বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য নীতিকে কিভাবে দেখছে রাশিয়া চীন তুরস্ক


  • মোতালেব জামালী
  • ২৬ জানুয়ারি ২০২১, ১২:৩৬

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সাতটি দেশের ওপর সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা বাতিল করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি শপথ নেওয়ার অল্প পরেই এ বিষয়ে নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মুসলিম দেশগুলো বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে ট্রাম্প আমলের মার্কিন নীতি পরিবর্তন করার সুস্পষ্ট আভাস দিয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রম্পে যে সাতটি দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন সেগুলো হচ্ছে- ইরান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, সোমালিয়া, ইয়েমেন ও সুদান। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী আসা নিয়ন্ত্রণ করতে ২০১৫ সালে রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত মার্কিন কংগ্রেস একটি আইন পাশ করে। ট্রাম্প ২০১৭ সালে এই আইনের আওতায় সাতটি মুসলিম দেশের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর ফলে এসব মুসলিম দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা মানুষের সংখ্যা একেবারে কমে যায়। ২০১৬ সালে যেখানে এসব দেশ থেকে প্রায় ৭২ হাজার লোককে যুক্তরাষ্ট্রে আসার ভিসা দেওয়া হয়েছিল, সেখানে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ২০১৯ সালে তা নেমে আসে মাত্র ১৬ হাজারে।

অন্যদিকে ক্ষমতা ছাড়ার আগে ট্রাম্প প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার ব্যাপারে দ্রুত বেশ কিছু বেশকিছু সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। তারা ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহী গ্রুপকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে। এছাড়া ইরাকি একজন সামরক কর্মকর্তা ও কয়েকটি ইরানী সংগঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

বিরোধপূর্ণ পশিচম সাহারার উপর মরক্কোর সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে ইরানকে আরো কোনঠাসা ও এই অঞ্চলে ইসরাইলের আবস্থানকে জোরদার করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষশা সংস্থা ক্রাইসিস গ্রুপ ট্রাম্পের এসব কাজকে বড় ধরণের সমসা সৃষ্টিকারি পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণণা করেছেন।

জাতিসংঘ কর্মকর্তারা বলছেন, হুথিদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে যেসব সাহায্য সংস্থা কাজ করছে তাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এমনকি দেশটিকে মারাত্মক দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তারা বলছেন, খাদ্য সংকট ভয়াবহ আকার ধারন করতে পারে যা গত ৪০ বছরেও দেখা দেয়নি।

ইরাকের সামরিক কর্মকর্তা ফালেহ আল ফায়াদের উপর নিষেধাজ্ঞা আারোপ করে ট্রাম্প সরকার। এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে দেশটির সরকার। তারা বলেছে ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত একেবারেই অগ্রহনযাগ্য ও বিস্ময়কর। ফালেহ আল ফায়াদ মিলিশিয়া বাহিনী পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সের প্রধান। ইরান এই বাহিনী কে সমর্থন দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের। সে কারণেই ট্রাম্প প্রশাসন ফায়াদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরাকে মার্কিন সেনাদের উপর হামলার ঘটনা বেড়ে গেছে।

ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মুসলিম দেশগুলো বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে তার নীতি পরিবর্তন করার সুস্পষ্ট আভাস দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। ক্ষমতায় থাকার সময় গত চার বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডদখল করার নীতির প্রতি নগ্ন সমর্থন দিয়েছেন। তার সরকারের তথাকথিত ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ ছিল বিশ^ মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বকে মুছে ফেলার এক মারাত্মক ষড়যন্ত্র।

ট্রাম্প ইরানের উপর পুনরায় অবরোধ আরোপ করেন। এর ফলে ইরানের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দেশটির জনগনের উপর দুর্দশা নেমে আসে। ইরানে সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যেই ট্রাম্প এই অবরোধ আরোপ করেছিলেন বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।

ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তান নীতিও নানা সংকটের মধ্যে পড়ে। যেসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, সেসব দেশ থেকেও ট্রাম্প প্রকাশ্যেই মার্কিন সেনাদের দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলতেন। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ট্রাম্পের নীতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যে নানা সমস্যা তৈরি হয়। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব, অর্থনৈতিক মন্দা ও তেলের দাম কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো গভীর ভাবে সম্পৃক্ত। এ সময় মধ্যপ্রাচ্যে চীন, রাশিয়া ও তুরস্কের ব্যাপক উপস্থিতি এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক বিষয়ে তাদের প্রভাব বেড়ে যায়।

