বিস্তৃত হতে পারে। ইরানকে বশে আনতে বাইডেন প্রশাসন পরমাণু চুক্তিতে ফেরার যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাও ব্যাহত হতে পারে এসব হামলার ঘটনায়। ইসরাইলের ইহুদিবাদী লবি চাচ্ছে, বাইডেন যাতে ইরানের সঙ্গে চুক্তিতে না ফিরতে পারেন। ইরানও কোনো ছাড় দিয়ে চুক্তিতে ফিরতে রাজি নয়।

২০১৯ সাল থেকে ইসরাইলি কমান্ডোরা ইরানের অন্তত ১০টি কার্গো জাহাজে হামলা চালিয়েছে বলে আমেরিকা ও ইসরাইলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে এ সময় তারা অন্তত ২০টির মত ইরানি জাহাজকে টার্গেট করেছিল।

বেশিরভাগ ইরানি জাহাজই দেশটি থেকে জ¦ালানি নিয়ে তাদের ঘনিষ্ট মিত্র সিরিয়ায় যাচ্ছিল। দুটিতে ছিল সামরিক সরঞ্জাম। একজন আমেরিকান কর্মকর্তা জানান, শাহর ই কর্দ জাহাজটিতে ছিল সামরিক সরঞ্জাম। সেটি যাচ্ছিল সিরিয়া।

তবে ইসরাইল সরকার এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। ইরানের পাল্টা জবাব সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়নি। কারণ ইরান এসব গুপ্ত হামলা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কথা বলে না।

ফেব্রুয়ারিতে ইসরাইলি যে জাহাজটিতে হামলা হয় সেটি গাড়ি বহন করছিল। হেলিওস রে নামের জাহাজটি জার্মানির তৈরি গাড়ি নিয়ে চীনে যাচ্ছিল। জাহাজটি যখন ইরান উপকূলের সরু পথ হরমুজ প্রণালি পাড়ি দিচ্ছিল তখন একটি স্পিডবোট থেকে ইরানি কমান্ডোরা জাহাজটিতে দুটি টাইম বোমা রেখে যায়। এর মিনিট বিশেক পরেই বিস্ফোরণে জাহাজের মাস্তুলে ছিদ্র তৈরি হয়। লোহিত সাগরে আরও কয়েকটি ট্যাঙ্কারেও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এ ধরনের হামলা হয়েছে। অনেক হামলার জন্য ইরানের সমর্থনপুষ্ট ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের দায়ী করা হচ্ছে। ইরানও ইসরাইলের মতই এসব হামলার দায় অস্বীকার করেছে।

হামলার ধরন দেখে মনে হচ্ছে ইরান কোনো জাহাজ ডুবিয়ে দিতে চায়নি। তবে একটি বার্তা দিতে চেয়েছে যে চাইলে তারা সেটাও করতে পারে।

ইরানের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঘেইস ঘোরেইশি বলেছেন, বিষয়টা এমন যে তুমি এখানে হামলা করলে আমরা ওখানে আক্রমণ করব। ইরান ও ইসরাইল তাদের গোপন যুদ্ধ এখন উন্মুক্ত জলরাশিতে নিয়ে যাচ্ছে।

ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে দীর্ঘদিনের এই ছায়াযুদ্ধ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইরান পুরো অঞ্চলজুড়ে মিলিশিয়াদের অস্ত্রশস্ত্র ও টাকা পয়সা দিচ্ছে। বিশেষ করে সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, গাজা ও লেবাননে ইসরাইলের শত্রু হেজবুল্লাহসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় ইরান সরকার।

ইরানের ক্ষমতার লাগাম টানার জন্য ইসরাইল নিয়মিতই সিরিয়া ও লেবাননে আকাশ ও স্থলপথে ইরানের পণ্যবাহী যানে হামলা চালিয়ে থাকে। এসব হামলার ফলে আকাশ ও স্থলপথ ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় সাগরপথকে বেছে নেওয়া হয়। ফলে সংঘাত এখন সাগরপথে মোড় নিয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে ব্যাহত করার জন্য ইসরাইল ইরানে গুপ্তহত্যা ও ইরানের মাটিতে নাশকতা চালিয়ে থাকে। উভয়পক্ষই সাইবার হামলারও অভিযোগ করে থাকে। গত বছরের এপ্রিলে ইসরাইলের পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় ইরান সাইবার হামলা চালায় বলে অভিযোগ ইসরাইলের। এর জবাবে ইরানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে সাইবার হামলার চালায় ইসরাইল।

