তুরস্ক পাকিস্তান আজারবাইজান বন্ধুত্বের নেপথ্যে


  • মুরশিদুল আলম চৌধুরী
  • ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ০৭:৫৭

নাগরনো-কারাবাখ লড়াইয়ে আজারবাইজানের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল তুরস্ক ও পাকিস্তান। তখন তিন দেশের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে নানা সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন বিশ্লেষকরা। আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে তিন দেশের নাম। দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কদিন আগে বৈঠক করেছেন পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে। সেখানে তারা আগামী দিনে পরস্পরের সহযোগী হয়ে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। ইসলামভীতি ছড়ানোর বিরুদ্ধে যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং জম্মু-কাশ্মীরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নির্যাতিত মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে পরস্পরকে সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে এ তিন মুসলিম দেশ। নিজের আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য একটি দেশ যখন যুদ্ধ করছে, দেশটি ধরেই নিচ্ছে, অন্য দুই দেশ থেকে সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তাসহ সব ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যাবে।

গত বছর আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যেকার সঙ্ঘাতে আজারবাইজানকে পাকিস্তান এবং তুরস্কের দেওয়া সর্বাত্মক সহযোগিতার মাধ্যমে সেটি প্রমাণিত হয়।

নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চল থেকে আর্মেনীয় বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল তুরস্কের তৈরি ড্রোন। আজারবাইজানের অখণ্ডতা রক্ষায় খোলামেলা সহায়তা দিয়েছিল পাকিস্তান।

পরমাণু অস্ত্রসমৃদ্ধ পাকিস্তান ও আজারবাইজনের সম্পর্ক বহুমুখী। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সামরিক শিল্পের বেশ উন্নয়ন হয়েছে। দুই দেশের মধ্যেকার সামরিক সহযোগিতা চুক্তি অনুযায়ী ইসলামাবাদ বাকুর জন্য অস্ত্র উৎপাদন করবে। বিগত দিনে আজারবাইজানের অন্তত একশ সামরিক ইউনিটকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন পাকিস্তানের সামরিক বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে, জ¦ালানি ঘাটতি মেটাতে আজারবাইজান সহযোগিতা দেবে পাকিস্তানকে। এছাড়াও দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক, মানবিক সহযোগিতা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের চুক্তি রয়েছে।

জেএফ-১৭ থান্ডার মাল্টিরোল ফাইটার এয়ারক্রাফট কেনার ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা চলছে আজারবাইজানের। দুই দেশের সমন্বয়ে জেএফ-সেভেনটিন ব্লক থ্রি ফাইটার উৎপাদনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইসলামাবাদের কাছ থেকে সুপার মুশশাক প্রশিক্ষণ বিমান কিনতেও আগ্রহী বাকু।

আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সৈন্যরা স্বশরীরে আজারবাইজানের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়। পাকিস্তান এ বক্তব্য অস্বীকার করলেও বলেছে, ‘আজারবাইজানের নাগরিকদের ওপর আর্মেনিয়ান বাহিনীর অপ্রত্যাশিত গোলাগুলি নিন্দনীয় এবং দুর্ভাগ্যজনক। এটি পুরো অঞ্চলের শান্তি ও সুরক্ষা বিনষ্ট করতে পারে। আর তীব্রতর পরিস্থিতি এড়াতে আর্মেনিয়াকে অবশ্যই তার সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।’

পাকিস্তান বলেছে, ‘পাকিস্তান আজারবাইজানের পক্ষে সমর্থন জানাচ্ছে। আর্মেনিয়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত রেজুলেশন বারবার অগ্রাহ্য করছে।’

ইসলামাবাদ-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজ’-এর প্রধান খালিদ রহমান বললেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে একটি অঞ্চলের সঙ্ঘাতে সহায়তার আওয়াজ তোলা একটি কথা, কিন্তু যখন একটি দেশ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তখন তার পাশে কে ছিল এটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি বলেন, কাশ্মীর, সাইপ্রাস ও নাগরনো-কারাবাখের মতো জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে একে অপরকে সহায়তা করেছে তুরস্ক, পাকিস্তান ও আজারবাইজান।

এ সপ্তাহে ইসলামাবাদে তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে এটি প্রতীয়মান হয়। এক যৌথ ঘোষণায় জম্মু ও কাশ্মীরের জনতাত্ত্বিক কাঠামো পরিবর্তনের ভারতীয় তৎপরতায় উদ্বেগ জানানো হয় এবং সাইপ্রাস ইস্যু সমাধানের আহ্বান জানানো হয়।