ট্রাম্প আমলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অনেকটা কমে আসে। আঞ্চলিক ঘটনা প্রবাহে রাশিয়া ও তুরস্কের প্রভাব বাড়তে থাকে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি গভীরভাবে অনুগত রাষ্ট্রগুলো শঙ্কিত হয়ে উঠে। রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানকে কোনঠাসা করতে এসব দেশ ইসরাইলমুখী হয়ে উঠে। ট্রাম্প প্রশাসন ও ইহুদি লবি গ্রুপ এ সুযোগটি পুরোপুরি গ্রহন করে। ফিলিস্তিন স্বার্থকে পুরোপুরি ভাবে জলাঞ্জলি দেয়।

অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরব ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তুরস্ক এ অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে। ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায় তুর্কি সৈন্যরা অবস্থান করছে। এছাড়া পূর্ব ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর জ¦ালানী স্বার্থকেও চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে তুরস্ক।

সিরিয়ার আসাদ সরকারকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সহায়তা করার পর রাশিয়া এ অঞ্চলে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান জোরদার করেছে। বর্তমানে রাশিয়া এই অঞ্চলের বিভিন্ন নিরাপত্তা ইস্যুতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও পালণ করছে।

তবে চীন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে নিজের অবস্থান একটু লো প্রোফাইলে রাখছে। দেশটি তার ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’কে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের মূল প্রকল্প হিসেবে তুলে ধরতে চেষ্টা করছে। যাতে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করা যায়। এর মাধ্যমে সময়ের আবর্তনে চীন এক সময় এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক খেলোয়াড়ে পরিণত হবে। যদিও চীন তার অর্থনৈতিক, জ¦ালানী ও কারিগরী সহযোগিতার মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে এখনই বড় ভূমিকা রাখছে।

বাইরের বিভিন্ন শক্তির উপস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানে অনেক পরিবর্তন এনেছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশ আত্মবিশ^াসে বলীয়ান হয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এসব দেশ কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামলানো, তেল পরবর্তী যুগে প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যত নিয়ে পরিকল্পনার মতো বিষয়ে নিজেদের সক্ষমতা গড়ে তুলছে।

বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমানে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। ভেঙ্গে পড়ছে পুরনো ব্যবস্থা। এই অঞ্চলের অনেক দেশের জনগণ স্বাধীনতা, অধিকার ও সমৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহ করছে। নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনের মরিয়া চেষ্টা করছেন এসব মানুষ। এমনকি অনেকেই বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াচ্ছে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই এমন পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে দমন-পীড়ন চালিয়েও এসব মানুষকে তাদের পথ থেকে সরানো যাচ্ছেনা।

মধ্যপ্রাচ্যের নতুন এই বাস্তবতার আলোকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই অঞ্চলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নির্ধারণ করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে এই অঞ্চলের বড় খেলোয়াড়দের সাথে আলোচনা, সমন্বয় ও অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে কাজ করতে হবে। তবে সেই কাজটি মোটেও সহজ নয়। ওবামা প্রশাসন আমলে আরব বসন্তের নামে পুরো মধ্যেপ্রাচ্যে বদলে গেছে। এখন পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠেছে।

বাইডেন প্রশাসনকে প্রথম ভাবতে হবে ইরান নিয়ে। ইরানের সাথে পারমানবিক চুক্তি নবায়ন ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের আঞ্চলিক নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কাও দূর করতে হবে। ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনে যে হানাহানি চলছে তা এই নিরাপত্তাহীনতার সাথে সম্পর্কিত। এটা দূর করতে বাইডেন প্রশাসনকে এমন একটি কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে যা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই সন্তষ্ট করবে।

গত কয়েক বছরে এই অঞ্চলে যে খুনোখুনি, ধ্বংসযজ্ঞ ও বাস্তচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে তাতে কোন পক্ষই জিততে পারেনি। এগুলো বন্ধ করতে কার্যকর কোন শান্তি আলোচনারও উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

অতি সম্প্রতি কয়েকটি আরব দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিরই বাস্তবতা বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। কিন্তু তেল আবিব অন্য দেশগুলোর সাথে সর্ম্পক উন্নয়নে কতটা ছাড় দেবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের পথে না হাটলে মধ্যপ্রাচ্যে কখনই শান্তি ফিরে আসবে না। ট্রাম্প প্রশাসন নেতানিয়হুকে যা ইচ্ছে তা করার ব্ল্যাংক চেক দিয়েছিলেন। বাইডেন সে পথে হয়তো হাটবেন না। কিন্ত ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে আস্থা অর্জন করতে হবে। একই সাথে মধ্যপ্রাচ্যর নতুন বাস্তবতায় রাশিয়া, চীন ও তুরস্কের সাথে পর্দার অন্তরালে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। কারন এই তিন প্রভবাশালী দেশকে সম্পৃক্ত করা না গেলে এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্টা করা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন মধ্যপ্রাচ্যে সম্ভব নয়। সে দিন ফুরিয়ে গেছে।