যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী

-

  • মুরশিদুল আলম চৌধুরী
  • ০৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:০৩

রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কেনায় তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এস-৪০০ কেনার পর গত এক বছর ধরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে তুরস্কের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল ট্রাম্প প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, রাশিয়ার ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা ন্যাটোর নীতিবিরোধী ও ইউরো-আটলান্টিক জোটের জন্য হুমকিস্বরূপ।

তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি ভারতসহ কয়েকটি দেশকে রাশিয়ার তৈরি অস্ত্র কেনার বিষয়ে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে একাধিকবার জানিয়েছে, তারা যদি এস-৪০০ সিস্টেম কেনেন, তা মার্কিন সামরিক প্রযুক্তি ও কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তার কারণ হবে। তুরস্কের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে ও প্রতিরক্ষা শিল্পে রাশিয়া ঢুকে যাবে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা খাতে প্রচুর অর্থ চলে যাবে।’

এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী? বিশ্ব রাজনীতিতে এ প্রশ্ন এখন প্রবলভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাহলে কি নতুন মার্কিন নেতৃত্বের অধীনে ওয়াশিংটন-আঙ্কারা সম্পর্ক মসৃণ না হয়ে আরও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ হতে যাচ্ছে?

মার্কিন নির্বাচনের ফল পরিষ্কার হওয়ার পর থেকে সাদামাঠা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, ট্রাম্প যতটা না আগ্রাসী ছিলেন, জো বাইডেন এরদোয়ানের প্রতি আক্রমণাত্মক হবেন তার চেয়ে বেশি । তার প্রতি বাইডেনের নীতি হবে পূর্বসুরীর চেয়েও কম সহনশীল। এরদোয়ানের অবস্থান এর উল্টো। এখন পর্যন্ত যেসব ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, এরদোয়ান নতুন মার্কিন প্রশাসনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন এবং দুই শক্তিধর দেশের মধ্যেকার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করার চেষ্টা করবেন।

সন্দেহ নেই, ট্রাম্পের মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি একেবারে নতুন একটা অবয়ব নিয়েছে। তিনি যখন ন্যাটোকে ‘সেকেলে’ বলে সম্বোধন করেছিলেন, তখন বেশ উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল। বোঝা গিয়েছিল, তিনি ধীরে ধীরে জোট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কমিয়ে আনবেন।

বিশ্বময় স্থিতিশীলতা রক্ষার নামে নাক গলাত যুক্তরাষ্ট্র। গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা হিসেবে আনাচে-কানাচে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তারা। ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ভূমিকা সীমাবদ্ধ করে আনলেন এবং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ মতবাদ অনুশীলন করতে থাকলেন, তখনই এ সার্বজনীন চরিত্রে মৌলিক পরিবর্তন আসতে থাকে।

২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প অঙ্গীকার করেছিলেন যে, দেশের বাইরে আর কোনো মার্কিন সামরিক অভিযান পরিচালিত হবে না। তিনি অঙ্গীকার অনুযায়ী চলেছেন। মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব-ভূমধ্যসাগরে চলমান সঙ্ঘাত ও বির্তকে মার্কিন ভূমিকা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনেন তিনি। অবশ্য, আরব-ইসরাইল সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে একেবারে ব্যতিক্রম ছিলেন ট্রাম্প।

এর ফলে লিবিয়া ও সিরিয়া সঙ্ঘাত, আজেরি-আর্মেনিয়ান যুদ্ধ এবং গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যেকার কূটনৈতিক অচলাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। এসব স্থানে দেশটির অনাগ্রহের ফলে ভূরাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়। এতে ধীরে ধীরে প্রভাব বাড়াতে সক্ষম হয় রাশিয়া ও তুরস্ক।

একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্কে আলাদা মাত্রা আসে। ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যেকার বিশেষ সম্পর্কের কারণে মস্কো ও ওয়াশিংটন সম্পর্কও নতুন জীবন পায়। দুই শক্তিধর দেশের মধ্যে নতুন যুগের সূচনার আভাস মেলে।

