ইসরাইলি সেনাবাহিনীতে যৌন হয়রানি


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৩ মার্চ ২০২১, ১২:৪৮

ইসরাইলের সেনাবাহিনীতে কর্মরত এমন বেশ কয়েকজন নারী সেনা দেশটির মিলিটারি পুলিশের কাছে দাবি করেছে যে, বিগত কয়েক বছরে ইসরাইলি সেনাবাহিনীতে যৌন হয়রানির মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফের জেন্ডার অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা দিয়েছেন। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে ইসরাইলি সেনাবাহিনীতে ১৫৪২টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় যৌন হয়রানির এ হার প্রায় ২৪ শতাংশও বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইসরাইলের মিডিয়াগুলো বলছে, ২০১২ সালের পর থেকে দেশটির সেনাবাহিনীতে যৌন হয়রানির মাত্রা বেড়েই চলছে। হয়রানির শিকার নারী সৈনিকরা পুলিশের কাছে এসে অভিযোগ না করায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র জানান, এ এমন ঘটনা সেনাবাহিনীর জন্য খুবই উদ্বেগজনক। ইসরাইলি বাহিনীর ভাবমর্যাদা এ ঘটনায় অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খুব শীঘ্রই ইসরাইলি সেনাবাহিনী এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করবে এবং ভবিষ্যতে যৌন হয়রানির ক্রমবর্ধমান হারকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্যেও কার্যকর কিছু উদ্যেগ গ্রহণ করবে।

অ্যাসোসিয়েশন অব রেপ ক্রাইসিস সেন্টারস ইন ইজরাইল, এআরসিসিআই নামের একটি সংস্থা জানিয়েছে, বিশ্বব্যপী ‘মি-টু আন্দোলনের সূত্রপাত হওয়ার সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আড়ালে থাকা যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো সামনে চলে আসে। প্রতি বছর এ জাতীয় ঘটনা বাড়ছে। ২০১২ সালে যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল ৭৭৭টি। ২০১৭ সালে এসে এ সংখ্যা ১৫শ ছাড়িয়ে যায়। শুধু সামরিক দায়িত্ব পালনের সময়ই নয়, সেনাবাহিনীকে নানা ধরনের বেসামরিক দায়িত্ব পালনে যখন নিয়োগ করা হয় তখনও এমন জাতীয় ঘটনা আশংকাজনকভাবে ঘটেছে ।

প্রতি বছর যে হাজার হাজার অভিযোগ এআরসিসিআই এর কাছে জমা পড়ছে তার মধ্যে বড়ো একটি অংশই হলো ধর্ষন ও সমকামিতার বিষয়ে। এর বাইরে অমার্জিত ও অশালীন আচরণ এবং যৌন হয়রানিরও পৃথক অভিযোগ পাওয়া যায়। ২০১৯-২০ সালেই মৌখিকভাবে যৌন হয়রানির অভিযোগ জমা পড়ে দুই হাজারের ওপর। জোরপূর্বক নগ্ন ছবি তোলা এবং সেগুলোকে ব্যক্তি চরিতার্থে ব্যবহার করারও অভিযোগ মিলেছে ইসরাইলি পুরুষ সেনাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগের ৯১ শতাংশ এসেছে পুরুষ সেনাদের বিরুদ্ধে আর ৯ শতাংশ এসেছে নারী সেনাদের বিরুদ্ধে। নারী সেনাদের বিরুদ্ধে কয়েকবছর আগে তেমন কোনো অভিযোগ না পাওয়া গেলেও বর্তমানে নারী সেনাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ বাড়ছে।

