লিবিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

-

  • মোতালেব জামালী
  • ০৩ মার্চ ২০২১, ১৭:৩৩

উত্তর আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ লিবিয়ায় জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে গঠিত নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। গৃহযুদ্ধের স্থায়ী অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আগামী ২৪ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব এ সরকারকে পালন করতে হবে। দেশটির ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থায় এ সরকারকে নানা আর্থিক সংকটও মোকাবেলা করতে হবে।

সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভার কাছে অজ্ঞাত একটি স্থানে গত ৫ ফেব্রুয়ারি লিবিয়ার লড়াইরত বিভিন্ন পক্ষের ৭৫ জন প্রতিনিধির বৈঠকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি নতুন সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। তবে এসব দেশ একই সাথে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় লিবিয়ার জনগণকে আরও অনেক দূর পর্যন্ত যেতে হবে।

লিবিয়ার পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের ৪ জন নেতাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এতে তিন সদস্যের প্রেসিডেন্সি কাউন্সিল ও একজনকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে। জাতিসংঘের গত বছর নভেম্বর মাসে নেয়া উদ্যোগের ফল হিসেবে শেষ পর্যন্ত এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা সম্ভব হলো। নতুন সরকারকে লিবিয়ার দুই ভাগে বিভক্ত পার্লামেন্টের অনুমোদন লাভ করতে হবে। সেটা যদি সম্ভব না হয় তাহলে শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়বে এই সরকার।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমে দায়িত্ব পালন করবেন গ্রিসে দেশটির রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইউনুস মানফি। প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী আবদুল হামিদ মোহাম্মদ দাবিবাহকে। তিনি মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসনামলে লিবিয়ান ইনভেষ্টমেন্ট এন্ড ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির প্রধান ছিলেন। আগামী ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন পর্যন্ত এই সরকার দায়িত্ব পালন করবে।

২০১১ সালে তিউনিশিয়ায় শুরু হওয়া ‘আরব বসন্তের’ ঢেউ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মতো লিবিয়াতেও এসে গণঅন্দোলনের সূচনা করেছিল। প্রথমে বেনগাজী শহরে কিছু মানুষ চার দশক ধরে দেশটি শাসন করা একনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফির পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। গাদ্দাফি সামরিক পন্থায় বিক্ষোভকারীদের দমন করতে চাইলে দেশটিতে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এর এক পর্যায়ে বিদ্রোহীদের হাতে গাদ্দাফি আটক ও নির্মমভাবে নিহত হন। এর পরের ইতিহাস যুদ্ধ ও সংঘাতের।

লিবিয়ানরা গাদ্দাফিকে উৎখাতের বিপ্লবের এক দশক উদযাপন করেছে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি । বিপ্লবের দশম বার্ষিকী উদযাপনের আগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল গত এক দশকে লিবিয়ায় যারা যুদ্ধাপরাধ ও ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘন করেছে তাদেরকে বিচারের আওতায় আনার আহবান জানিয়েছে।

গাদ্দাফিকে উৎখাতের পর বিভিন্ন গ্রুপের নেতাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে দেশটিতে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষ থেকে ২০১৪ সালে নতুন করে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধ অবসানে ২০১৫ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় গঠন করা হয় গভর্ণমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড বা জিএনএ নামে ত্রিপোলী কেন্দ্রিক একটি অন্তর্বর্তী সরকার। ফায়েজ সারাজকে এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী করা হয়।

কিন্তু গাদ্দাফির পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা বিদ্রোহী জেনারেল খলিফা হাফতার জাতিসংঘ সমর্থিত এই সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা এলএনএ নামে একটি সশস্ত্র বাহিনীর স্বঘোষিত প্রধান। তার সমর্থনে দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় শহর তবরুকে গঠন করা হয় আরেকটি সরকার। ফলে লিবিয়া পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

সমান্তরালভাবে চলে দুটি প্রশাসন। একটি জিএনএ ও একটি এলএনএ সরকার নামে পরিচিতি পায়। তুরস্ক, কাতার, কুয়েত ও ইতালী জিএনএ সরকারকে এবং রাশিয়া, ফ্রান্স, মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এলএনএ সরকাকে সমর্থন প্রদান করে।

২০১৯ সালে এই দুই সরকারের মধ্যে সংঘাত ভয়াবহ আকার ধারণ করে। জেনারেল খলিফা হাফতার ত্রিপোলী দখল করার জন্য সর্বাত্মক হামলা শুরু করেন। কিন্তু তুরস্ক জিএনএ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সামরিক সহযোগিতা দিতে শুরু করেন। তার দেশের সেনাবাহিনী ও সিরিয়ার শত শত ভাড়াটে মিলিশিয়া সদস্যকে ত্রিপোলীর আশেপাশে মোতায়েন করা হয়। ফলে খলিফা হাফতারের অভিযান থেমে যায়। এক পর্যায়ে তিনি পিছু হটতে বাধ্য হন। এরপর তিনি জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত শান্তি আলোচনায় যোগ দিতে বাধ্য হন।