গত জানুয়ারিতে ভারতের নয়াদিল্লিতে ইসরাইলি দূতাবাসে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় ইরানের কুদস ফোর্সকে দায়ী করা হয়। ইসরাইল, আমেরিকান ও আমিরাতি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা পরিকল্পনার অভিযোগে ফেব্রুয়ারিতে ইরানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৫ জনকে গ্রেফতার করেছে ইথিওপিয়া। এসবের মানে হচ্ছে ইসরাইল ও ইরান গোপনে হামলা চালাতে চালায়। কেউই সরাসরি যুদ্ধে আগ্রহী নয়।

ইরানের ইসলামিক রিভ্যুলিউশনারি গার্ড বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং সামরিক বিশ্লেষক হোসেইন দালিরিয়ান নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ইসরাইল ও ইরান কেউই প্রকাশ্যে এসব হামলার দায় নিতে চায় না। কারণে সেটা যুদ্ধ বলে বিবেচিত হবে এবং এটি সামরিক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। তবে জাহাজে এ ধরনের হামলা রাষ্ট্রীয় সমর্থন ছাড়া সম্ভব নয়। আমরা বাতি নিভিয়ে যুদ্ধ করছি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান ইসরাইলকে চাপে রাখতে চায় এবং এজন্য মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের মিত্রদের অস্ত্রশস্ত্র ও টাকাকড়ি দিয়ে সাহায্য করতে চায়। এর মাধ্যমে ইসরাইলকে ঘিরে ফেলতে চায় ইরান। এরফলে ভবিষ্যতে পরমাণু চুক্তি নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে আলোচনায় সুবিধাজনক থাকবে তেহরান।

ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের পরমানু চুক্তির ঘোর বিরোধী ইসরাইল। ছোটখাট হামলার মাধ্যমে ইসরাইল ইরানকে এমন চুক্তিতে বাধ্য করতে চায় যেখানে তেহরান পরমাণু কর্মসূচি ত্যাগ করবে। এর অংশ হিসেবে ইসরাইল গত বছরের জুলাইয়ে ইরানের একটি পরমাণু প্রকল্পের স্থানে বড় ধরনের হামলা চালায় এবং নভেম্বরে ইরানের শীর্ষস্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করে। ইসরাইল অবশ্য এসব হামলার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইলে হামলার দুটো লক্ষ্য। প্রথমটি হলো লেবাননের হিজবুল্লার কাছে ইরানের সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো বন্ধ করা। এসব সরঞ্জাম দিয়ে হিজবুল্লাহ প্রিসিসন মিসাইল বানাতে সক্ষম হলে ইসরাইল হুমকিতে পড়বে। কারণ ইসরাইল সীমান্তেই লেবানন অবস্থিত। এ ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে সক্ষম।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে তেল রফতানি বিঘ্নিত করে ইরানের আয়ের পথ সীমিত করে দেওয়া। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় ইরান এমনিতেই অর্থনৈতিক সংকটে আছে। ২০১৮ সাল আমেরিকা ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে তেহরান গোপনে রফতানির দিকে ঝুঁকছে।

হামলা পরিচালনা করছে ইসরাইলের নৌবাহিনীর এলিট কমান্ডো বাহিনী ফ্লোটিলা থার্টিন। ইহুদিবাদী দেশটির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ বাহিনী এ ধরনের হামলা চালাচ্ছে বলে আমেরিকার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

তেল ও প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা দিয়ে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে টিকিয়ে রাখছে ইরান। হিজবুল্লাকেও একইভাবে সহায়তা দেয় তেহরান। ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান গবেষক সিমা শাইন বলেন, ইসরাইলি হামলার লক্ষ্য হলো সিরিয়ায় বিক্রি ঠেকানো এবং হিজবুল্লাহকে অর্থ সহায়তা বন্ধ করা। আমেকিা ও ইসরাইলের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত টর্পেডো দিয়ে জাহাজের ইঞ্জিন ও প্রপেলারকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এতে জাহাজের ক্ষতি হলেও তা ডুবে যায় না।

গত বছর ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ হয়ে আসার সময় থেকে হামলা বেড়েছে। ইরানি জাহাজ গুলোকে সাধারণত রাশিয়ার জাহাজ পাহাড়া দিয়ে নিয়ে যায়। তবে ভূমধ্যসাগরে রাশিয়ার জাহাজের কাছে পৌছার আগেই ইরানি জাহাজে হামলা চালায় ইসরাইল। এসব হামলার ফলে অনেক সময় ইরানি জাহাজ আবার দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে ইরানের জলসীমার কাছাকাছি ইসরাইলে জাহাজগুলো পড়ে বিপদে। কারণে সেখানে ইসরাইল তেমন শক্তিমত্তা দেখাতে পারে না।