কীভাবে এত শক্তিশালী ইরান


  • মুরশিদুল আলম চৌধুরী
  • ১৩ জানুয়ারি ২০২১, ১২:১৯

ইরানি বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদে হত্যায় সন্দেহাতীতভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিল ইরান। ইরান কর্তৃপক্ষ এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরাইলকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল এবং দ্রুত প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। দেশটির অভ্যন্তরে ইসরাইলি বন্দর হাইফায় হামলার দাবিও উঠেছিল। তবে এ দাবি পূরণ আপাতত সমীচীন মনে করেনি দেশটি।

দৃশ্যত, ইসরাইল ও তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাতে যাওয়া সমীচীন মনে করছে না ইরান। ইরান জানে, ইসরাইলি কিংবা মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করলে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ বেঁধে যাবে। এ যুদ্ধের জন্য হয়তো এখনই প্রস্তুত নয় দেশটি। তবে এটা পরিষ্কার যে, যুদ্ধ বেঁধে গেলে সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে এ অঞ্চলের মার্কিন মিত্ররা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেটা হয়েছেও।

তেলের বাজারে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে অগ্রাধিকার দিতে হচ্ছে- এসব বিষয় সামনে রেখে উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব দেশগুলো এ সময় সম্ভাব্য সঙ্ঘাতে নিজেদের অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে। এ কারণেই সংযুক্ত আরব আমিরাত বেশ তড়িঘড়ি করে ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী হত্যার নিন্দা জানিয়েছে। অথচ, দেশটি সম্প্রতি ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছে এবং তারা এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।

আরব আমিরাতের ভয়ের কারণও আছে। ইয়েমেনে ইরানের মদতপুষ্ট হুতিরা গ্রীষ্মের শুরুতে আবুধাবির ঘনিষ্ঠ বন্ধু সৌদি আরবের অবকাঠামোগুলোতে হামলা শুরু করেন। জুন ও জুলাইয়ে তারা রিয়াদের সামরিক স্থাপনাগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালান। দক্ষিণের প্রদেশ জিজান, আসির ও নাজরানের বেশকিছু লক্ষ্যবস্তুতে পড়েছে হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র।

নভেম্বরে অন্তত তিনটি হামলা হয়েছে। জিজানে সৌদির রেড সি বন্দরের তেল স্থাপনাগুলোতে হুতিদের হামলায় বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেদ্দার তেল সরবরাহ ফ্যাসিলিটিতে মিসাইল হামলা হয়েছে। এর পরপরই শুকাইক বন্দরে তেল সরবরাহকারী একটি ট্যাঙ্কারে আঘাত হানে হুতিদের মাইন।

হুতিরা যেসব এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন, তার বেশ দূরে অবস্থিত আরব সাগরের এসব বন্দর। সেখানে হামলার মাধ্যমে তারা জানিয়ে দিয়েছেন, আরব উপত্যকার যে কোনো জায়গায় হামলা করার সক্ষমতা রয়েছে তাদের। সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলে আবকাইক এবং খুরাইসে আরামকো তেল অবকাঠামোতে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বড়সড় হামলা চালিয়েছিলেন হুতিরা। সেখানে প্রতিদিন প্রায় ৫৭ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদিত হয়। সাম্প্রতিক হামলাগুলোর মাধ্যমে তারা হয়তো সতর্ক করেছেন যে, ইরানের স্বার্থে আঘাত এলে এ ধরনের হামলা আরও হতে পারে।

হামলার সময়টাও বেশ অর্থবহ। রিয়াদ, তেলাআবিব ও ওয়াশিংটনের মধ্যে যখন বেশ জোরোশোরে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছিল, তখনই একাধারে তিনটি হামলা হলো। যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ি ট্রাম্প প্রশাসন যখন ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাচ্ছে বলে জল্পনা-কল্পনা চলছিল, তখনই মুহূর্মুহু হামলায় কেঁপে ওঠে সৌদি আরবের বিভিন্ন অঞ্চল।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অবকাঠামোয় হামলার এ কৌশল ইরান রপ্ত করেছে বেশি দিন হয়নি। কয়েক বছর আগেও তারা উপসাগর থেকে তেল রফতানি ব্যাহত করতে হরমুজ প্রণালী বন্ধের হুমকি দিতেন। মনে হতো, তারা নিজেরাই হয়তো প্রণালী বন্ধ করতে চাচ্ছেন না, অথবা তারা সেটা পারবেনও না।

ইরানসহ বিশে^র তেল রফতানির ২০ শতাংশেরও বেশি এ প্রণালী দিয়েই হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ শক্তিধর দেশগুলো এ তেল আমদানি করে। তারা উপসাগরীয় অঞ্চলকে নিরাপদ করতে এবং তেলের জাহাজ চলাচলে বড় ধরনের ব্যাঘাত প্রতিহত করতে পদক্ষেপ নেন। ইরান হরমুজ প্রণালীতে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিলে যুদ্ধ বাঁধার ঝুঁকি ছিল। যে কারণে এ পদক্ষেপ এড়িয়ে গিয়েছিল ইরান।

কিন্তু, গত দুই বছরে পরিস্থিতি বদলেছে। প্রথমত, আরব বসন্তের প্রেক্ষাপট এবং ২০১৪ সালে হুতিরা সানায় কর্তৃত্ব গ্রহণের পর ইয়েমেনে ইরানের শক্ত অবস্থান তৈরি হয়। এতে উপসাগরীয় দেশগুলোর ওপর সার্বিকভাবে তাদের প্রভাব আরও বাড়ে। দ্বিতীয়ত, এ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল উৎপাদন অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। এতে যুক্তরাষ্ট্র কেবল অন্যতম প্রধান তেল রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়নি, বিশ^বাজারে তেলের স্থিতিশীল সরবরাহও নিশ্চিত হয়েছে।

প্রসঙ্গত, তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর তালিকার শীর্ষে এখন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের দৈনিক উৎপাদন ১ কোটি ৯৫ লাখ ব্যারেল। যুক্তরাষ্ট্র ছয় বছর ধরে এ শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। বিশে^র তেল উৎপাদনের ১৯ শতাংশ হয় যুক্তরাষ্ট্রে। অন্যদিকে, সৌদি আরবের দৈনিক উৎপাদন ১ কোটি ৬২ লাখ ব্যারেল। ২০১২ সালে রাশিয়াকে টপকে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৩ সালে সৌদি আরবকে পেছনে ফেলে শীর্ষস্থান অর্জন করে দেশটি। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সৌদি আরব, তৃতীয় স্থানে রাশিয়া, চতুর্থ স্থানে কানাডা ও পঞ্চম স্থানে চীন।

যুক্তরাষ্ট্রে তেলের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সংকটও তেলের ভোক্তাদের উদ্বেগ তেমন বাড়ায়নি। উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১৮-১৯ সালে লিবিয়ায় তেল উৎপাদনে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়নি, বাজারে ইরান ও ভেনিজুয়েলার অনুপস্থিতির কারণে তেলের দামে সৃষ্ট সংকট স্থায়ী হয়নি।

এমনকি, ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে সৌদি তেল স্থাপনাগুলোতে হামলায় তেল উৎপাদনে ক্ষতির আকার নজিরবিহীন হলেও তাতে স্বল্পমেয়াদি প্রভাব পড়েছে।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, উপসাগরের ওপর নির্ভরতা কমে যাওয়ায় ইরানি হামলাগুলোর পর শক্ত কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত ছিল যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সহায়তা কামনার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল জোসেফ ডানফোর্ড পরিষ্কার করেছিলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনাসংখ্যা বাড়ানো এবং সৌদি আরবে নতুন অস্ত্রের ব্যবস্থা করা হলেও দেশটির তেল অবকাঠামো নিরাপদ হবে, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।