১৯৭০-এর দশক থেকে সাইপ্রাস দ্বীপটি দুই ভাগে বিভক্ত। একটি ‘গ্রিক সাইপ্রাস’, অন্যটি ‘টার্কিশ রিপাবলিক অব নর্দার্ন সাইপ্রাস’। এ ইস্যুতে আঙ্কারার অবস্থানকে নিরঙ্কুশ মদত দিয়ে আসছে পাকিস্তান সরকার।

আজারবাইজানের সঙ্গে পাকিস্তান ও তুরস্কের সম্পর্ক নতুন নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে তার্কিকভাষী দেশ আজারবাইজানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তাদের।

১৯৯০-এর দশকের শুরুতে স্বাধীন দেশ হিসেবে আজারবাইজানকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দেশ তুরস্ক, দ্বিতীয় দেশ পাকিস্তান। একই সময়, পাকিস্তানই বিশ্বে একমাত্র দেশ, যারা আর্মেনিয়াকে স্বীকৃতি দেয়নি।

আর্মেনিয়াও এ কারণে পাকিস্তানের পিছু লেগেছিল। ২০১৬ সালে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত-উত্তর মিলিটারি ব্লক ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন’-এর পর্যবেক্ষক হওয়ার চেষ্টায় ইসলামাবাদকে প্রতিহত করে আর্মেনিয়া।

‘ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজ’-এর প্রধান বললেন, যে বিষয়টি তুরস্ক, পাকিস্তান ও আজারবাইজানকে একই বন্ধনে আসতে বাধ্য করে, সেটি হলো, তিন দেশই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। এটিই তিন পক্ষ যৌথ ঘোষণায় জোর দিয়ে বলেছে। তারা নিজেদের মূল স্বার্থগুলোতে পরস্পরকে সহায়তার নিশ্চয়তাও দিয়েছে।

আঙ্কারা এরইমধ্যে বাকুকে সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা দিয়েছে। ইসলামাবাদও চাচ্ছে তাদের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করতে।

এ মাসের শুরুতেই আজারবাইজান ও পাকিস্তানের বিমানবাহিনী প্রধানরা বৈঠক করেন। বৈঠকে যৌথ পাইলট প্রশিক্ষণ এবং সামরিক অনুশীলন নিয়ে আলোচনা হয়।

পাকিস্তান ও তুরস্কের মধ্যে তো বড়সড় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চলছেই। পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্য মিলজেম-শ্রেণির যুদ্ধজাহার তৈরি করছে তুরস্ক। পাকিস্তান থেকে ৫২টি মাশশাক প্রশিক্ষক বিমান কিনেছে আঙ্কারা।

২০১৬ সালটি ছিল তুরস্কের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বছর। একদিকে দফায় দফায় সন্ত্রাসী হামলা, অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সামারিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা। সব মিলিয়ে তুরস্ক পার করছিল এক ক্রান্তিকাল।

আর এই ক্রান্তিকালে এগিয়ে আসে পাকিস্তান। ইসলামাবাদ সরকার আঙ্কারার সহযোগিতায় পাকিস্তান সেনাপ্রধানকে সেখানে পাঠায়। সামারিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণাৎ এরদোয়ান সরকারকে সমর্থন দেয় দেশটি।

২০১৮ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্টের অবরোধের মুখে তুরস্কের মুদ্রার অধপতন শুরু হলে পাকিস্তান দেশব্যাপী তুর্কি লিরা ক্রয় অভিযান শুরু করে। এই প্রচারাভিযানে আর্থিক সমর্থনের চেয়ে মানসিক এবং নৈতিক সমর্থন বেশি গুরুত্ব পায়।

২০১৭ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী,পাকিস্তানে তুরস্কের বিনিয়োগ সাত হাজার পাঁচশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

তুরস্ক পাকিস্তানে অনেক আধুনিক হাসপাতাল পরিচালনা করছে। লাহোরের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সিক্যাব কোম্পানিগুলোর একটি তুরস্কের মালিকানাধীন। লাহোর শহরের ট্রাফিক সিস্টেম এবং ময়লা-আবর্জনা পরিচ্ছন্ন কোম্পানিও তুরস্কের। এছাড়াও দেশটির টেক্সটাইল, রাস্তা নির্মাণ এবং ভবন নির্মাণে কাজ করছে অনেক তুর্কি কোম্পানি।

