ককেশাসে কমছে রাশিয়ার দাপট, বাড়ছে তুরস্কের প্রভাব

আর্মেনিয়ায় রয়েছে রুশ সামরিক ঘাটি। তুরস্কের সহযোগিতায় আজারবাইজান এবার আর্মেনিয়াকে অনেকাংশে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। ছবিটি আর্মেনিয়ান মিলিটারির - রয়টার্স

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২২ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৪৫

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিভিন্ন দেশে অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। তার কারণে সিরিয়া ও লিবিয়া সংকটের সমাধান হয়নি। তবে এবার বেলারুশ ও কিরগিজস্তানে গণ অভ্যুত্থান এবং আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধে বেশ বিপাকে পড়েছেন পুতিন। ককেশাস অঞ্চলে যুদ্ধে রাশিয়ার সঙ্গে লিবিয়া সংকট নিয়ে দরকষাকষিতে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছেছে তুরস্ক। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আজ থাকছে এ সম্পর্কে বিস্তারিত।

রাশিয়ার স্বঘোষিত প্রভাববলয়েই এখন মস্কো তার অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না। বেলারুশ, মধ্য এশিয়া এবং ককেশাস অঞ্চলের চলমান সংকটে হতচকিত হয়ে পড়েছে ক্রেমলিন। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোতে রাশিয়ার স্বার্থ ধরে রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘুম হারাম অবস্থা। এতে বিশ্ব মঞ্চের একজন সুনিপুণ কুশলী হিসেবে তার যে ভাবমূর্তি ছিল, তাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

রাশিয়ার একজন জ্যেষ্ঠ আইনপ্রণেতা ও পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র কনস্টানটিন জাটুলিন বলেন, এসব সংঘাতে মস্কোর কোনো লাভ নেই। রাশিয়ার ‘নিয়ার অ্যাবরোড’ বা নিকট প্রতিবেশী বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তিনি।

রাশিয়াকে বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় পুতিন বহু বছর ধরে কাজ করেছেন। ল্যাটিন আমেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যর বিভিন্ন সংঘাতময় দেশ, এমনকি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও তিনি হস্তক্ষেপ করেছেন। পাশ্চাত্যকে বহু বছর ধরে অস্থিতিশীল করার পর এবার তিনি নিজেই একই দশায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এক সময় পররাষ্ট্র বিষয়ে তাকে মনে করা হতো নিশ্চিত সমাধানকারী। কিন্তু এখন তিনি সেই অবস্থান হারাতে বসেছেন।

গত আগস্টে বেলারুশের অজনপ্রিয় স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে রাজপথে গণঅভ্যুত্থান শুরু হলে পুতিন তাতে হস্তক্ষেপ করেন। এতে বেলারুশের জনমত রাশিয়া বিরোধী হয়ে ওঠে। অথচ দেশটি ছিল ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাশিয়া-ঘনিষ্ট।

মধ্য এশিয়ার কিরগিজস্তানে গণ অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট সরোনভাই জিনভেকভের পতন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অথচ মাত্র দুই সপ্তাহ আগে পুতিন তার সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করে বলেছিলেন, তাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে রাশিয়া সবকিছুই করবে।

এবং ককেশাস অঞ্চলে নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত সম্প্রতি আবার যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। এতে বেকায়দায় পড়েছে রাশিয়া। দুটি দেশের সঙ্গেই রাশিয়ার ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। তবে আর্মেনিয়ায় রয়েছে রুশ সামরিক ঘাটি। তুরস্কের সহযোগিতায় আজারবাইজান এবার আর্মেনিয়াকে অনেকাংশে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।

পুতিনের ঘনিষ্ট মিত্র পার্লামেন্ট মেম্বার জাটুলিন বলেন, ‘আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে রাশিয়া সাধ্যমত সবকিছু করছে। কিন্তু সেখানে প্রতিদিনের সংঘাত রাশিয়ার সেই চেষ্টাকে কার্যত ব্যর্থ করে দিচ্ছে। কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়াকে বিশ্বশক্তির মর্যাদায় নিতে পুতিন বহু বছর ধরে চেষ্টা করেছেন। নতুন এসব অস্থিতিশীলতা পুতিনের মর্মমূলেই আঘাত করছে। ঘরের পাশেই এসব অস্থিতিশীলতায় বিচলিত পুতিনও এখন সুর নরম করেছেন। যেমন নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে তিনি বলেছেন, আমরা আশা করি এই সংঘাত খুব দ্রুতই শেষ হবে। কিরগিজস্তানের গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা আশা করছি সবকিছু খুব শান্তিপূর্ণ হবে।