জেরুজালেম পোস্টের তথ্যনুযায়ী গত ৫ বছরে দেশটির সেনাবাহিনীতে যৌন নির্যাতন ও হয়রানির মাত্রা ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছরের জুলাই মাস অবধি প্রথম ৭ মাসে ১৩টি অভিযোগ পাওয়া গেছে শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। বলা হচ্ছে, তারা ক্ষমতা ও পদের অপব্যবহার করে অধীনস্তদের নির্যাতন করেছেন। অশ্নীল ঘটনার অভিযোগ মিলেছে ১৬৫টি, শারীরিকভাবে হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে ২৬৩টি। ৬৩টি অভিযোগ ছিল অনাকাংখিত ছবি তোলার বিষয়ে। ৪৯ শতাংশ অভিযোগই জমা পড়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ গুলোর মধ্যে ১৯৮টি অভিযোগের বিষয়ে মিলিটারি পুলিশ তাৎক্ষনিকভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে। যদিও খোদ মিলিটারি পুলিশের বিরুদ্ধেও ১৭৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে। আর বিগত বছরে জমা পড়া ১ হাজার ৯৭টি অভিযোগের বিষয়েই কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রশাসনের সাড়া না পাওয়ায় এবং চাকুরীতে বাড়তি হয়রানির ভয়ে অনেকেই অভিযোগ দিতেও সাহস পাচ্ছে না। ফলে, যেসব অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তার তুলনায় প্রকৃত অনাচারের মাত্রা যে অনেক বেশি তা সহজেই অনুমান করা যায়।

গত বছর ইসরাইলি সেনাবাহিনীর উদ্যেগে বাহিনীর ভেতরের অবস্থা নিয়ে একটি তদন্ত পরিচালনা করা হয়। সেই তদন্ত কমিটির কাছে প্রতি ৬ জন কর্মরত নারী সেনার মাঝে একজন অভিযোগ করেছেন যে, দীর্ঘ চাকুরি জীবনে কমপক্ষে একবার যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ৬ শতাংশ নারী সেনা বলছেন তারা দুই থেকে তিনবার মর্মান্তিক এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। আর ৩ শতাংশ নারী সেনা বলছেন তারা চারবার বা আরো বেশি তাদের সহকর্মী ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিকৃত যৌনাচারের শিকার হয়েছেন।

শুধু যৌন হয়রানিই নয়, ইসরাইলি সেনাদের বিরুদ্ধে আটক ফিলিস্তিনি কারাবন্দীদের বিরুদ্ধে মারাত্মক ও বর্বরোচিত নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, আটক অনেক ফিলিস্তিনিদেরকেই শারীরিকভাবে আঘাত করে রক্তাক্ত করে দেয়া হয়। শুধু বন্দীরাই নয়, পশ্চিম তীরের বেশ কিছু ফিলিস্তিনি নাগরিক অভিযোগ করেছেন, রাস্তা দিয়ে যাতায়াতের সময় তাদের গাড়িতে ইসরাইলি সেনারা পাথর নিক্ষেপ করে। এ ঘটনায় গাড়ির কাঁচ ভেঙে আহত হয়ে অনেকেই হাসপাতালে নিহত হয়েছে। এমনকী ৫ বছরের একটি ছোট্ট শিশু ইসরাইলি সেনাদের হাতে আহত হয়।

পশ্চিম তীরে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করেছে এমন কয়েকজন ইহুদি মিলে ১০ বছরের একটি ফিলিস্তিনি কিশোরীকে আক্রমন করেছে বলে জানা গেছে। মেয়েটি পশ্চিম তীরের মাদামা গ্রামের বাসিন্দা। ইহুদি সেনা ও বেসামরিক ব্যক্তিদের যৌথ আক্রমনে মেয়েটির মাথা ও মুখ প্রচন্ড আঘাত পান। এর আগে গত মাসে ফিলিস্তিনের একজন বাস ড্রাইভারকেও হত্যার অভিযোগ উঠেছিল ইসরাইলি সেনাদের বিরুদ্ধে।

ইসরাইলি সেনা, ইসরাইলি সিকিউরিটি এজেন্সী বা আইএসএ’র বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি বন্দীদের বিরুদ্ধে বিধি বহির্ভুতভাবে নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। শিশু এবং বয়স্করাও এ অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বন্দীদেরকে মারধর, কষ্ট দেয়া, শিকল পড়িয়ে আটতে রাখা, ঘুমুতে না দেয়া, ক্রমাগত চাপের মধ্যে রাখা, মেরে ফেলার হুমকি দেয়া, সবার থেকে আলাদা করে নির্জন কোনো ঘরে মাসের পর মাস ফেলে রাখা- এসকল অভিযোগ হরহামেশাই ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে পাওয়া যাচ্ছে।