সম্প্রতি তুরস্কের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি জোরলু এনার্জি হোল্ডিং পাঞ্জাবের বাহওয়ালপুর জেলায় ১০০ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন কায়েদে আজম সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করে।

কোলা কোম্পানির তুর্কি শাখা ২-৩ বছরের মধ্যে পাকিস্তানে প্রায় ১৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার ঘোষণা দেয়।

দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে বৃহৎ সামরিক সরঞ্জাম চুক্তি। এই চুক্তির আওতায় পাকিস্তান তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ৩০টি সামরিক অ্যাটাক হেলিকপ্টার ক্রয় করে। এর মূল্যমান ধরা হয় দেড় বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তান থেকে এমএফআই-১৭ সুপার মুশশাক বিমান কেনার পাশাপাশি পাকিস্তানের তিনটি সাবমেরিন আপগ্রেড এবং যৌথভাবে একটি ফ্লিট ট্যাংকার নির্মাণের চুক্তি করে তুরস্ক।

সম্প্রতি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ হয় ১৭ হাজার টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এক অত্যাধুনিক জাহাজ। তুরস্কের প্রতিরক্ষা কোম্পানি এসটিএমের সহযোগিতায় নির্মিত এই জাহাজটি পাকিস্তানে নির্মিত সর্ববৃহৎ সামরিক জাহাজ।

পাকিস্তান নৌবাহিনীকে সরবরাহের জন্য চারটি করভেট রণতরী নির্মাণের মাল্টিবিলিয়ন ডলারের টেন্ডার জিতে নেয় তুরস্কের প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান। পাঁচ বিলিয়ন ডলার বা ৪১ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা মূল্যমানের এই টেন্ডারকে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রফতানি চুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

উভয় দেশই নিজেদের মধ্যে ব্যবসা, বাণিজ্য ও সামরিক সহযোগিতার পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পর্যটন খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে বদ্ধপরিকর।

ইসলামাবাদে কদিন আগে তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যৌথ ঘোষণায় কাশ্মীর নিয়ে জোরালো বক্তব্য আসে। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের নেতিবাচক দিক আরও জোরে তুলে ধরার জন্য এ বিষয়ে আঙ্কারা ও বাকুর সমর্থন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের জন্য খুব প্রয়োজন।

এ ইস্যুতে এরদোয়ান উচ্চকণ্ঠ। গত বছরের মে মাসে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভও বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলে ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘনে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

‘ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজ’-এর প্রধান বলেন, ভারত সবসময় আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরেছে যে, কাশ্মীর ইস্যুটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু, তুরস্ক ও আজারবাইজান এ ইস্যুতে পাকিস্তানের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আওয়াজ তুলছে।

২০১৯ সালে নয়াদিল্লি একতরফাভাবে কাশ্মীরের নামমাত্র স্বায়ত্তশাসনও কেড়ে নেয়। ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যটির জনতাত্ত্বিক কাঠামো পরিবর্তনেরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি।

খালিদ রহমান বলেন, বৈশ্বিক রাজনীতিতে আজারবাইজানের বড় ভূমিকা না থাকলেও কাশ্মীর বিষয়ে দেশটির দৃঢ় অবস্থান নয়াদিল্লির জন্য নিঃসন্দেহে উদ্বেগের।

আজারবাইজান শুধু নয়, জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে তুরস্কের অবস্থানের জন্য দেশটিকে শত্রু ভাবছে ভারত। ভারত জানে, এ তিন দেশ যৌথভাবে সাম্প্রতিক সময়ে যা করেছে, তা যদি কাশ্মীরের ওপর এসে পড়ে, সামাল দেওয়া মুশকিল হবে। এখানে জড়িয়ে পড়তে পারে চীনও। চীন বলেই দিয়েছে, ভারত যেভাবে কাশ্মীরের বিশেষ আইন বাতিল করেছে, তা অবৈধ। দেশটির বক্তব্য, কাশ্মীর নিয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব স্বাধীনতার পর থেকেই। জাতিসঙ্ঘও সেখানে হস্তক্ষেপ করেছে। এ বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের চার্টার রয়েছে। ফলে এই পরিস্থিতিতে কাশ্মীর প্রসঙ্গকে অভ্যন্তরীণ বলতে পারে না ভারত।

তুরস্ক, পাকিস্তান, আজারবাইজান- তিন দেশের যুথবদ্ধ সামর্থ্য পরক করেছে বিশ্ব। এখন তাদের সামনের অভিযান কোথায় গিয়ে থামবে, সময়ই বলবে।