অবশ্য রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর এই অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতের জন্য রাশিয়ার সরকার সমর্থক ভাষ্যকাররা পাশ্চাত্যকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, পাশ্চাত্য সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলে অনৈক্যের বীজ বপন করছে।

তবে নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান এই অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী হচ্ছে করোনাভাইরাস মহামারি। এই মহামারিতে রাশিয়া এবং তার প্রতিবেশী দেশগুলো বিপন্ন হয়েছে। এতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের ধরাছোয়ার বাইরে থাকা নেতাদের ওপর মানুষের অবিশ্বাস জন্মেছে। বেলারুশ ও কিরগিজস্তানে করোনার কারণে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়েছে। সেখানকার শাসকরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন।

যেমন বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো জনগণকে এই বলে ক্ষেপিয়ে তুলেছেন যে ভদকা খেলেই করোনা সেরে যাবে। আবার কিরগিজস্তানে করোনা সহায়তা গ্রাস করেছে ধনী ব্যক্তিরা। এমনকি রাশিয়াতেও জনগণ অর্থনৈতিক দুর্দশায় নিপতিত হয়েছে। এতে পুতিনবিরোধী ক্ষোভ বাড়ছে। দেশটিতে সম্প্রতি বিশাল বিশাল বিক্ষোভ হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়ার ভেতরেই এই অসন্তোষ এই বার্তা দিচ্ছে যে ভূরাজনীতির খেলা বাদ দিয়ে পুতিনের উচিত অভ্যন্তরীণ ইস্যু যেমন জনগণের অর্থনৈতিক দুর্ভোগ, দুষণ, দুর্বল স্বাস্থ্যসেবার দিকে মনযোগ দেওয়া। কিন্তু পাশের দেশগুলোতে সংঘাত-সহিংসতায় মনে হচ্ছে পুতিনকে দেশের বাইরেই মন দিতে হবে।

কার্নেগি মস্কো সেন্টারের বিশ্লেষক তাতিয়ানা স্টানোভায়া বলেন, আসলে পুতিনের লক্ষ্য হলো বিদেশনীতি ঘিরে রাশিয়াকে আবার মহান ও সফল করা। নতুন এসব সংকট পুতিনকে অভ্যন্তরীণ সমস্যার দিকে মনযোগ দিতে দিবে না। এসব দেশের সংকট পুতিনের কতটা মাথাব্যথার কারণ তা বোঝা যায় পুতিনের ৬৮তম জন্মদিনে তাকে টেলিফোন করা বিশ্ব নেতাদের তালিকা দেখেও। তাকে যে ১২ জন নেতা ফোন করেন তাদের মধ্যে মাত্র তিনটি দেশ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরের। এগুলো হলো- ইসরাইল, ভারত ও কিউবা।

আর্মেনিয়ায় রয়েছে রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি। তাই অনেকে মনে করেছিলেন রাশিয়া এই সংঘাতে শক্তি প্রয়োগেও পিছপা হবে না। তবে ককেশাস অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা ক্ষীণ হয়ে আসছে। নাগোরনো-কারাবাখ সংঘাতে আগে রাশিয়া মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকায় থাকত। এবারও মধ্যস্থতার উদ্যেগ নিয়েছে মস্কো। যুদ্ধ বিরতি কতদিন কার্যকর থাকে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আজারবাইজানের ঘনিষ্টতম মিত্র তুরস্ক এবার আঞ্চলিক এ সংঘাতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।

আজারবাইজানের রাজধানী বাকুর সেন্টার ফর অ্যানালাইসিস অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সের চেয়ারম্যান ফরিদ সাফিয়েভ বলেন, চলমান সংকটে রাশিয়ার একতরফা প্রভাবে তুরস্ক সত্যিই লাগাম টেনেছে। ককেশাস অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব শেষ হয়ে যাচ্ছে।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন অঞ্চলে রুশ এখনও প্রধান ভাষা। এ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণহীন ইন্টারনেট সেবা থাকায় একটি দেশের বিক্ষোভ দ্রæতই আরেকটি দেশের জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন রাশিয়ার খাবারোভস্কের সাম্প্রতিক বিক্ষোভের সঙ্গে মিল খুজে পাওয়া যায় বেলারুশের গণ অভ্যুত্থানের। অথচ দুটি অঞ্চলের মধ্যে দূরত্ব চার হাজার মাইল।