সামির আবিদ নামক একজন ফিলিস্তিনি নাগরিককে আটক করে তাকে আঘাত করে পাজড়ের হাড় ভেঙে ফেলা হয়। এর ফলে কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ার একটি খবর মিডিয়ায় প্রকাশ হয়। এর আগে হেফাজতে নির্যাতনের মাধ্যমে ৪ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করার অভিযোগও উঠেছিল ইসরাইলি সেনাদের বিরুদ্ধে।

ইসরাইলি সেনারা প্রায়ই পশ্চিম তীর ও গাজায় অভিযান চালায় এবং নিরীহ ফিলিস্তিনিদেরকে আটক করে নিয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ অভিযোগগুলো চালানো হয় রাতের বেলায় এবং কোনো ধরনের ওয়ারেন্ট ছাড়াই। ফলে, যারা আটক হয়, কাগজে কলমে অনেকের নামও অনেক সময় থাকে না। আর যারা বেঁচে থাকে তাদেরকেও ইসরাইলের কারাগারগুলোতে আটক রাখা হয়। অথচ ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের এ আচরণ আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী। দখলদার কোনো সেনা অধিকৃত ভূমি থেকে বেসামরিক লোককে ধরে নিয়ে নিজেদের কারাগারে রাখতে পারে না। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ইসরাইল এমনটাই করে আসছে বছরের পর বছর।

ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ ডিটেশন অর্ডারগুলোকে বারবার নবায়ন করে দিনের পর দিন কোনো ধরনের মামলা ও বিচারকাজ ছাড়াই ফিলিস্তিনি নাগরিকদেরকে আটক রাখছে। বর্তমানে ইসরাইলের কয়েকটা কারাগারে বিনা বিচারে আটক ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৯ হাজারেরও বেশি।

অনেক ক্ষেত্রে আটককৃত ব্যক্তিদের পরিবারকে সাক্ষাত করতে দেয়া হয় না। বিশেষ করে যারা হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার বাসিন্দা তাদেরকে কখনোই বন্দী পরিজনদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগও দেয়া হয় না। শুধু প্রাপ্ত বয়স্কই নয়, ইসরাইলের কারাগারে ১৮২ জন শিশু ফিলিস্তিনিকেও বন্দী রাখা হয়েছে।

ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনালের ফিলিস্তিন শাখা জানিয়েছে, এসব শিশুদেরকে খুবই নির্মমভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের অভিভাবক বা পরিবারের কোনো সদস্যকেও থাকার সুযোগ দেয়া হয় না। অথচ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী একটি শিশুকে নিতান্ত বাধ্য না হলে তাকে গ্রেফতার করার কোনো সুযোগ নেই।

ইসরাইলি সেনা ও পুলিশের অনেক কর্মকর্তা শিশুদেরকে আটক রাখা বা মুক্তি দেয়ার বিষয়ে নিয়মিতভাবে অর্থনৈতিক লেনদেন ও ঘুষের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। চাহিদা মতো অর্থ না দিলে এসব শিশুকে স্বাধীনতাকামী দলের সাথে সম্পৃক্ত দেখিয়ে জেলে নিক্ষেপ করা হয়।

ইসরাইলি বিচারিক মন্ত্রণালয় বলছে, তারা সেনাবাহিনীর এমন কিছু কর্মকর্তাকে বিচারের উদ্যেগ নিয়েছে যাদের সেনাবাহিনীর সমরাস্ত্র কেনাবেচায় দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও অভিযুক্তদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। মন্ত্রণালয় বলছে, তারা সংশ্লিষ্ট কোম্পানীর কাছ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ঘুষ নিয়ে সেনাবাহিনীর জন্য বেশ কিছু সমরাস্ত্র ক্রয় করেছে। জার্মানী থেকে একটি সাবমেরিন কেনার সময়ও কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২ বিলিয়ন ডলার ঘুষ নেয়ারও অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ, জালিয়াতি, বিশ্বাসভঙ্গ, অর্থপাচারেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ইসরাইলি সেনাবাহিনী উন্নত এয়ারডিফেন্স সিস্টেম, পারমানবিক প্রকল্প, নিত্য নতুন সমরাস্ত্রের খবরের আড়ালে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরের এ কুৎসিত চেহারা সবাইকে হতবাক করেছে।