তুরস্কের পরবর্তী টার্গেট কী

নীতিনির্ধারকরা সবসময় তার দেশের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই বৈদেশিক কৌশল নির্ধারণ করেন - ইন্টারনেট

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২০ নভেম্বর ২০২০, ১৫:০৩

প্রায় ৭ সপ্তাহের যুদ্ধের পর নাগোরনো-কারাবাখের সংঘাতের অবসান ঘটেছে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার শীর্ষ নেতাদের শান্তি চুক্তি সাক্ষরের মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিরতিও কার্যকর হয়েছে। আর্মেনিয়ার জনগন এ চুক্তিতে মোটেও খুশি নয়। তুরস্কের সমর্থনে আজারি সেনারা আর্মেনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর শুশা নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে যাওয়ার পরই যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়।

রাশিয়ার মধ্যস্থততায় শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগেই বেশ কিছু বসতি ও শিবির আজারবাইজান নিজেদের দখলে নিতে সক্ষম হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়া এবং শান্তিচুক্তির পেছনে রাশিয়া মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এ সুযোগে মস্কো নিজেদের শান্তিরক্ষী সেনাদেরকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নাগোরনো কারাবাখ উপত্যাকায় মোতায়েন করেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলছেন রাশিয়ান শান্তিরক্ষীদের সক্রিয় উপস্থিতি এ সংঘাতমুখর এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।

এ চুক্তি আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে যেমন উচ্ছাস এনে দিয়েছে, ঠিক ততটাই বিমর্ষ হয়ে আছে আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভান। আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী প্রায় দুমাস ধরে চলা এ যুদ্ধ সমাপ্তির ঘোষণা দেয়া মাত্রই হাজার হাজার মানুষ রাজধানীর রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী পাশিনইয়ানের পদত্যাগেরও দাবি জানায়।

এর বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে আজারবাইজানে। তারা এ শান্তিচুক্তিকে নিজেদের বড়ো বিজয় হিসেবে বিবেচনা করছে। স্থানীয় জনগন আজারবাইজান ও তুরস্কের পতাকা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। নিজেদের দেশের পাশাপাশি তুরস্কের পতাকাকে ধারণ করা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ আজারি জনগনেরা খুব ভালোভাবেই অনুধাবন করে যে, তুরস্কের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া আজারিদের এ জয় কখনোই সম্ভব ছিল না।

বিস্ময়করভাবে আজারি নাগরিকদের মধ্যে অনেকের হাতেই পাকিস্তানের পতাকাও দেখা যায়। পাকিস্তাানকে এভাবে পছন্দ করার বড়ো কারণ হলো, পাকিস্তানও তুরস্কের মতো প্রকাশ্যেই আজারবাইজানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও আজারবাইজানের এ বিজয়ে সন্তুষ্ট। ম‚লত নাগোরনো কারাবাখের এ যুদ্ধ আজারবাইজান, তুরস্ক ও পাকিস্তান - এ তিনটি দেশের সরকার ও জনগনকে অনেকটাই কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।

পাকিস্তান যুদ্ধের শুরু থেকেই আজারবাইজানের পক্ষে প্রকাশ্যে সমর্থন ব্যক্ত করে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান বলেন, তার সেনারা নাগোরনো কারাবাখে আজারি সেনাদের অবস্থানকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবে। তুরস্ক যেভাবে আর্মেনিয়াকে কোনঠাসা করে রাখার চেষ্টা করে পাকিস্তান সে প্রক্রিয়াতেও তুরস্ককে সমর্থন করে। এ কারণে আজারবাইজান- বরাবরই পাকিস্তান ও তুরস্কের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।

তুরস্ক অবশ্য সামরিকভাবেও আজারবাইজানকে সাহায্য করেছে। আজারি যেসব সেনারা নাগোরনো কারাবাখে মোতায়েন ছিল তাদেরকে অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষনও দিয়েছে তুরস্ক। তুরস্কের এ ভুমিকার কারণেই যুদ্ধের ফলাফল আজারিদের পক্ষে এসেছে। শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়ে আজারিদের অর্জনগুলো নিশ্চিত হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, এ দুই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সম্পর্ক, অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা আগামী দিনগুলোতে আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে।

তুরস্ক ও পাকিস্তান বর্তমানে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ফোরামে একসাথে কাজ করছে। এ দুই দেশের সামরিক ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এখন স্মরণাতীতকালের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে কাশ্মীর বিষয়ে পাকিস্তানের অবস্থানকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছে। পাশাপাশি কাশ্মীরের জনগনের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে এ সংকটের সমাধান করার জন্য ভারতের আহবান জানিয়েছে। তুরস্ক ও পাকিস্তানের মাধ্যে একটি সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনও তৈরি হয়েছে- যা এ দুদেশের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব বৃদ্ধি করেছে।

এ বাস্তবতায় নতুন আরেকটি দৃশ্যপটও সামনে এসেছে। তুরস্ক এবং পাকিস্তানের জনগনের মধ্যে একটি আবেগ ও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, দু দেশের সরকার মিলে যেন কাশ্মীরের পক্ষে ভ‚মিকা নেয়। এটা কী আসলে বাস্তব সম্মত? যদিও বিশ্লেষকরা মনে করেন, দক্ষিন এশিয়া ভৌগলিকভাবে তুরস্ক থেকে অনেক দূরে হওয়ায় তুরস্ক সহজে এ অঞ্চলের ইস্যুগুলোতে সম্পৃক্ত হবে না।