আবার কিরগিজস্তানের সংসদ নির্বাচনে সরকারবিরোধীরা চোখ রাখছে বেলারুশের দিকে। বেলারুশের জালিয়াতির নির্বাচন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। এ নিয়ে দেশটিতে লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়। কিরগিজস্তানের একটি সংবাদ সংস্থার পরিচালক আইবেক সুলতান গাজিয়েভ বলেন, ‘ বলা হয় কিরগিজস্তানের আন্দোলন বেলারুশের গণঅভ্যুত্থানের নকল। তবে কিরগিজস্তানবাসী আন্দোলনে বেলারুশকেও ছাড়িয়ে গেছে। বেলারুশের এই ঘটনা প্রতিবেশী দেশগুলোতে রাশিয়ার প্রভাব হ্রাসের পূর্ব সতর্কতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে পুতিন সরাসরি তার পক্ষ নেওয়ায় বেলারুশের রাশিয়াপন্থী অনেক মানুষও ক্ষুব্ধ।

পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাটুলিন বলেন, রাশিয়ার সর্বোচ্চ মহলও মনে করে যে লুকাশেঙ্কোকে আজ হোক আর কাল হোক বিদায় নিতেই হবে। তবে লুকাশেঙ্কো ভয় দেখাচ্ছেন যে আন্দোলনের মুখে তাকে সরে যেতে হলে তা একটি বিপজ্জনক নজির হয়ে থাকবে। তাহলে এক সময় পুতিনকেও হয়তো এভাবেই বিদায় নিতে হবে। তবে জাটুলিন স্বীকার করেন যে লুকাশেঙোকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে রাশিয়া নিজেদের জন্য বিশাল সমস্যা সৃষ্টি করছে। ভবিষ্যতে বেলারুশের জনগনের বিশাল অংশ রাশিয়াকে পছন্দ করবে না। তারা পাশ্চাতের দিকে ঝুঁকবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নাগোরনো-কারাবাখ সংঘাত নিরসনে তুরস্ককে এবার সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলতে হবে। এক্ষেত্রে সিরিয়া ও লিবিয়ায় ছাড় দেওয়ার বিনিময়ে মস্কো হয়তো ককেশাস অঞ্চলে তুরস্কের কাছ থেকে কিছুটা ছাড় পেতে পারে। সিরিয়া ও লিবিয়ায় তুরস্ক ও রাশিয়া বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে।

এতোদিন মিনস্ক গ্রুপের কো চেয়ার হিসেবে নাগোরনো-কারাবাখ সংঘাতে বড় ভূমিকা রাখত রাশিয়া। আর্মেনিয়ায় রাশিয়ার তিন হাজার সেনা মোতায়েন থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আজারবাইজানের সঙ্গেও মস্কো ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তোলে।

তবে তুরস্কের সামরিক সহায়তায় আজারবাইজান গত সেপ্টেম্বরে নাগোরনো-কারাবাখের কৌশলগত উচ্চভূমি দখল করে নেওয়ার পরই হিসাব নিকাশ পাল্টে যায়। আমেনিয়া সরকারও এখন বুঝতে পারছে যে তারাও বিপদের মুখে রয়েছে।

আর্মেনিয়ার সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক থাকা তুরস্ক সবসময়ই আজারবাইজানকে রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে। তুরস্কের ড্রোন এবার আর্মেনিয়াকেও বিপন্ন করে তুলেছে। পাশাপাশি রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা অস্ত্রশস্ত্র এবার আজারবাইজানকে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

নাগোরনো-কারাবাখের সংঘাতে ধর্মীয় কার্ড খেলতে চেয়েছিল আর্মেনিয়া। আর্মেনিয়া একটি খ্রিস্টান দেশ আর আজারবাইজান মুসলিম প্রধান। আর্মেনিয়া এই যুদ্ধকে সভ্যতার সংঘাত হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। আর্মেনীয় সরকার আশা করেছিল রাশিয়া তাদের সর্বাত্মক সমর্থন দেবে। তবে বাধ্য হয়েই রাশিয়া এবার সেই আশার গুড়ে বালি ঢেলে দিয়েছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে