তুরস্ক কেন বেছে নিয়েছে চীনের টিকা

-

  • সরোয়ার আলম
  • ১০ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৪৫

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে তুরস্কে করোনা ভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরু হবে। প্রথমে স্বাস্থ্যকর্মীরা এবং ঝুঁকিপূর্ণ লোকেরা এই টিকা পাবেন। পরে ধীরে ধীরে সমাজের সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। করোনার টিকা নিয়ে মানুষের মাঝে আগ্রহের সাথে সন্দেহও বিরাজ করছে। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে তা হলো, কোন দেশের টিকা ব্যাবহার করবে তুরস্ক? যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি নাকি চীন? আর কোন টিকা ব্যবহার কতটা নিরাপদ? করোনার টিকা নিয়ে অনেক দেশে এমন প্রশ্ন সামনে আসছে।

তুরস্ক খুব শীঘ্রই চীনের কোম্পানি সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেডের তৈরি টিকা ব্যাবহার শুরু করবে। পরবর্তীতে জার্মান প্রবাসী দুই তুর্কি বিজ্ঞানীর আবিষ্কার করা এবং বায়োটেক-ফাইজার কোম্পানির তৈরি টিকাও ব্যাবহার করবে দেশটি। তবে তুরস্কে আমেরিকার মডার্নার বা ব্রিটিশ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ব্যবহার করা হবে না বলেই জানিয়ে দিয়েছে সরকার।

করোনার টিকা হিসেবে আপাতত মেইড ইন চায়না-ই হচ্ছে তুরস্কের একমাত্র ভরসা। ইতোমধ্যে চীন থেকে ৩০ লাখ সিনোভ্যাক টিকা এসে পৌঁছেছে তুরস্কে। এখন চলছে এই টিকাগুলোর বিভিন্ন নিরাপত্তা পরীক্ষা। যেমন এই টিকাগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের ক্ষতিকারক কোনো উপাদান আছে কিনা। টিকার বাক্সগুলো থেকে কিছু টিকা নিয়ে এই ধরনের অনেকগুলো পরীক্ষা চালানো হবে। এই পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যাবে ১৪-১৭ দিনের মধ্যে। পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল পেলে তুরস্কের ঔষধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এগুলো ব্যাবহারের অনুমতি দেবে।

তুরস্কের সাধারণ মানুষ এমনকি সুশীল সমাজেরও অনেকেই চীনের তৈরি টিকার বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন। কারণ, দেশটিতে অনেকে মাঝে এমন ধারণা আছে “মেইড ইন চায়না” মানেই নকল বা ভেজাল।

প্রশ্ন হচ্ছে সাধারণ মানুষের সন্দেহ ও অবিশ্বাসের পরও তুরস্কের সরকার কেন চীনের তৈরি টিকা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে? এর পেছনে কী কোনো বিশেষ কারন আছে ? না কি সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তুরস্ক সরকার এমন পদক্ষেপ নিয়েছে? আসুন জেনে নেই সে সর্ম্পকে কিছু তথ্য।

মানুষের স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে টিকার উৎপাদনকারী দেশ বিবেচনায় আসে না। উৎপাদনকারী দেশ যত উন্নত বা অনুন্নত হোক না কেন, টিকার উৎপাদন পদ্ধতি, কার্যকারিতা, সহজলভ্যতা, পরিবহন এবং সংরক্ষনের সুবিধার মতো দিক গুলো বিবেচনায় নিতে হয়। এসব বিবেচনায় চীনের টিকা অন্যগুলোর থেকে বেশ সুবিধাজনক পর্যায়ে রয়েছে।

যেমন চীনের টিকায় সনাতন পদ্ধতি ব্যাবহার করা হয়েছে যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম। চীনের কোম্পানিটি তুরস্কের চাহিদা মতো পরিমাণের টিকা দিতে প্রস্তুত রয়েছে। চীনের টিকা পরিবহন এবং রক্ষণাবেক্ষণ অন্যগুলোর চেয়ে সহজ। ইতিমধ্যে তুরস্ক কয়েক হাজার লোকের উপর এই টিকার পরিক্ষামুলক প্রয়োগ করে সফলতা পেয়েছে।

তুরস্ক জার্মান-আমেরিকান কোম্পানি বায়োএনটেক - ফাইজার থেকেও টিকা কেনার চুক্তি করেছে। তবে এই কোম্পানিটি যথেষ্ট পরিমাণে টিকা সরবরাহ করতে পারবে না।