ট্রাম্পের মেয়াদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বেশকিছু অবরোধের পদক্ষেপ এলেও ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলোতে ভয়ঙ্কর কোনো প্রভাব পড়েনি এবং এসব ইস্যু জোরেশোরে মাথাছাড়াও দেয়নি। বরং, ট্রাম্প খোলামেলাভাবেই রাশিয়ার আন্তর্জাতিক প্রভাব বৃদ্ধিকে মেনে নিয়েছেন।

ট্রাম্প বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোতে সামরিক শক্তি বাড়ানোর বিষয় এড়িয়ে গেছেন এবং ক্রেমলিনের সঙ্গে সার্বিক সম্পর্ক বেশ সতর্কতার সঙ্গে পরিচালিত করেছেন। ট্রাম্পের বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা সন্দেহাতীতভাবে আবর্তিত হয়েছে চীনকে ঘিরে। মূলত, চীনের উল্লম্ফন এবং রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়টি মাথাব্যথার কারণ হয়েছিল ট্রাম্পের।

পূর্ব-ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রকৃতপক্ষে শান্তশিষ্ট ছিলেন ট্রাম্প। অবশ্য, বিষয়টা কারও এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না যে, কিছু বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তও নিয়েছেন তিনি। আমরা ২০১৮ সালের আগস্টে ধর্মযাজক ব্রানসনকে আটক করার পর মার্কিন প্রতিক্রিয়ার কথা মনে করতে পারি। তখন প্রথমবারের মতো দুই সরকারি মন্ত্রীসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তুরস্কে দুই বছর ধরে ওই মার্কিন ধর্মযাজককে আটক রাখা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনা হয়, যা মার্কিন কর্তৃপক্ষ ভিত্তিহীন বলে বর্ণনা করে। যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো জোটভুক্ত কোনো মিত্র দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে, এ ধরনের ঘটনা চিন্তাই করা হয়নি। ব্রানসনের বিরুদ্ধে তুরস্কের অভিযোগ, তিনি কুর্দি বিদ্রোহী দলকে সমর্থন করেন, যারা তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করা হয়।

এছাড়াও, কিছু তুর্কি আমদানিপণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে দেন ট্রাম্প। তুর্কি অর্থনীতির সূচক যখন নিম্নমুখী, তখন এ সিদ্ধান্তকে বেশ কঠোর হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। গত আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে তুর্কি লিরার মান উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার আগে নিষেধাজ্ঞাসহ এ ধরনের পদক্ষেপগুলোতে বোঝা যায় যে, তুরস্কের ব্যাপারে ট্রাম্পের নীতি মাঝেমধ্যে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছিল।

রুশ ফ্যাক্টর যদি সামনে আনি, বলতে হবে, বাইডেনের মনোভাব তাদের ব্যাপারে বেশ অনুদার। নতুন মার্কিন প্রশাসন এরই মধ্যে বেশ কিছু বিষয় শক্তভাবে মোকাবিলার আভাস দিয়েছে। এরমধ্যে আছে রাশিয়ার সম্প্রসারণবাদী এজেন্ডাও। বাইডেন তো বলেছিলেন, ভ্লাদিমির পুতিনের ‘আত্মা নেই’, সম্প্রতি আরও এক ধাপ এগিয়ে তাকে ‘স্বৈরশাসক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অনমনীয় থাকার আভাস দিয়েছেন তিনি। তার মানে, দুই দেশের মধ্যে সামনে ‘কোল্ড ওয়ার স্টাইল’ সম্পর্ক বিরাজ করবে।

এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্কের নতুন অবয়ব মূলত আঞ্চলিক জোট ও ন্যাটোর জোরালো উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হবে। এ প্লাটফর্মেই তুরস্ক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আঙ্কারার ভূরাজনৈতিক অপরিহার্যতা রাশিয়ার সম্প্রসারণ পরিকল্পনায় নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করতে পারে। সেটা যদি আঙ্কারা কাজে লাগায়, তবে এ প্লাটফর্মে শক্ত করে পা রেখে দাঁড়াতে পারবেন তিনি।

বাইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে যাওয়া অ্যান্টনি ব্লিংকেন তুরস্কের সঙ্গে সম্ভাব্য বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে সমর্থন করেছেন। এস-৪০০ কেনা এবং সাইপ্রাস ইস্যুতে তুরস্কের দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধানের প্রস্তাবসহ বিভিন্ন বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ব্লিংকেন স্পষ্টভাবে বলেছেন, তুরস্ক ন্যাটোর অপরিহার্য মিত্র এবং অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ।

অ্যান্টনি ব্লিংকেন স্টেট ডিপার্টমেন্টে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের বিশেষ সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত স্ট্র্যাটেজিক প্লানিং-এর জ্যেষ্ঠ পরিচালক ছিলেন তিনি। ফরেন পলিসি প্লানিং প্রসেস ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে।
ওই সময় ইমিয়া দ্বীপপুঞ্জের ঘটনা নিয়ে দৃশ্যত তুরস্কের পক্ষেই ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯৬ সালে জানুয়ারির শুরুতে এজিয়ান সাগরে গ্রিক-তুর্কি সঙ্ঘাতের সূত্র ধরেই বর্তমানে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সমুদ্রসীমা বিতর্কের পট রচিত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ব্লিংকেন এ সম্পর্ক জোড়া লাগাতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন।

তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা আনতে পারে ইতিহাসও। দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাস বেশ ভালো। ইতিহাস বলে, রাশিয়া ও তুরস্কের সম্পর্ক কিন্তু একই রেখায় চলে না। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক হিসাব উলট-পালট করে দিয়ে তুরস্ক ও রাশিয়ার সম্পর্ক দ্বান্দ্বিকতার ভেতর দিয়েই চলেছে এবং চলতে থাকবে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তাদের সম্পর্কের গভীরে বৈরিতা রয়েছে।

ধর্মীয় বিষয়টাও জরুরি। রাশিয়া খ্রিস্টান জনগোষ্ঠির পৃষ্ঠপোষক, অন্যদিকে তুরস্ক চায় আধুনিক ইসলামের সম্প্রসারণ। ষোড়শ শতাব্দি থেকে দুই শক্তিধর দেশের মধ্যে অসংখ্য সঙ্ঘাতের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার হিসেবে কাজ করেছে তুর্কি প্রণালীগুলোর নিয়ন্ত্রণ।

এখন বসফরাস ও দার্দানেলিস নিয়ন্ত্রণ করছে তুরস্ক। ভূমধ্যসাগর ও বড় সমুদ্রপথে প্রবেশে মাঝেমধ্যে রাশিয়াকে বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার দিচ্ছে না দেশটি। এখানে দুই দেশের ঐতিহাসিক বিরোধ দেখা যায়। রুশ জারতন্ত্র, ইস্টার্ন অর্থোডক্স মৈত্রিজোট এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে দীর্ঘ সঙ্ঘাতের কথা না হয় বাদই দিলাম।

উভয় শক্তি ২০১৫ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাব বিস্তারে সমানতালে কাজ করলেও বর্তমানে সিরিয়া ও লিবিয়া ইস্যুতে দুই পক্ষের মধ্যে ছোটবড় বেশ মতদ্বৈততা দেখা যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আঞ্চলিক কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগাতে পারে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, তুরস্ককে হাতে রেখে মস্কোর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবে বাইডেন প্রশাসন। বাইডেন হয়তো রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের সঙ্গে ঘনিষ্টতাকে প্রাধান্য দেবেন এবং ব্যক্তি এরদোয়ানের নেতৃত্বকে পুঁজি করে রাশিয়াকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করবেন।

যাই হোক, এরদোয়ানের চৌকষ নেতৃত্ব বিবেচনায় যে কেউ আশা করতে পারেন যে, তিনি দ্রুত বুঝে ফেলবেন, মার্কিন কৌশলের কোন রেখায় হাঁটলে পথ মসৃণ হবে। এবং, সেই পথেই হাঁটবেন তিনি।