তুরস্কভিত্তিক স্ট্র্যাটেজিক এফেয়ার্স বিশেষজ্ঞ ইফতিখার গিলানি মনে করেন, জনমত বা জনগণের চাওয়ার ওপর ভিত্তি করে কোনো দেশই তার বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করে না। বরং নীতি নির্ধারকরা সবসময় তার দেশের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই বৈদেশিক কৌশল নির্ধারণ করেন। এছাড়া তুরস্কের সাথে ভারতের ঐতিহাসিকভাবেই একটি সম্পর্ক রয়েছে।

একসময় তুরস্ক ভারতে নানা ধরনের পণ্যও রফতানি করতো, যদিও এ প্রক্রিয়াও এখন অনেকটা মন্থর। তারপরও তুরস্ক ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রেখেই এগুচ্ছে। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের ছাত্রদেরকে তুরস্কে স্কলারশিপ দেয়ার পরিমাণ বেড়েছে। পাশাপাশি, ভারতে বসবাসরত মুসলিম স¤প্রদায়ের কল্যাণে বিভিন্ন মানবিক প্রকল্প বাস্তবায়নে তুরস্কের এনজিওগুলো এখন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয়ও রয়েছে।

পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে তুরস্ক নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও তা নিয়ে দ্বিমতও আছে। কেউ কেউ মনে করছেন তুরস্কের পক্ষে পাকিস্তানের ইস্যুতে এভাবে সম্পৃক্ত হওয়া সম্ভব। আবার অন্য আরেকটি মতও আছে- যারা মনে করে পাকিস্তান ও তুরস্কের বর্তমান নেতৃত্বই এসব স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড়ো বাঁধা। এ দৃষ্টিভঙ্গির লোকেরা বলছেন, “আমরা আর মিছে স্বপ্ন দেখতে চাই না। আমাদের এখানে এরদোয়ানের মতো ক্যারিশমাটিক লিডারও নেই, আবার আজারিদের মতো প্রেসিডেন্টও নেই। পাকিস্তানে যেভাবে আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক কর্মকর্তারা তৈরি হয়েছেন তার সাথে তুরস্কের বাস্তবতার কোনো মিল নেই।

তুরস্ক ও পাকিস্তানের অনেক রাজনীতিবীদও কাশ্মীরে একটি যৌথ উদ্যেগের স্বপ্ন দেখেন। তবে তারা এও মনে করেন যে, তুরস্কের এক্ষেত্রে আগ্রহ থাকার তেমন কারণ নেই। কাশ্মীর কখনোই তুরস্কের স্বার্থে কোনো ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়নি। অনেকে মনে করেন আপাতত কাশ্মীর ইস্যুতে তুরস্ক ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনো জোট গঠনের সম্ভাবনা নেই। এখন পর্যন্ত, তুরস্ক বা পাকিস্তান - কোনো দেশের সরকারই কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের সরকারের সাথে জোরালোভাবে কোনো কথা বলেনি।

আনেক বিশ্লেষক আরেকটি বাস্তবতাও তুলে ধরেছেন। তুরস্ক ও ভারতের মধ্যেও একাধিক সামরিক প্রকল্প চলমান রয়েছে। তুরস্ক এ মুহুর্তে ভারতের জন্য নৌ যুদ্ধজাহাজ তৈরি করছে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের একটি সামরিক চুক্তিও হয়েছে। আর দুই দেশই পরস্পরের সাথে বানিজ্যিকভাবে সম্পৃক্ত। এ অবস্থায় তুরস্ক কোনোভাবেই ভারতের সাথে যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না।
২০১৯ সালে ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকার সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে কাশ্মীরের স্বতন্ত্র মর্যাদা বিলুপ্ত করে। তাৎক্ষনিকভাবে কাশ্মীরের অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। তারপর থেকে, কাশ্মীর ইস্যুতে মুসলিম বিশ্বের আবেগ ও তৎপরতা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে মার্কিন বিরোধী বøক বিশেষ করে চীন, পাকিস্তান ও তুরস্ক কাশ্মীর ইস্যুতে কী কৌশল নেবে তা সময়ই বলে দেবে।

বর্তমানে লাদাখে ভারত ও চীনের মধ্যে যে উত্তেজনা চলছে, তার ওপরও কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের ভবিষ্যত ভূমিকা অনেকটা নির্ভর করে। তবে বাস্তবতা হলো, ভৌগলিক অবস্থানে যত দুরত্বই থাকুক না কেন, সা¤প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক ও পাকিস্তানের সামরিক সম্পর্ক ভিণœ উচ্চতায় চলে গেছে। আজারবাইজান ইস্যুতে দুই দেশের অবস্থান এক হওয়ায় পাকিস্তানের প্রতি তুরস্কের ইতিবাচক মনোভাব যে অনেকটাই বেড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নয়াদিল্লী বিষয়টি নিয়ে মোটেও স্বস্তিতে নেই এবং তারা প্রতিমুহুর্তেই তুরস্ক ও পাকিস্তানের কার্যক্রমের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।

চীন নিয়েও ভারতের উদ্বেগ কমছে না। লাদাখ সীমান্তে ভারত নতুন করে রাশিয়ার তৈরি টি-সেভেনটি টু ট্যাংক মোতায়েন করেছে। সবমিলিয়ে ভারত- পাকিস্তান- চীন ও তুরস্ক- এ চার দেশের ভবিষ্যত কর্মকৌশল নিয়ে আগাম মন্তব্য করার মতো পরিস্থিতি এখন আর নেই। যে কোনো সময় যে কোনো কিছুই ঘটতে পারে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে