ভয়ঙ্কর ট্রাম্পের শেষ বার্তা : যুক্তরাষ্ট্রের দুই পিঠ

-

  • মোতালেব জামালী
  • ১১ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৫০

অবশেষে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাত থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আগামী ১৯ জানুয়ারি তিনি হোয়াইট হাউস ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরিডায় নিজের বাড়িতে চলে যাবেন। ২০ জানুয়ারি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও তিনি উপস্থিত থাকবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। ক্যাপিটল হিল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় সহিংসতা ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতার মেয়াদ। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, অস্ত্র বা পেশি শক্তি দিয়ে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা রোধ করা যায় না।

৬ জানুয়ারি গোটা বিশ^ ক্যাপিটল হিলে উগ্র ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার যে চিত্র দেখেছে, সেটাই যুক্তরাষ্ট্রের আসল চেহারা নয়। গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার চেহারা মার্কিন কংগ্রেস বিশ^বাসীকে আবার দেখিয়ে দিয়েছে। ট্রাম্প বিদায় নেওয়ার আগে গত বছর ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কারচুপির মিথ্যা অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে কলঙ্কিত করেছেন। জো বাইডেনের বিজয়কে চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে বা সত্যায়ন করতে ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসিতে পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে কংগ্রেসের উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশন চলাকালে নিজের উগ্র সমর্থকদের দিয়ে সশস্ত্র হামলা করিয়ে তিনি চিরদিনের জন্য দেশটির ইতিহাসে একজন খলনায়ক হিসেবে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করে গেলেন।

৬ জানুয়ারির এই হামলা রাশিয়ার সাইবার হামলাকারীচক্র, চীনা গোয়েন্দা বাহিনী কিংবা তথাকথিত জিহাদি গোষ্ঠির যড়যন্ত্রের ফসল নয়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট তার সমর্থকদের উস্কে দিয়ে এই হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন যা যুক্তরাষ্ট্রের ২৩০ বছরের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে নজীরবিহীন।

ট্রাম্পের উগ্র ও বর্ণবাদী চরিত্রের মাত্রা সম্পর্কে সবাই ধারণা পেয়েছিল। কিন্তু রিপাবলিকান নেতৃত্ব তাকে আমলে নেয়নি। তারা ট্রাম্পের পাশেই থেকেছেন। সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মিচ ম্যাককনেলসহ বহু জ্যেষ্ঠ নেতা ট্রাম্পের পক্ষে শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন। এখন তাঁরা সটকে পড়ছেন। ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অনেকেই নৈতিকতা-গণতন্ত্র ইত্যাদি নানা বিষয়ের উল্লেখ করে ট্রাম্পের সঙ্গ ত্যাগ করছেন। রিপাবলিকান নেতাদের অদূরদর্শী ও ক্ষমতার মোহই দানবকে পুষে বড় করেছে। আগামী কয়েক বছর এর দায় শোধ করতে হবে দলটিকে।

ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার আগে ট্রাম্প যাতে তার প্রেসিডেন্টে ক্ষমতা ব্যবহার করে বড় ধরনের কোনো অঘটন ঘটিয়ে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে নিতে না পারেন সেজন্য সতর্ক রয়েছেন শীর্ষস্থানীয় ডেমোক্রেট নেতা ও উর্ধতন সামরিক কর্মকর্তারা। সিএনএনের এক খবরে বলা হয়েছে, স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও পরমানু অস্ত্র ব্যবহারের কোড নিয়ে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর জয়েন্ট চীফস অব ষ্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলির সাথে কথা বলেছেন। তার সাথে আলোচনায় আগাম সর্তকতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেন যাতে ট্রাম্প সামরিক বাহিনী ও পরমানু অস্ত্রের কোনো অপব্যবহার করতে না পারেন।

২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর থেকেই ক্ষমতার দম্ভে ট্রাম্পছিলেন অন্ধ। যখন যা মন চেয়েছে তাই করেছেন। প্রশাসনকে সব সময় তার পরিবার কেন্দ্রিক রাখতে চেয়েছেন। ট্রাম্প কখনোই কারও পরামর্শ শুনতেন না। কূটনীতি বলে যে একটা কিছু আছে তা তিনি মনেই করতেন না। মুখে যা আসতো তাই বলে দিতেন। এ কারণে শুরু থেকেই তিনি ছিলেন বিতর্কিত। কাউকে কখনোই সম্মান করেননি। এমনকি খুব কাছের লোকজনও তার কাছে থেকে প্রাপ্য সম্মানটুকু পাননি। মিডিয়ায় নিজের সমালোচনা কোনোভাবেই বরদাস্ত করতেন না। এজন্য তার বশংবদ হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া আর সব সংবাদ মাধ্যমের উপর তিনি ছিলেন ক্ষিপ্ত। সমালোচক সংবাদমাধ্যমকে তিনি নিজের পক্ষে আনতে নানা ভাবে চাপ সৃষ্টি করতেন। কিন্তু মার্কিন মিডিয়া তার কাছে কখনো আত্মসমর্পণ করেনি।

গত বছর ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হয়েও কারচুপি করে তাকে হারানোর মিথ্যা অভিযোগ তুলে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সব কিছুই করেছেন ট্রাম্প। বলে আসছিলেন কোনো অবস্থাতেই তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। আইনী লড়াইয়ে হেরে যাবার পর সামরিক আইন জারি করারও হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। এর পর ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট বা কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে নিজের উগ্র সমর্থকদেরকে দিয়ে হামলাও করালেন। কিন্তু কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত তাকে থামিয়ে দিয়েছে। ট্রাম্প সমর্থকদের সশস্ত্র হামলার মুখেও নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থেকে কংগ্রেস নিবাচনে বিজয়ী ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেনের বিজয়কে অনুমোদন বা সত্যায়ন করেছে। এতে শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও নির্বাচনব্যবস্থা। আর পরাজিত হয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা, উগ্র বর্ণবাদী ও অগণতান্ত্রিক মানসিকতার।

যুক্তরাষ্ট্রের বিগত ২৩০ বছরের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে এমন ভয়ঙ্কর, স্বেচ্ছাচারি, পাগলাটে, বদমেজাজি ও কলংকিত চরিত্রের প্রেসিডেন্ট আর কখনো আসেননি ক্ষমতায়। দেশের জনগণের রায়ের উপর ওপর ট্রাম্পের আস্থা ছিল না। অথচ ২০১৬ সালে ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েও হিলারি ক্লিনটন তার কাছে হেরে গিয়ে পরাজয় মেনে নিয়েছিলেন। এর আগে আরেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আল গোরও একই নজির স্থাপন করেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প এসবের মধ্যে নেই।

কয়েক সপ্তাহ ধরেই ট্রাম্প বলে আসছিলেন যে ৬ জানুয়ারি হতে যাচ্ছে ‘বোঝাপড়ার দিন’। তিনি তার সমর্থকদের বলেছিলেন তারা যেন রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে সমবেত হয় এবং কংগ্রেস ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে চ্যালেঞ্জ জানায়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী সারা দেশ থেকে তার উগ্র সমর্থকদের জড়ো করেন। এর আগে তিনি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করলেন সমর্থকদের কাছ থেকে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করেছিলেন ট্রাম্প। তারই ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে জিম্মি করে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভোটের ফল অনুমোদন প্রক্রিয়া থামাতে চেয়েছিলেন। এতে সফল হতে পারলে তিনি ক্ষমতায় থেকে যেতে পারতেন। কিন্তু মাইক পেন্স তার পরিকল্পনায় রাজী হননি কখনো। তিনি ট্রাম্পকে স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন যে, তিনি জো বাইডেনের বিজয় অনুমোদন ঠেকাতে পারবেন না। সে ক্ষমতা তার নেই। এরপরই ট্রাম্প টুইট করে বলেছেন, ‘ওর সাহস নেই।’ কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে যে, ট্রাম্প কি নিজে থেকেই কংগ্রেস ভবনে হামলা করে জো বাইডেনের বিজয় ঠেকাতে চেয়েছিলেন, এই ছক তৈরি করেছিলেন? নাকি কেউ এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল।