এরপর তেল উৎপাদন এবং নিজেদের রক্ষায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে উপসাগরীয় দেশগুলো নিজেদের একাই ভাবতে শুরু করে। এক সময় তেল উৎপাদন কমানোর জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরবকে হুমকি দেন। এ হুমকিতে তাদেরকে মার্কিন তেল উৎপাদনকারীদের সঙ্গে সমন্বয় করে তেল উৎপাদন কমাতে হয়েছিল।

এর তিন মাস পর, ইরাকি ঘাঁটিতে এক হামলায় ইরান-ঘনিষ্ঠদের হাতে যখন মার্কিন ঠিকাদার নিহত হন, যুক্তরাষ্ট্র বসে থাকেনি। ২০২০ সালের জানুয়ারির শুরুতে বাগদাদের কাছে ইরানের ইসলামিক রেভোলুশনারি গার্ডের শীর্ষ কমান্ডার কাশেম সুলাইমানি মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন।

যুক্তরাষ্ট্র যেটা দেখিয়েছে, সেটা হলো, তারা মধ্যপ্রাচ্যে কিছু ‘রেড লাইন’ দিয়ে রেখেছেন, যেটা ইরানকে অতিক্রম করতে দেওয়া হবে না। মিত্রদের তেল অবকাঠামোর কী হলো সেটা বড় কথা নয়, মার্কিন সৈন্যদের জীবন নিয়েই তারা উদ্বিগ্ন। নিজেদের স্বার্থ বিঘ্নিত হলে ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসী পদক্ষেপ নেবে যুক্তরাষ্ট্র। এ পদক্ষেপে এটা মনে করার সুযোগ নেই যে, তেহরানের প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে উপসাগরীয় দেশগুলোকে রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত।

উপসাগরের তেল রক্ষায় সামরিক সম্পদ ব্যয়ে ওয়াশিংটনের অনাগ্রহের ফলে অনেকটা ছাড়পত্র পেয়ে গেছে তেহরান। তারা তেলের খনিতে হামলা করছেন, এ হামলা বাড়ছেও। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কিছুই করছে না। এর ফলে আঞ্চলিক তেল উৎপাদনকারীরা সময়টাকে বেশ কঠিন মনে করছেন।

নিজ দেশে তেল বিপ্লবের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের তেলের তৃষ্ণা মিটে গেছে। সঙ্গে হানা দিয়েছে করোনাভাইরাস মহামারি। এতে উপসাগরীয় রাজকোষের আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। মার্কেট শেয়ার নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে তাদের। এ প্রেক্ষাপটে, তেল উৎপাদনে ব্যাঘাত এলে উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য বেশ দুঃখজনক হবে।

অন্যদিকে, তেহরান তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে। জুনে ইরান সরকার ১১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘গৌরেহ-জাস্ক পাইপলাইনের’ নির্মাণকাজ শুরু করেছে। এ পাইপলাইনের কারণে হরমুজ প্রণালী এড়াতে পারবে দেশটি। দেশটির অবস্থান এতই শক্ত যে, মার্কিন অবরোধের পরও তাদেরকে তেলের বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি।

এরই মধ্যে, তেহরানের শক্তি পেয়ে হুতিরা লোহিত সাগরের ট্রানজিট রুট এবং তেলক্ষেত্রগুলোতে হামলা করে সক্ষমতা দেখিয়েছে। তার মানে, তেল অবকাঠামোগুলোর উন্নয়ন সাধন করলেও তারা হরমুজ প্রণালীর ওপর আর হয়তো নির্ভর করতে পারবেন না। এখন তাদের তেল রফতানি আর নিরাপদ নয়।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, মার্কিন তেল বিপ্লবই পরোক্ষভাবে উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরানের হাতকে মজবুত করেছে। এখানকার তেলের প্রতি নির্ভরশীলতা কমায় ইরানের বিরুদ্ধে নতুন আরব-চক্র গঠন করেও তেমন ফল আসবে না। এখন আরব রাজতন্ত্রের ওপর ছড়ি ঘোরাতে তেহরান শতভাগ সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন যখন মিলবে না, তখন মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সামর্থ্যকে চ্যালেঞ্জ করবে কে?