দেশটির বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠা সশস্ত্র মিলিশিয়া গ্রুপের কারনে লিবিয়ার পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক। এসব মিলিশিয়া গ্রুপ লুটতরাজ, তেল ও অস্ত্র বিক্রি, অপহরণ ও মানব পাচারসহ নানা অনৈতিক কাজের মাধ্যমে অর্থ আয় করে থাকে। লিবিয়ার পরিস্থিতি কতোটা ভয়াবহ তার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর ভয়াবহ হামলা। গত ২১ ফ্রেব্রুয়ারি রাজধানী ত্রিপোলীতে সাবেক জিএনএ এর প্রধানমন্ত্রী ফয়েজ আল সারাজের নিরাপত্তায় নিয়োজিত লোকদের ওপর সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ফাতিহ বাসাঘার দেহরক্ষীরা নির্বিচার গুলি বর্ষণ করে। এতে একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হন। ধারণা করা হচ্ছে, ফয়েজ আল সারাজকে হত্যার জন্যই হামলা চালানো হয়েছিল।

একই সরকারে দায়িত্ব পালন করা দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক কতোটা তলানীতে গিয়ে পৌঁছলে এ ধরনের প্রাণঘাতি হামলা চালানো হতে পারে এঘটনাই তার বড় উদাহরণ। রাজধানী ত্রিপোলীর সড়ক এখনো কতোটা বিপজ্জনক, অনিরাপদ ও ঝুকিপূর্ণ তা এই হামলা আবারো প্রমান করেছে। তার উপর আবার বিদেশি হস্তক্ষেপ লিবিয়ার পরিস্থিতিকে কোনভাবেই স্বাভাবিক হতে দিচ্ছে না।

এ পরিস্থিতিতে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের স্থায়ী অবসানে আবারো উদ্যোগী হয় জাতিসংঘ। গত বছর বার্লিনে এক সম্মেলনে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের প্রভাবশালী জেনারেল খলিফা হাফতারের সাথে পশ্চিমাঞ্চলের জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত জিএনএ সরকারের যুদ্ধবিরতির পর দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ এই উদ্যোগ গ্রহন করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই উদ্যোগ কতটা সফল হবে তা নিয়েও অনেকে সন্দিহান।

লিবিয়া বিশেষজ্ঞ ও ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেষ্ট এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামী হামদি জাতিসংঘের উদ্যোগকে একটি বড় ঘটনা হিসাবে দেখেন। তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানে আগে কোন পক্ষই এমন চিন্তা করেনি। যদিও এটা নিয়ে এখনো অনেক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। এ বছরের শেষে লিবিয়ায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সংঘাতের স্থায়ী অবসানের যে চেষ্টা চলছে তা দেশটির স্থানীয় ও বাইরের শক্তির দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

লিবিয়ার আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে তেল ও গ্যাস রপ্তানী করা। তেল ক্ষেত্রগুলো প্রধানত লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। জেনারেল খলিফা হাফতারের বাহিনী লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে তেল রপ্তাানী করার জন্য যে সব পাইপ লাইন ও স্থাপনা রয়েছে তার সবই জিএনএ সরকার নিয়ত্রিত পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়ার তেল রপ্তানীতে স্থবিরতা নেমে এসেছিল। এ পরিস্থিতিতে নতুন সরকার যদি তেল উৎপাদন ও রপ্তানীর উপর নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারে তাহলে আর্থিক সংকট মোকাবেলা করা খুব সহজ হবে না।

নতুন সরকারের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিদেশি সৈন্য ও ভাড়াটে মিলিশিয়াদের উপস্থিতি। লিবিয়ায় বর্তমানে ১১টি সামরিক ঘাটিতে তুরস্ক ও রাশিয়ার সৈন্য ও ভাড়াটে মিলিশিয়া রয়েছে। এদের মোট সংখ্য প্রায় ২০ হাজারের মতো।

রাশিয়া লিাবয়ায় সৈন্যদের উপস্থিতির কথা অস্বীকার করে আসছে রাশিয়া। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রাশিয়ার মিলিশিয়া বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের মিলিশিয়াদের সাথে মিশে আছে অনেক রুশ সৈন্য। বিদেশি সৈন্য ও মিলিশিয়াদের উপস্থিতি শান্তি প্রতিষ্ঠায় নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াবে। যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়া থেকে সব বিদেশি সৈন্য ও প্রত্যাহারের আহবান জানিয়েছে। কিন্তু এতে কোন কাজ হবে বলে কেউ মনে করছেন না।

এছাড়াও লিবিয়ায় ৪টি বড়মিলিশিয়া গ্রুপ আছে যারা গৃহযুদ্ধকে ব্যবহার করে অর্থ আয় করে থাকে। এরা তেল ও অস্ত্র বিক্রি, অপহরণ, মানব পাচার ইত্যাদি অনৈতিক কাজে জড়িত। এসব মিলিশিয়া গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণে আনা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াবে। অন্তবর্তী সরকার এসব চ্যালেঞ্জ ও বাধা কাটিয়ে উঠে সুষ্ঠু ভাবে নির্বাচন করতে পারবেন কিনা তার উপরই এখন লিবিয়ায় স্থায়ী শান্তি নির্ভর করছে।