তুরস্কের ৮ কোটি লোকের অন্তত ৫ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। প্রতি জোনকে ২ ডোজ করে টিকা দেওয়া দরকার। সে হিসেবে কমপক্ষে ১০ কোটি ডোজ টিকা দরকার। চীনের কোম্পানিটির সাথে ৫ কোটি ডোজের চুক্তি হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে আশার কথা ছিল ২ কোটি ডোজ কিন্তু এসেছে ৩০ লক্ষ ডোজ। বাকিগুলো ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধাপে ধাপে আসবে।

এছাড়াও বায়োএনটেক- ফাইজারের কাছ থেকে আড়াই কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করেছে তুরস্ক। কিন্তু ফাইজার- বায়োএনটেক বর্তমানে শুধুমাত্র ১০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করতে পারবে। এর বেশি পারবে না। বাকি ডোজগুলো তুরস্কে আসতে এ বছরের পুরোটা লেগে যাবে।

ঘাটতি পূরণে তুরস্ক বায়োএনটেক-এর সাথে চুক্তি করে এদেশেই তাদের টিকা উৎপাদন করতে চাচ্ছে। এ নিয়ে আলোচনাও চলছে। খুব শীঘ্রই চুক্তি হতে পারে। এছাড়াও তুরস্ক রাশিয়ার স্পুটনিক-৫ টিকা কেনারও চিন্তা করছে। এখন প্রশ্ন হলো তুরস্ক কী নিজেদের টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা আছে? থাকলে তাতে কতটা অগ্রগতি হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদিত টিকা নিয়ে কি ভাবছে তুরস্ক আসুন জেনে নেই সে সর্ম্পকে কিছু তথ্য

আগামী এপ্রিল মাসে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি টিকাও বাজারে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে তুরস্ক। তবে সে টিকার এখনও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা চলছে। এর পরে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা। এই সবগুলো ধাপ সফলভাবে পার হওয়ার পরই বাজারে আসবে এই দেশি টিকা।

তুরস্ক আমেরিকার মডার্নার কাছ থেকেও টিকা নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিল কিন্তু ওই কোম্পানির আমারিকার বাইরে টিকা বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। আর অক্সফোর্ডের টিকার কার্যকারিতা নিয়ে এখনও সন্দিহান তুরস্কের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাই তাদের কাছ থেকে টিকা কেনার আপাতত কোনও পরিকল্পনা নেই।স্বাভাবিকভাবে দ্রুত টিকার দেয়ার কার্যক্রম শুরু করতে হলে চীনের টিকার ওপর নির্ভর করতে হবে। এছাড়া বায়োএনটেক ও ফাইজারের টিকা পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তুরস্ক।

টিকা পাওয়ার পাশাপাশি টিকা দেয়ার প্রক্রিয়া খুব সহজ নয়। কারন বিপুল সংখ্যক মানুষকে এই কর্মসূচীর আওতায় আনতে হবে। ফলে যে কোনো সরকারের জন্য সুষ্টুভাবে টিকা দেয়ার কর্মসূচী পালনও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। আসুন জেনে নেই তুরস্ক কিভাবে এই টিকাদান কর্মসূচী পালন করতে যাচ্ছে।

তুরস্কের সরকার এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো আগে থেকেই তৈরি করে রাখা হয়েছে টিকার জন্য। প্রস্তুত রাখা হয়েছে চীনের টিকার জন্য ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ফ্রিজ আর ফাইজারের টিকার জন্য মাইনাস ৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ফ্রিজ।

সকল সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি প্রস্তুত থাকবে ২৭ হাজার “পরিবার স্বাস্থ্য কেন্দ্র”। প্রতি মহল্লায় মহল্লায় আছে এই পরিবার স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলো। সব পরিবারই কোন না কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিবন্ধিত। এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যদি প্রতিদিন শুধু মাত্র ১০ জন লোকেকেও টিকা দেওয়া হয় তাতেও দৈনিক দুই লাখ ৭০ হাজার লোককে টিকা দিতে পারবে।

সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল গুলো এই হিসেরে বাইরে রাখা হয়েছে। এছাড়াও সব সরকারি এবং বেসরকারি অফিসে আছে কমপক্ষে একজন করে ডাক্তার এবং নার্স আর একটি “স্বাস্থ্য কক্ষ। অফিস কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে তাদের কর্মচারীদের জন্য অফিসেও টিকাদান কর্মসূচি চালু করতে পারে। দেখা যাচ্ছে তুরস্কের বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা এই সার্বজনীন টিকাদান কর্মসূচি সফলভাবে সম্পন্ন করতে যথেষ্ট।