ট্রাম্পের সমর্থকেরা যেভাবে কংগ্রেস ভবনে ঢুকে হামলা চালিয়েছে, পুলিশের সঙ্গে দাঙ্গায় জড়িয়েছে, তাতে মার্কিন রাজনীতিবিদ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সাবেক কর্মকর্তারা নিরাপত্তা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কীভাবে পুলিশ কংগ্রেসে ওই হামলা চালাতে দিতে পারল, সেটি ভেবে সাধারণ মার্কিনদের মতো তাঁদের মনেও জন্ম নিয়েছে নানা প্রশ্নের।

এই অবিশ্বাস্য ঘটনায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে ক্যাপিটল পুলিশ। অথচ সুরক্ষিত কংগ্রেস ভবনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন এ বাহিনীর দুই হাজার সদস্য। ওই ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত কিছু ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, দাঙ্গাকারীরা যখন ভবনে ঢুকছিলেন, তখন কিছু কিছু পুলিশ সদস্য ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। নজিরবিহীন তান্ডব চালানোর পরও ট্রাম্পের সমর্থকদের নির্বিঘ্নে ভবন ত্যাগ করতে দেখা গেছে।

পুলিশের এই ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক কংগ্রেস সদস্য। নবনির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য মনডেয়ার জোনস ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়ে বলেছেন, এই দাঙ্গাকারীরা যদি কৃষ্ণাঙ্গ হতো, তবে তাঁদের ক্যাপিটলে ঢোকার আগেই গুলি করে মাটিতে ফেলে দেওয়া হতো। কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডকে শ্বাসরোধ করে হত্যার ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে গত বছর বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই সময় পুলিশ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও লাঠিপেটা করেছে। গণগ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ে হামলাকারীদের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকার পাশাপাশি ছিল ভারতের জাতীয় পতাকা। যা অনেকের কাছে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও এসেছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ের সামনে প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্পের ছবি নিয়ে জড়ো হয়েছেন তার সমর্থকরা। সেখানে একজনের হাতে রয়েছে ভারতের জাতীয় পতাকা। এরপরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন লিখেছেন, ‘এখানে ভারতীয় পতাকার উপস্থিতি অত্যন্ত বিরক্তিকর। এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্রের ভারতীয় অভিবাসীদের কাছে আপ কি বার ট্রাম্প সরকার। বলে ট্রাম্পের পক্ষে প্রচারনা চালিয়েছিলেন। ভারতের উগ্র রাজনীতির সমর্থকরা সেখানেও সমবেত হয়েছিলেন।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের জাতীয় পতাকার পাশাপাশি ‘কনফেডারেট’ পতাকা। ১৮৬১ সালে ক্রীতদাস প্রথার সমর্থক ১১টি রাজ্য আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘কনফেডারেট স্টেটস’ গঠন করেছিল। দীর্ঘ চার বছর গৃহযুদ্ধের পরে ‘কনফেডারেট স্টেটস’কে পরাজিত করে আমেরিকাকে ফের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন। দুর্ভাগ্য হচ্ছে দাসপ্রথা বিরোধী লিঙ্কনের দল রিপাবলিকান পার্টিরই নেতা এখন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

প্রতিনিধির পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ও সিনেটের সংখ্যালঘু দলের নেতা চাক শুমার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তিনি যেন সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী প্রয়োগ করে ট্রাম্পকে ক্ষমতা তেকে অপসারণ করেন। এই পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ট্রাম্পকে অভিশংসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন এই দুই নেতা। তবে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারনে তা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।